সাপ্তাহিকী
|
আব্দুল মান্নান
|
|
না হয়ে বিশ্বজিৎ হতেন যদি মুজাহিদ
22 Dec, 2012
বিশ্বজিৎ শব্দের অর্থ যিনি বিশ্বকে জয় করেছেন এবং যিনি কোনো কিছুকে জয় করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন তিনি হচ্ছেন মুজাহিদ। শব্দার্থ এবং কর্মের বিবিচনায় বিশ্বজিৎ ও মুজাহিদ শব্দদ্বয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে শব্দদুটি যখন ব্যক্তির নাম হিসাবে ব্যবহৃত হয় তখন ব্যক্তিদ্বয়ের অবস্থান হয় বিপরীত মেরুতে।একজন বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন হয়ে সম্মানিত হন শান্তির প্রতীক হিসাবে এবং অপরজন পরিচিতি লাভ করেন শান্তি বিনষ্টকারী হিসাবে।অনাকাঙ্খিত কোনো ঘটনায় উল্লিখিত নামের দুই ব্যক্তি সম্পৃক্ত নাহয়েও মৃত্যুবরণ করলে একজনকে চিত্রিত করা হবে নিরপরাধ শান্তিকামী হিসাবে। আর অপরজনের স্থান হবে দুর্ধর্ষসন্ত্রাসী, জঙ্গীও খুনিদের তালিকায়।বিশ্বজিৎ প্রাণ দিয়ে সেটাই প্রমাণ করে গেলেন।
৯ ডিসেম্বর ২০১২ ইং তারিখে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮দলীয় জোটের ডাকা রাজপথ অবরোধ কর্মসূচী ছিল । আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর তা প্রতিহত করার জন্য ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।ফলশ্রুতিতে তাদের রোষানলে প্রাণ দিতে হয়েছিল বিশ্বজিৎ দাস নামক একনিরীহ যুবক সহ তিনজন হতভাগা মানুষকে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বি শেষে যে কোনো ব্যক্তিকে অন্যায় ভাবে হত্যা করা মহা পাপ এবং গুরুতর অন্যায় কাজ। রাজধানীর রাজপথে দিবালোকে প্রকাশ্যে মধ্য যুগীয় কায়দায় পৈশাচিক সেই হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করলরাজ পথে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো মানুষ। আর মুহূর্তের মধ্যে মিডিয়ার বদৌলতে তা ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের আনাচে-কানাচে অগণিত দর্শক-শ্রোতাদের কাছে।
আমাদের সমাজের সকল শ্রেনী-পেশার অধিকাংশ লোকেরা এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছে যে, সত্য কথা বলার ব্যাপারেও পূর্বেই চিন্তা করে নেয় তার বক্তব্য পছন্দকৃত দল ও ব্যক্তির পক্ষে যাচ্ছে কিনা।সত্য হলেও যদি বিপক্ষে যায় তাহলে মন্তব্য করা থেকে নিরাপদ স্থানে অবস্থান করবে।অথবা ইনিয়ে-বিনিয়ে যুক্তির মাধ্যমে নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করবে এবং প্রতিপক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে দায় মুক্তহতে চাইবে। বিশ্বজিতের মৃত্যুরপর থেকেই সেটির চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে।কিন্তু কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং বিশ্লেষকদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে সরকরের চাতুর্যপূর্ণ মিথ্যা প্রচারণা কাজে আসছেনা।
অন্য দিকে উপরোল্লিখিত কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং বিশ্লেষকদের মধ্যে আবার অনেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত করে নিজেদের মতাদর্শের দিকে কৌশলে আহবান করে থাকেন।পক্ষান্তরে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়গুলি ভূলুন্ঠিত হলেও চতুরতার সাথে পাশকাটিয়ে কথা বলেন।তাঁরা ধরেই নিয়েছেন সকল ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠরা অত্যাচারী। এবারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দিকে দৃষ্টিদিলে একই চিত্রদেখা যাবে।একই নির্দেশে বিশ্বজিৎদাস ছাড়াও অন্য আরো হতভাগ্য দুজনের মৃত্যু নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছেননা। অন্য দুজন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়াতে স্বয়ংক্রিয় ভাবে তাদের নাম অপরাধীদের তালিকায় যুক্ত হয়ে গিয়েছে । নিরপেক্ষতার বিচিত্ররূপ আরো কতদিন আমাদেরকে দেখতে হবে তা আল্লাহ্ই ভালো জানেন।
বর্তমানে আমাদের দেশের অবস্থা খুবই নাজুক। অমুসলিমরা তাদের শরীরে বিরাট এক সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা না করলে যেন গত্যন্তর নেই।কারণ, তা না করলে প্রাণহারানোর সম্ভাবনা থেকেই যাবে।সরকারের পক্ষথেকে সোনারছেলেদের কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিরোধীদের দমন করার জন্য মাঠ দখলে রাখতে।কাজেই মাঠে অন্যকারো থাকার অর্থই হলো তারা সরকারবিরোধী।সোনারছেলেরা ফরমূলা অনুযায়ী সঠিককাজটিই করেছিল।কিন্তু তাদের ভাগ্যে বিপর্যয় ঘটল অন্যকারণে।তারা বুঝতে পারেনি যাদের সমর্থনে ও প্রচেষ্টায় আওয়ামীলীগ ক্ষমতা দখল করেছে, বিশ্বজিৎদাস তাদেরই একজন। হুকুম দাতারা হয়তো আক্ষেপ করছে আর হাহুতাশ করে হত্যাকারীদের প্রতিপ্রশ্ন ছুঁড়েবলছে বাবারা মারলি যখন,তখন একজন মুসলমানকে মারলিনা কেন? দাড়ি-টুপি ওয়ালা মুসলমান হলে সহজেই জামায়াত-শিবিরের কর্মী, আর তা না হলে কমপক্ষে বিএনপির কর্মী বানানো কোন ব্যাপারই ছিলনা।তারা যে এটাই করতো তার প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্যদের বক্তৃতা থেকেই পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে। ঘটনার আগ পর্যন্ত সক্রিয় ছাত্রলীগের কর্মীদেরকে বহিস্কৃত এবং বিএনপি-জামায়াতের পক্ষের শক্তি হিসাবে প্রচার করছে এবং বলা হচ্ছে ছাত্রলীগের সাথে এদের দূরতম সম্পর্ক নেই।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে লগী-বৈঠার মাধ্যমে এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারী থেকে ২০১২ সালের ৯ই ডিসেম্বরে রাজপথ দখলের মহড়া পর্যন্ত ছাত্রলীগের কর্মীদের নানাবিধ তাণ্ডবের কথা কে না জানে। বিগত দিনের খবরের কাগজগুলিতে চোখ বুলালে তাদের অতীতের বিভৎস চেহারা জীবন্ত হয়ে ধরা দেবে। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রতিপক্ষকে যে কোনোভাব ঘায়েল করা, টেণ্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং সহ আরো নানা ধরণের জঘন্য অনৈতিক কাজে তারা লিপ্ত। তাদেরআকাঙ্খা চরিতার্থ করার জন্য তারা রামদা, চাপাতির ন্যায় দেশীয় অস্ত্রের সাথে সাথে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার যেমন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেকরেছে, ঠিক তেমনিভাবে স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজের দলের সহকর্মীদের বিরুদ্ধেও।তাই আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী বয়োবৃদ্ধ জনাব এবিএম মুসা আদর করে ছাত্রলীগের নামকরণ পিস্তল-লীগ না রেখে চাপাতি-লীগ রেখেছেন।পরবর্তীতে তারা আর কি ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করবে এবং কি ঘটাবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক, রাজনীতিক যেই হোননা কেন,সত্যিকার অর্থেই যদি দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও অহিংস সুন্দর পরিবেশ দেখতে চান তাহলে নিজেরদলের বিরুদ্ধে হলেও নিরপেক্ষভাবে কথা বলুন।ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পেছনে দৌড়িয়ে ও মনগড়া তথ্য পরিবেশন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়।উস্কানীমূলক কথা মানুষের মনেহিংসা ও প্রতিহিংসার জন্মদেয়, কিন্তু দেশ গড়তে তা সহায়ক হয়না।দেশ গড়ার জন্য সকল নাগরিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অনস্বীকার্য। নির্যাতিত ব্যক্তি বিশ্বজিৎ অথবা মুজাহিদ যেই হোননা কেন ন্যায় বিচার উভয়েরই প্রাপ্য তা ভুলে গেলে চলবেনা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন