(গত সংখ্যার পর)
দিল্লীতে বাহাই সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ভ্রমণ শেষে আমাদের জন্য নির্ধারিত ট্যুর অপারেটরের কোচে রাতের বেলা আজমীর শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আমরা সকলেই রওয়ানা দেই।সারা রাত কোচ জার্ণি শেষে সকাল আনুমানিক ৯টা কি সাড়ে নয়টার দিকে আমরা খাজা বাবা হযরত আজমেরী রহমতুল্লাহের মাজার শরীফে পৌছাই। হোটেলে ফ্রেস হয়ে আমরা সকল ছেলে-মেয়ে ও শিক্ষক-শিক্ষিকা বৃন্দ মহান এই ওলী দরবেশের রওজা মোবারক জেয়ারতের জন্য মাজারে প্রবেশ করি।মাজারের প্রবেশ পথে বিভিন্ন বাহারী রঙ এর ফ্রেস ফুলের থালা হাতে নিয়ে ফুল বিক্রেতারা রাস্তায় আগলে ধরলেন।বলা যায় অনেকটা জোর করে আমাদের একেক জনের হাতে একেক থালা ধরিয়ে দিলেন মাজারে ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য।
মাজারের মূল ঘরে যখন প্রবেশ করলাম, আমরা ভাবলাম জেয়ারত করবো, দোয়া দুরুদ করবো, কিন্তু বাধ সাধলেন মাজারের কেয়ার টেকার, মাথায় টুপি, শশ্রু মন্ডিত মাওলানা মাথায় হাত দিয়ে মাজারের গিলাফ দিয়ে মাথা ঢেকে দিয়ে প্রত্যেক কে বিড় বিড় করে কি যেন দোয়া করতে থাকলেন, একে একে সবাই হাসি মুখে উনার এই কাজকে অনুসরণ করে সারা দরগা শরীফ যখন পুরো পাখ বা ঘুরে আসলো, তখনি মাজারের ঐ মাওলানা প্রত্যেকের কাছে মাজারের গিলাফ বা রুমাল জাতীয় কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে দিয়ে তিনি যে দোয়া করেছেন, সেজন্য পয়সা তথা হাদিয়া দাবী করলেন। আমার বন্ধু-বান্ধবীরা হাসি-মুখে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও তা উনাকে দিতে বাধ্য হলেন, তারপর একে একে মাজারের ভিতর থেকে বের হয়ে এলেন।মজার ব্যপার হলো, মাওলানা আমার উপর ভীষণ ক্ষেপে গেলেন, এই কারণে যে, আমি উনার দেওয়া কাপড়ে মাথা ঢেকে মাজারে মাথা নত করে উনার সাথে সারা মাজার ঘুরি নাই, সেজন্য উনি আমার কাছে কোন হাদিয়া দাবী করতে পারছেননা, ফলে আমারতো সাংঘাতিক বিপদ হয়ে যাবে, আর উনি থাকতে আমাদের দলের সকলের জন্য আমার কারণে বিপদ আসতে দিতে পারেননা, তাই আমাকে ফায়সালা করতে হবে, তবেই আমি মাজার থেকে বের হতে পারি।আমি মাওলানা কে খুব আদবের সাথে বললাম, আপনার কাজ মাজারের রক্ষণা-বেক্ষণ করা, আমার মতো লোকের পেছনে সময় নষ্ট করা কেন? আর আমার যে কোন বিপদ সেটা আমার নিজেরই, আপনি কেন নিবেন।আমার বন্ধু এবং বিশেষ করে বান্ধবীরা বললো উনাকে টাকা দিয়ে দিতে।উনি যখন নাছোড় বান্দা, তখন আমি উনাকে শান্ত ভাবে বললাম, আমি বড় পীর আবদুল কাদের জিলানীর মুরিদ এবং সৈয়দ, এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন কি করবেন, কারণ আমাকে এই অবস্থা থেকে বের করার দায়িত্ব বড় পীরের।কাজ হলো, ভদ্রলোক পিছু হটোলেন, আমিও মাজার থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে এসে দেখি, বন্ধু-বান্ধবী ও শিক্ষকবৃন্দ ফুল ওয়ালাদের সাথে তাদের দেওয়া থালের টাকা পরিশোধে গলদ-ঘর্ম হচ্ছেন, আমি সেই দৃশ্য বেশ উপভোগ করেছিলাম।
বিকেলে খাজা গরীব নেওয়াজের আজমেরী বাবার মাজার থকে আমরা একই কোচে রওয়ানা দেই আগ্রা তাজমহল দর্শনের জন্য।
তাজমহল যাত্রা পথে আমরা পথে পথে নানা দর্শনীয় স্থানে যাত্রা বিরতি করি।মজার ব্যপার হলো কোচের মধ্যে আমাদের জন্য ছিলো বিচিত্র রকমের এক ইন্টারভিউ।কোচের একেবারে সমনের সীটে বসেছিলেন ডঃ মোহাম্মদ মোহাব্বত খান, তার পেছনের আসনে ছিলেন ডঃ কামরুল আলম, প্রফেসর মাহবুবুর রহমান, মিসেস মাহবুব এবং ডঃ জেরিনা রেহমান খান।কোচের মধ্যে গভীর রাতে সবাই যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলো, ঠিক তখনি একে একে করে ডাকতে থাকলেন ডঃ মোহাব্বত খান।প্রত্যেকের জন্য অনির্ধারিত এক ইন্টারভিউ দিতে হয়, বেশ কিছু প্রশ্ন, তাতে যেমন ছিলো একাডেমিক, একই সাথে শিক্ষা সফর সংক্রান্ত, ইন্টারভিউ শেষে ডঃ মোহাব্বত খান ঘোষণা করেন, প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত মার্ক্স লিখে রাখা হয়েছে, যা আমাদের টিউটোরিয়ালে যোগ হবে বলে একাডেমিক কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। কেউ কেউ খুশী হলেও অনেকেই বিস্মিত ও নাখোশ হয়ে যায়, কেননা কারো কারো এই ইন্টারভিউ তেমন সুবিধা হয় নাই। যাই হউক ডঃ জেরিনা রেহমান খান সহ সকলেই তাতে সম্মতি জানালে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের আর কিছু করার ছিলোনা।শেষ রাতের কিছু আগে আমাদের কোচ পথের ধারে খাবারের দোকানে থামে, সেখানে হাত-মুখ পরিস্কার করে খাটিয়ার উপর বসে রাতের চাদের আলোতে একই প্লেটে ভাত-রুটি-ডাল-মাংশ-দহি সমাভিব্যবহারে রাতের খাবার খেতে হয়।কিছুক্ষণ পর আমরা সেখানে অবস্থান করে আবারও কোচের যাত্রী হয়ে যাই।পরদিন দুপুর নাগাদ আমরা রাজস্থান পৌছি।সেখানে দিনে-দুপুরে রাস্তার মাজ দিয়ে হাতির উপর দিয়ে রাজকীয়ভাবে ভ্রমণের লোভ কেউই সামলে রাখতে পারিনি। রাজস্থানের ঐতিহাসিক স্থান সমূহ দর্শনের পর বেলা ২টা নাগাদ আমরা পৌছি রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে আমাদেরকে স্বাগত জানান রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ এম,পি,শর্মা এবং প্রখ্যাত জনপ্রশাসন বিষয়ক লেখক, অধ্যাপক ডঃ আর,কে,আরোরা।আমাদের জন্য আগেই থেকে নির্ধারিত করা ছিলো রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ভবনে শিক্ষা সফর সমাবেশের আনুষ্টানিক আলোচনা।শুরুতেই ডঃ আর,কে,আরোরা স্বাগত বক্তব্যে এই ধরনের শিক্ষা সফরের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপস্থাপণ করে এর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ডঃ মোহাম্মদ মোহাব্বত খান।উভয়ের বক্তব্য শেষে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের পালা, সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের শুরুতে ডঃ আর পি আরোরা এবং ডঃ মোহাম্মদ মোহাব্বত খান যৌথভাবে আমাদেরকে ভাইস চ্যন্সেলর ডঃ এম,পি,শর্মার সাথে একে একে সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন।পরিচয় ও করমর্দন এবং ফটোসেশন শেষে মূল বক্তব্য রাখেন ডঃ এম,পি,শর্মা। ড শর্মা পাবলিক এডমিনিষ্ট্রেশনের উপর অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী, যার অসংখ্য বই এবং প্রকাশনী রয়েছে, তা দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়ে থাকে। এমন ধারণা নিয়েই আমরা যখন ডঃ শর্মার বক্তব্য শুনছিলাম, মনে হলো এ যে আমাদের ধারণাকেও হার মানিয়ে গেছে।জনপ্রশাসনের উপর এতো গভীর জ্ঞান ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য এর আগে কখনো শুনেছি বলে মনে হলোনা।পুরো সিন্ডিকেট ভবন পিন-পতন নীরবতা, যেন সূচ পড়লেও শব্দ হবে, এমন অবস্থা।বিকেল ৫টা নাগাদ আমরা রওয়ানা হলাম নেতাজী জওহর লাল নেহরুর স্মৃতি বিজড়িত ভবনে পরিদর্শনের জন্য, আমাদের সঙ্গী হয়ে রইলেন প্রফেসর ডঃ আর কে আরোরা।নেহরু ভবনে পরিদর্শন শেষে প্রফেসর আর কে আরোরা জানালেন রাজস্থান কর্তৃপক্ষ আমাদের সকলের জন্য আজ রাতে রাজস্থানের বিখ্যাত ( যা পুরো ভারতে সব চাইতে বড় সিনেমা হল)সিনেমা হলে রাতের প্রিমিয়াম শো দেখার জন্য রাজকীয় এক ব্যবস্থা।ছাত্র-ছাত্রী সকলেই মহা আনন্দিত। আরো আনন্দের কারণ ঐ সময় সিনেমাতে ঐ রাতেই রিলিজ হয় তখনকার জনপ্রিয় হিন্দী ছবির নায়ক অনিল কাপূর এবং নায়িকা মাধুরী দীক্ষিত অভিনীত নতুন ছবি বেটা।প্রফেসর আরোরা জানালেন, আমরা চাইলে সকলে মিলে ঐ ছবি ঐ হলে দেখতে পারবো দর্শকদের সাথে বসে।যেমন অফার তেমন কাজ, সকলে এক বাক্যে রাজী।রাজস্থানের ঐ সিনেমা হলটি যেমন বড়, তেমনি সুন্দর ও বেশ আরামদায়ক, সাউন্ড কোয়ালিটি খুব উচু মানের, সিনেমা হলের ভিতরে ছবি দেখার সাথে স্ন্যাক্স আপ্যায়নের সুন্দর ব্যবস্থা আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে তখনকার নামকরা নায়ক-নায়িকার এই ছবি দেখার জন্যও সেদিনের রাতের শোতেও ছিলো অসম্ভব ভীড়।বেটা ছবি দেখে বেশ গভীর রাতে আমরা সকলেই রাজস্থানের রাজপথ বেশ মজা করে হেটে হোটেলে এসে বিশ্রাম নেই। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই আমরা রওয়ানা হই স্বপ্নের তাজমহল দর্শনে।বলাই বাহুল্য দিল্লীতে ঐতিহাসিক কুতুব মিনার, লাহোর গেইট দর্শন ছিলো অসাধারণ এক মিষ্টি মধুর অভিজ্ঞতা, যা স্মৃতির ভান্ডারকে করেছে আরো মহিমান্বিত।
(আগামী কিস্তিতে তাজমহল সহ শিমলা ভ্রমণ, সঙ্গে কাশ্মিরের জঙ্গীগোষ্টীদের খপ্পরে পড়ে সেখান থেকে কৌশলে আমাদের সকলের বেচে আসার কাহিনী)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন