সাপ্তাহিকী
|
অতন্দ্র প্রহরী
|
|
নিজের বেড়ে উঠা এবং চাকুরী জীবনের প্রথম বস
08 Dec, 2012
চার বোন দুই ভাই এর মধ্যবিত্ত পরিবারে সবার ছোট সন্তান। সংসারের ছোটরা সবার কাছে থাকে অতি আদরের সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। ব্যবসায়ী বাবার সংসারে ৮জন সদস্য। আমার জন্মের অনেক আগেই দাদা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দাদীর আদর আর স্নেহ পেয়েছিলাম অবুঝ থাকতে তাই এর মর্ম বুঝে উঠতে পারিনি আজো। বন্ধু-বান্ধবের মুখে যখন দাদা-দাদীর আদর আর স্নেহের কথা শুনি নিজেকে তখন খুবি হতভাগা মনে হয়। গ্রাম্য ভাষায় একটা প্রবাদ আছে “আগের হাল যেভাবে যায় পিছনের হালও সেভাবে যায়”। কিন্তু এই প্রবাদটির সত্যতা একমুহুর্তের জন্যেও মিলাতে পারিনি। প্রবাদটি যদি সত্যিই হতো তাহলে আমি আজকে থাকতাম উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বা স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ অথবা সাংবাদিক। না কিছুই হতে পারিনি আমি।স্কুল জীবনে প্রথম শ্রেনীর ছাত্র থাকলেও সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারিনি শেষ পর্যন্ত। এস এস সি তে ৪.৯০পয়েন্ট পেয়ে কৃতিত্বের সাথে পাশ করলেও এইচ এস সি,র পাশটা ছিলো না গৌরবের।
৮ম শ্রেশী থেকেই একটি আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার কারনে আমার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের কিছু কিছু শিক্ষকের সুনজর ছিলো আমার দিকে। কিন্তু এইচ এস সিতে এসে মহান শিক্ষকদের সুনজরের প্রতি আমি সুবিচার করতে পারিনি। এই যন্ত্রনা আমাকে এখনো তুষের আগুনের মতো জ্বালাচ্ছে। পরিবারের সবার ছোট হিসাবে কখনো কিছুর অভাব বোধ করিনি। যখন যা চাইতাম একভাবে না একভাবে তা কেউ না কেউ পুরন করে দিতো। এইচ এস সিতে কাংখিত ফলাফল অর্জন করতে ব্যার্থ হওয়ার কারনে অনার্সে ভর্তির আগ্রহ হারিয়ে সেই বিশ্ববিদায়লয় কলেজেই বি এ শ্রেণীতে ভর্তি দুধের স্বাদ গোলে মিটানোর চেষ্টায় মত্ত হলাম। কিন্তু সেই চেষ্টা বেশী দিন স্থায়ী রাখতে পারলামনা। পড়াশুনাতে ক্রমেই মনোযোগ উঠতে লাগলো। ২০০৫সালের ৩১ডিসেম্বর বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের একটি সম্মেলন থেকে এসে তার কয়েকদিন পরেই আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রজীবন শেষ করলাম। ব্যাক্তি স্বাধীনতা মানুষকে যেমন উন্নত ক্যারিয়ার গঠনে সহায়তা করে তেমনি ভুমিকা রাখে ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে। এ কথাটা অন্য কারো জীবনে না হোক অন্তত আমার জীবনে শতভাগ সত্য হয়েছে। চার বোন দুই ভাই এর সংসারে সবার ছোট হিসাবে যেমন পেয়েছিলাম আদর আর ভালো-বাসা তেমনি পেয়েছিলাম স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা আমার জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দিবে সেটা এই মুহুর্তে তিলে তিলে অনুভব করছি। আমি যখন যা করতে চেয়েছি সবখানেই পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছি অফুরন্ত। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল যেটা এই মুহুর্তে অনুধাবন করি তাহলো টার্গেট বিহীন পড়াশুনা করা। আর তাইত আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র জীবন শেষ করে যোগদান করেছিলাম একটি ব্যাক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালে ল্যাব টেকনেশিয়ান হিসাবে।
ক্লিনিকটি নিজ এলাকায় হওয়ার সুবাদে কর্মক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা পেয়েছি আন্তরিকতার সাথে। বিশেষ করে আমার কর্ম জীবনের প্রথম বসের কথা কোনোদিন ভুলা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন বীর মুক্তিযোব্ধা। বাংলাদেশ মুক্তিযোব্ধা কমান্ড কাউন্সিল ইউনিয়ন শাখার সাবেক কমান্ডার। ১৯৭১সালে যিনি দেশের জন্য জীবন দিতে ঝাপিয়ে পড়েছিলে যুব্ধের ময়দানে। আমাদেরকে এনে দিয়েছিলেন একটি লাল-সবুজের পতাকা। তিনি ব্যাক্তি জীবনে ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। আমাদের দুজনের আদর্শ ছিলো সম্পুর্ন বিপরীত।আদর্শিক দিক থেকে দুজন ছিলাম দুই মেরুর বাসিন্দা। দুজন দুমেরুর মানুষ হলেও কর্মক্ষত্রে দুজনের বুঝাপড়া ছিলো অত্যান্ত মধুর। অনেক সময় আমার কলেজ জীবনের বন্ধুরা আমার অফিসে আসতো । তারা আমার বসের সাথে পরিচিত হয়ে উনার মুক্তিযোব্ধের পরিচয় পেয়ে আমাদেরকে বলতো আপনারা দুজন একসাথে কিভাবে কাজ করেন। আবার একই রকম মন্তব্য পেতাম আমার বসে কোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলে। এই ধরনের মন্তব্যের জবাবে আমরা একটা কথাই বলতাম “আমরা মানুষ আমরা মুসলমান”। আমার বসের আন্তরিক সহযোগিতায় এবং কাজের প্রতি আমার আগ্রহের কারনে ক্লিনিকের বিভিন্ন মিটিং এ ল্যাবরোটরী বিভাগ পেতো বিশেষ ধন্যবাদ।
আমার বস এবং আমার ক্লিনিকের মালিক ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের পুর্বপরিচিত। কর্মস্থলে প্রথম দিন যেয়ে আমি আমার বসকে স্যার বলে সম্ভোধন করতেই উনি আমাকে হুসিয়ার করে বললেন তোমাকে প্রথম এবং শেষ বারের মতো বলছি আমাকে এর পর আর কোনোদিন স্যার ডাকবানা। উনি আমার বাবার বয়সী হলেও তিনি আমাকে ভাই বলে সম্ভোধন করার নির্দেশ দিলেন। দিনে দিনে আমাদের সম্পর্ক হয়ে গেলো আপন ভাইয়ের চেয়েও ঘনিষ্ট। উনার যেকোনো কাজে আমার পরামর্শ সাদরে গ্রহন করতেন যেটা আমার জন্য ছিলেন অত্যান্ত গর্ভের বিষয়। আমিও আমার আপদে বিপদে উনাকে কাছে পেতাম সব সময়। আমাদের কর্মক্ষেত্র এবং তার আশেপাশের কারো অজানাছিলোনা যে আমরা দুজন দুই আদর্শের মানুষ। বলে রাখা দরকার আমি যেখানে কাজ করতাম সেই ক্লিনিকটির মালিক ছিলেন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম(এনডিএফ)এর একজন প্রথম সারির নেতা। দলমত নির্বিশেষে এলাকায় উনার ছিলো এক অসাধারন জনপ্রিয়তা। শিশু বিশেষজ্ঞ হিসাবে গোটা জেলাতে ছিলো উনার সুনাম।উনি একটি বিশেষ আদর্শ্যের সাথে জড়িত থাকার কারনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিক থেকে ষড়যন্ত্র আসতো আর সেই ষড়যন্ত্র মার খেয়ে যেতো উনার চারিত্রিক মাধুর্যের কাছে। আর এই ষড়যন্ত্রের জাল পাতা হতো শুধু মাত্র আদর্শগত কারনে।
আমি ৪বোন ২ভাই এর মাঝে সবার ছোট থাকার কারনে সবার মধ্যমনি হয়ে ছিলাম সবসময় বলতে গেলে এখনো আছি। আমি যতটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে আমার আগে আমার পরিবারে আরো পাঁচ জন সদস্যের আগমন ঘটলেও মা-বাবার আদর সোহাগের কমতি ছিলনা বিন্দুমাত্র। থাকার কথাও না কারন মা-বাবার কাছে সব সন্তানই একরকম। আমি আমার শৈশবে বাবা মার সান্নিধ্য পেয়েছি প্রতি মুহুর্তে। এক মুহুর্তের জন্যেও বাবা মার শুন্যতা অনুভব করিনি। মা-বাবা,ভাই বোনদের অক্লান্ত পরিশ্রমে হাটি হাটি পা পা করে বেড়ে ঊঠলাম। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের গন্ডি পেড়িয়ে পা রাখলাম কর্ম জীবনে।
লেখকঃ মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন