বিদ্যুত সঙ্কট এখন নাগরিক জীবনের অন্যতম এক সমস্যা। বিদ্যুত ছাড়া নাগরিক জীবন যেমন অচল তেমনি শিল্প অচলের কারণে অর্থনীতির চাকায়ও স্থবিরতা দেখা দেয়। বিদ্যুতের অভাবে নাগরিক জীবন, ঘরসংসার, অফিস, ব্যবসা, কৃষি, শিল্প-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সকল কিছুই অচল, অনুৎপাদনমুখি, সৃজনহীন ও স্থবির হয়ে পড়ে। শুধু নাগরিক জীবন নয়, এখন গ্রামীণ জীবনের বিদ্যুৎ বিহীনে অচলাবস্থার প্রভাব পড়েছে। কিন্তু কেন সকল ক্ষেত্রে এই এককেন্দ্রিক নির্ভরতা! উপায় কি আর কোনো নেই?
সৌরবিদ্যুৎ বাংলাদেশে অমিত সম্পভাবনাময় ক্ষেত্র। সৌরশক্তি উৎপাদন ও ব্যবহারের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রধান উপাদান সূর্য এবং সহযোগি আরো পাঁচটি উপাদান যথাক্রমে আলো, বাতাস, রোদ, গাছ-পালা এবং পানির উৎস বাংলাদেশে অফুরান। ঘন ঘন দীর্ঘস্থায়ী অতিষ্টকর লোডশেডিং থেকে জনজীবনকে সহনীয় করতে এবং উৎপাদন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের উপর জোড় দিতে হবে। গৃহস্থালী চাহিদার পাশাপাশি শিল্প-কারখানাও সৌরশক্তি দিয়ে চলতে পারে। আমাদের দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার অর্ধেক মেটানো সম্ভব শুধুমাত্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সৌরশক্তি সংগ্রহের মাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌরবিদ্যুৎ : বিকল্প শক্তি হিসেবে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমেরিকা, ফ্যান্স, জাপান, জার্মানি, ইংল্যান্ড, চীন ও ভারত সহ বিভিন্ন দেশে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার এখন অনুসরনীয় পর্যায়ে। জার্মানিতে সকল উপাদান বা উৎসের প্রাচুর্যতা না থাকা সত্বেও তারা ঠিক করেছে ২০৪০ সালের মধ্যে সমগ্র জার্মানি সৌরশক্তি দ্বারা চালিত হবে। নেপালের ৬০% মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে। যে ৪০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন তারমধ্যে ২০ ভাগ জীবাশ্ম জ্বালানী নির্ভর বিদ্যুৎ সুবিধা আর বাকি ২০ ভাগই সৌর বা জল বিদ্যুৎ সুবিধায় জীবনযাপন করছে। নেপালে সৌরবিদ্যুতের জনপ্রিয়তার কারণ হলো, সেখানকার গ্রামীণ এলাকায় ঘরবাড়িগুলো অনেক দূরে দূরে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের ভুর্তুকি প্রদান আরো একটি অন্যতম কারণ। পরিচ্ছন্ন, নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব হওয়ায় সরকার এতে ৭৫% পর্যন্ত ভুর্তুকি দিয়ে থাকে।
চীনে সৌরবিদ্যুৎ : চীনের বেইজিং বা সাংহাই শহরেরর বাড়িগুলোর ছাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে পানির ট্যাংকের পাশে বিশাল সারি সারি সোলার প্যানেল। সেখানে শীতকালে সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয় ওয়াটার হিটার হিসাবে। এরিজোনা রাজ্যের সোলার প্যানেল প্রস্তুকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষনা করেছে মঙ্গোলিয়ার ওরডোস সিটিতে এরা গড়ে তোলবে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনের চেয়েও বড় এক সোলার ফিল্ড। যেখান থেকে ৩০ লাখ বাড়িতে বিদ্যুত সরবরাহ করা যাবে। চীনের সরকার ও সেবরকারি বাণিজ্য সংস্থা এবং এনজিও একযোগে সৌরবিদ্যুততের ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে। চীন ঘোষণা করেছে ২০১১ সালে ৭০ ভাগ গ্রামে সোলার প্যানেল বসাতে ৫০% সাবসিডি দিবে। অচিরেই চীনে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সৌর প্যানেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে। শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি পিভি সেল এখন তারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করে।
ভারতের মহাপরিকল্পনা : ভারত ২০২২ সাল নাগাদ ২২ হাজার মেঘাওয়াট সৌরবিদ্যুত উৎপাদনের ‘জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল সোলার মিশন’ নামে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। নিলামের মাধ্যমে ৩৭টি কোম্পানিকে সৌরবিদ্যুত উৎপাদনের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে। ২০১৩ সালের মধ্যে ২০১৩ মেঘাওয়াট সৌরবিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। যা ২০১৭ সালের ১০ হাজার মেঘাওয়াট লক্ষ্যমাত্রায় উন্নীত হবে। ভারতের বিদ্যুত বিশেষজ্ঞদের অভিমত ১ হাজার মেঘাওয়াট বিদ্যুত দিয়ে ১০ লাখ ঘরবাড়িতে বিদ্যুত চাহিদা মেটানো সম্ভব।
ভারতে জাতীয় গ্রিডে সৌরবিদ্যুৎ : সৌরশক্তি নিয়ে ভারতের জাতীয় গ্রিড তৈরি করা হচ্ছে। এরসাথে প্রতিটি রাজ্যের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে জুড়ে দেয়া হবে। ভারতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারিভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। সেদেশের মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছে, বছরে এক কোটি সৌর বাল্ব প্রায় ৫০ কোটি লিটার কেরোসিন তেল বাঁচাতে পারে। এরফলে সরকারের ২ হাজার কোটি রুপি ভুর্তুকি বেঁচে যাবে। পরিবেশও রক্ষা পাবে।
হোয়াইট হাউজে সৌরবিদ্যুৎ : আমেরিকায় হোয়াইট হাউসের আবাসিক এলাকায় স্থাপন করা হচ্ছে সোলার প্যানেল সিস্টেম। এ প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতের সাহায্যে প্রেসিডেন্ট ওবামার পরিবারের জন্য পানি গরম করার ব্যবস্থা করা হবে। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ অন্যান্য কাজে লাগানো হবে।
সোলারে ওবামার ঋণ ঘোষণা : যুক্তরাষ্ট্রে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের জন্য দুটি কোম্পানীকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। জানা গেছে, অ্যাবেনোগা কোম্পানি অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে এক হাজার ৯০০ একর জায়গায় ২৮০ মেঘাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৭০ হাজার বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ উপযোগী একটি সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে।
বাংলাদেশ সৌরবিদ্যুৎ : সারা দেশে ৩ লাখের বেশি গ্রাহক সোলার ব্যবহার করছে। যারমধ্যে ২ লাখ ৪০ হাজার প্যানেলই স্থাপন করেছে গ্রামীণ শক্তি। দেশের প্রায় সবকটি জেলায় সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ছড়িয়ে দিয়েছে গ্রামীণ শক্তিসহ ১৫ সংস্থা। এই কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ৪৬৫টি উপজেলায় ৪০ হাজারেরও বেশি গ্রাম এবং ১৬টি দ্বীপাঞ্চলে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ সৌরবিদ্যুতের সুবিধাভোগী। যেখানে প্রতিদিন ৪৪ মেঘাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে। ২০১১ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ গ্রাহককে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে গ্রামীণ শক্তি। বর্তমানে ১০ ওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌর পদ্ধতি স্থাপনে সাড়ে ৯ হাজার টাকা খরচ পড়ে (গ্রামীণ শক্তির হিসাবে)। ১৩০ ওয়াটের হিসাবে খরচ হয় ৬৮ হাজার টাকা। গ্রামীণ শক্তি ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের অর্ধেক লোকের কাছে সৌরবিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে লক্ষ্য ঠিক করেছে। পাশাপাশি তারা ৫০ হাজার বায়োগ্যাস এবং ১ কোটি উন্নত চুলা বসানোর টার্গেট নিয়েছে গ্রামীণ শক্তি।
গবেষণা প্রতিবেদন : ঢাকাবিশ্ব্িযবদালয়ের নবায়নযোগ্য জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র তাদের এক গবেষনা প্রতিবেদনে জানায়, দেশের মোট আয়তনের ১ ভাগ জায়গা ব্যবহার করে ৪০ হাজার মেঘাওয়াট সৌরবিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। আরো ২ হাজার মেঘাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হতে পারে শুধু মাত্র বায়ুশক্তির ব্যবহার করে।
বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে সৌর বিদ্যুৎ : বাংলাদেশে ব্যবহার উপযোগী এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎকেন্দ্রেও মতো গ্রিড সংযোগ দেয়ার মতো এমন একটি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছে আমাদের দেশীয় গবেষকরা। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ইলেক্ট্রনিকস এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের একদল গবেষক সৌরবিদুৎকে জাতীয়গ্রিডে যুক্ত করার ‘রুফ টপ গ্রিড কানেন্টেড সোলার ফটোভল্টেইক সিস্টেম’ নামে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। উদ্ভাবকেরা ১ দশমিক ১ কিলোওয়াট ক্ষমতার এই সৌরবিদুৎ ব্যবস্থাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তরিত শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে স্থাপন করেন।
শহরে সৌরবিদ্যুত : গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি বিভাগীয় ও জেলা শহরে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। বিদ্যুত ঘাটতি পূরণে সরকারের গৃহীত নীতি, গ্রাহকদের আগ্রহ, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভবাবনা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ বিবেচনায় এই প্রকল্প অত্যন্ত লাভজনক, দীর্ঘমেয়াদি ও ফরপ্রসূ হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে ছাওয়া রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো। সরকার এখনি আইন করে বাধ্যতামূলকভাবে সকল প্রকার বিল বোর্ডে সোলার প্যানেল সংযোজন এবং এসব জ্বালানো সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া দরকার।
সরকারের নীতি : সরকারের নীতিতে বলা হয়েছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি গ্রামাঞ্চল ও উপশহর এবং শহর এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া। জ্বালানি সংশ্লিষ্ট আমদানি পণ্যের উৎস থেকে শুল্ক ও কর তুলে দেয়া কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সোলার প্রযুক্তি জনপ্রিয় করণে সকল ব্যাংক ও তার শাখাগুলোতে সৌরবিদ্যুত প্যানেল স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ছাদে এবং বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করেছে।
সৌরশক্তিতে ঋণের সুদ হার ১০ শতাংশ : বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলার জারির মাধ্যমে সব ব্যাংকের নির্বাহীদের জানিয়েছে- এনজিও ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য এ খাতে ঋণ হোলসেলিংয়ের মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারবে। সোলার, বায়োগ্যাস, বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট প্রভৃতি ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ নেয়া যাবে।
দেশের বৃহত্তম সৌর প্যানেল : চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ১০০ কিলোয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের বৃহত্তম সোলার মাইক্রো গ্রিড পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুত সরবরাহ শুরু হয়েছে। এই পাম্প থেকে প্রাপ্ত সৌর ডিসি কারেন্টকে এসি কারেন্টে রূপান্তর করে পল্লী বিদ্যুতের মতো পিলারের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ৪০০ পরিবার বিদ্যুত সুবিধা পাবে। জাপানি প্রযুক্তিতে নির্মিত এই প্যানেলে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠান পূরবী গ্রিন এনার্জি লি.-এর সূত্রে জানা গেছে, এখানে ডিজেল চালিত জেনারেটরের মাধ্যমে যে বিদ্যুত ব্যবহৃত হচ্ছিল তার প্রতি ইউনিট খরচ ৬৫ টাকা। এখন সোলার শক্তিতে প্রতি ইউনিট ৩০ টাকায় বিদ্যুত সরবরাহ সম্ভব হবে।
সৌরবিদুৎ প্যানেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান : সাভারের আশুলিয়ার দুর্গাপুরে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল প্রস্তুতকারী কারখানা স্থাপিত হয়েছে এবং তারা উৎপাদনে যাচ্ছে। দেশে বিদ্যুত প্যানেল উৎপাদন হলে এর ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা এবং আমদানী ব্যয় কমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
প্রথম সৌরবিদ্যুত চালিত সেচপাম্প : সাভারের ভাকুর্তা বোরো প্রকল্পে দেশে প্রথম সৌরবিদ্যুত চালিত সেচপাম্পটি স্থাপন করেছে রহিম আফরোজ। নওগাঁর সাপাহার উপজেলার আইহাই ইউনিয়নের আশড়ন্দ গ্রামে চালু করা হয়েছে সোলার ইরিগেশন পাম্প। ইডকলের সহায়তায় এই পাম্পটি স্থাপন করেছে গ্রামীণ শক্তি। অনেকেই নওগাঁর এই অঞ্চলটিকে বরেন্দ্র মরুভ’মি বলে থাকেন। পাম্পটিতে ব্যবহৃত হয়েছে ১৭৫ ওয়াট ধারণ ক্ষমতার ৬৪টি সৌর প্যানেল। কৃষকরা কৃষি সমবায় সমিতির মাধ্যমে এই পাম্পটি স্থাপন করে। এই সেচ প্রকল্প দিয়ে ১০০ বিঘা জমি চাষাবাদ করা সম্ভব। সেচ ক্ষেত্রে সৌর প্যানেল খুবই উপযোগি ক্ষেত্র। বিদ্যুতের অপেক্ষায় না থেকে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার করে সেচকার্য ব্যবস্থাপনায় জাতীয় গ্রিডে অনেক বিদ্যু সাশ্রয় হবে। সেচ মৌসুমে অযাচিত লোডশেডিংয়ের হাত থেকে শহরের মানুষ রক্ষা পাবে।
মহানগরের ছাদে ৭০০ মেঘাওয়াট সৌরবিদ্যুত : সেনা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল মোহাম্মদ আলীর এক গবেষণা রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়, ঢাকা মহানগরের ভবনগুলোর ছাদে সৌরবিদ্যুত প্যানেল বসিয়ে অন্তত ৭০০ মেঘাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। ভবন মালিকেরা ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করে ২৫ বছর পর্যন্ত মাসিক পাঁচ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। যা আগে বিদ্যুতের বিল হিসেবে দিতে হতো। ঢাকা শহরে ৩ লাখ ইউনিট বাড়ি থাকলেও সৌর প্যানেল স্থাপনের মতো রয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার বাড়ি। এখান থেকে মোট ১ হাজার ৪৬৫ মেঘাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। পদ্ধতিগত লসের পরও কমপক্ষে ৭০০ মেঘাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান।
কৃষিক্ষেত্রে সৌর বিদ্যুত : বোরো মৌসুমে দেশে প্রায় বিশ লাখ একর চাষযোগ্য জমিতে ১৬ লাখ ৩০ হাজার সেচ পাম্প ব্যবহৃত হয়। এরমধ্যে ১৬ লাখ একর জমি চাষে ব্যবহার হয় ১০ লাখ ৮০ হাজার বিদ্যুতচালিত সেচ পাম্প। বাকি ১১ লাখ ৫৮ হাজার সেচ পাম্প ব্যবহৃত হয় ডিজেল চালিত। সারা দেশে বিদ্যুত ও ডিজেল চালিত সেচপাম্পগুলোকে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা সম্ভব হলে বছরে ৭৬০ মেঘাওয়াট বিদ্যুত ও ৮০ কোটি লিটার ডিজেল সাশ্রয় হবে। যার ফলে ডিজেল ও বিদ্যুত ক্ষেত্রে সরকারের ৮৫৩ কোটি টাকা ভুর্তুকি বেঁচে যাবে। এই ভুর্তুকির টাকাটা পরপর ৩ থেকে চার বছর সৌরবিদ্যুতের পেছনে ভুর্তুকি হিসেবে ব্যয় করলে সরকার পরবর্তী ২০ বছরের জন্য ভুর্তুকি প্রদান থেকে বেঁচে যাবে। পাশাপাশি জাতীয় বিদ্যুৎ তো সাশ্রয় হবেই। বাড়বে সৌরবিদ্যুতের জনপ্রিয়তা। আর তখন সরকার এই ভুর্তুকির টাকা বিদ্যুত ব্যবস্থতার সম্প্রসারণে ভবিষ্যতমুখি বিনিয়োগ করতে পারবে।
বিনিয়োগ : সৌরবিদ্যুত ব্যবস্থায় প্রচুর দেশি বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। উদ্যোক্তাদের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলভিত্তিক যে সৌরবিদ্যুত কার্যক্রম চলছে তাতে বছরে এই খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি। ৬০% বিনিয়োগ হয় সৌর প্যানেলে যার সবটাই আমদানি নির্ভর। ২৫% বিনিয়োগ হয় ব্যাটারিতে আর ১৫% আনুষঙ্গিক খুচরা যন্ত্রাংশে। ব্যাটারি ও খুচরা যন্ত্রাংশ দেশেই তৈরি হয়। প্যানেল এখন দেশে তৈরি হচ্ছে। দেশীয় চাহিদা পূরণ করতে পারলে পুরো বিনিয়োটাই দেশীয় নির্ভরতায় প্রতিষ্ঠিত হবে। সাশ্রয় হবে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা।
কর্মসংস্থান : সৌরবিদ্যুত কার্যক্রমে দেশে প্রায় ৫ হাজার প্রকৌশলী সহ ২০ হাজারের বেশি লোক কাজ করে। ২০১৫ সালের মধ্যে এখাতে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে বলে উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা।
সৌরবিদ্যুতের সুবিধা সমূহ :
- সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার সহজ, নিরাপদ এবং কম খরচে দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারযোগ্য।
- একবার বিনিয়োগ করলেই কমপক্ষে ১০ বছর নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়া যাবে (যাকে বলা হয় সোলার হোম সিস্টেম)
- সৌরবিদ্যুৎ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। লোডশেডিং নেই। বিল দেয়ার ঝামেলা নেই।
- সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে গ্রামীণ জনপদে হাটবাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজের সময় বৃদ্ধির ফলে আয় রোজগার বেড়েছে।
- সৌরবিদ্যুৎ যেকোনো স্থানে স্থাপন করা যায়। সাধারণ বিদ্যুতের মতোই ব্যবহার করা যায়- কম্পিউটার টেলিভিশন, রেডিও, ক্যাসেট প্লেয়ার, ভিসিপি, ভিসিআর, ছোট বৈদ্যুতিক পাখা চালানো সম্ভব। মোবাইল ফোনের ব্যাটারি চার্জ করা য্য়া।
- সোলার প্যানেল কার্যকর থাকতে পারে টানা ২৫ বছর পর্যন্ত। তবে ব্যাটারি নষ্ট হতে পারে, যা পরিবর্তনযোগ্য।
- আকাশে মেঘ থাকুক বা টানা বৃষ্টি থাকুন কোনো সমস্যা নেই। দিনের স্বাভাবিক আলো থেকেই সোলারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। তবে সূর্যের আলোর তুলনায় তা কম হবে।
- গ্রাহকদের কিস্তিতে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল দেয়া হয়।
- সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের মধ্যে রয়েছে- বাজারের ছোট বড় দোকানদার, দর্জি, হাস-মুরগি-গরুর খামার, মাছের হ্যাচারি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ব্যাংক, বীমা, বাসা-বাড়ি প্রভৃতি।
- বাংলাদেশে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে গড়ে ৩৪০ দিন সুর্যের আলো থাকে। ২৫ দিন আলো না থাকলেও দিনের যে আলো বিদ্যমান থাকে তাতেই প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
- সৌরবিদ্যুত স্বল্প মূল্যে স্থাপন করা যায়, বিক্রয়োত্তর সেবা ও প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা পাওয়া যায়।
- কেরোসিনের প্রায় সমান খরচে গ্রামীণ জনগণ সৌর প্লান্টের মালিক হতে পারেন।
- সৌরবিদ্যুত উৎপাদনে কোনো কাচামালের দরকার হয়না এবং এটি নবায়নযোগ্য।
সোলার নিয়ে আমাদের ভাবনা : সৌর শক্তি পৃথিবীর প্রাচীন শক্তির অন্যতম উৎস। গতানুগতিক শক্তির বাইরে বিকল্প শক্তির উৎস হিসেবে প্রথমেই আসে সৌরবিদ্যুতের নাম। গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুতের নামে যে ভোগান্তির খাম্বা পুঁতে রাখা হয়েছে তারচেয়ে সৌরবিদ্যুতের প্রতি জনগণকে আগ্রহী করে তুললে সে বিদ্যুত শহরে শিল্প জীবনের সাথে যোগ করলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে। চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কম মূল্যে সোলার প্যানেল বৃত্তি হিসেবে দেয়া যেতে পারে। গ্রামীণ জনপদে সৌরবিদ্যুৎ সম্পর্কিত তথ্য প্রচরণা জরুরি। সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন, প্রয়োগ ক্ষেত্র, ব্যবহার, যন্ত্রপাতি ও সার্ভিসিং, ঋণ সহায়তা, কৃষি ও সেচের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার, কিস্তিতে ক্রয় সুবিধাসহ যাবতীয় সুবিধাবলীর বিষয়ে সরকারী বেসরকারিভাবে প্রচারণার মাধ্যমে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। গ্রামীণ বাড়িঘর, ছোট-বড় ব্যবসা, হাট-বাজার, হাস-মুরগী বা গরু-ছাগলের খামার, মৎস্য খামার, হ্যাচারি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের পরিবর্তে সৌরবিদুতের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিল করা সম্ভব হবে। সৌরবিদ্যুতের জন্য একবার বিনিয়োগ করুন এবং ২৫ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করুন’- এই শ্লোগানকে জনপ্রিয় কর তোলতে হবে।
একই উপায়ে শহর ও উপশহরের বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত এমনকি শিল্প কারখানাতে সৌরবিদুৎ প্লান্ট স্থাপনে ভুর্তুকি নিশ্চিত করলে এর জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার বাড়বে। কয়েক দশক ধরে কৃষি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক ফলপ্রসু ভূমিকা রেখেছে। সেচ কাজে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে কৃষি ক্ষেত্রে আশাতীত সুফল পাওয়া যাবে। বিদ্যুত সঙ্কটের দীর্ঘস্থায়ী ও ভবিষ্যতমুখি সমাধানে সৌরবিদ্যুত হতে পারে একমাত্র দাওয়াই। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য সরকার এবং বেসরকারি সংগঠণগুলোকে টার্গেটভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি (কমপক্ষে ২০ বছরের) মহাপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেসাথে বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুতের জন্য পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠণ খুব জরুরি। সবার আগে করণীয় - গ্রামীণ এলাকায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার ব্যাপকহারে সম্প্রসারণ সম্ভব হলে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের চাপ কমে আসবে। গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুতের ব্যবহার যে পরিমাণ কমবে তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এই বাড়তি বিদ্যুৎ দেশের শিল্প বাণিজ্যে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। তাই জাতীয় স্বার্থে দেশের অর্থনীতি দ্রুততর বিকাশের জন্য গ্রামীণ জনপদে সৌরবিদ্যুতের ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন