সাপ্তাহিকী
|
শরীফ নজমুল
|
|
নীতির সাথে নেতাদের আপোষ আর অধিকারের সাথে নিত্য আপোষ আমাদের
01 Dec, 2012
“রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই” কিম্বা “পলিটিক্স ইজ দি হাইয়েস্ট আর্ট অফ কম্প্রোমাইজ” এ ধরনের কথা আমরা শুনে থাকি। যখন ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ বলে শরীয়া আইনের কথা আর বিএনপি প্রধান নির্বাচন ঘনিয়ে আসবার প্রাক্কালে যান ভারত সফরে, তখন কে কার সাথে আপোষ করে? মনে পড়ে গেল বেশী কথা বলে ইতিমধ্যে খ্যাতিমান হওয়া অর্থমন্ত্রী আবুল মাল সাহেবের একটি কথা, “পলিটিক্স ইজ দি হাইয়েস্ট আর্ট অফ কম্প্রোমাইজ” যা তিনি কয়েক বছর আগে বাজেটোত্তর বক্তৃতায় বলেছিলেন। যখন ধর্মপন্থী দল জামাত আওয়ামী লীগের সাথে গাটছড়া বেধে আন্দোলন করে কি জামাত ধর্ম নিরপেক্ষতার সাথে আপোষ করে নাকি আওয়ামী লীগ মৌলবাদের সাথে আপোষ করে?
নীতি বাদ দিয়ে রাজা হওয়াই এখনকার রাজনীতির মুলকথা। তত্বাবধায়কের জন্য দিনের পর দিন হরতাল আবার ক্ষমতায় বসে সে তত্বাবধায়ক বাতিল, স্বৈরাচারকে নিয়ে দুইজ়োটের টানাটানি, আওয়ামী লীগ-জামাতের মিলিত আন্দোলন, লগি বইঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, হলমার্ক-ডেস্টিনির জন্ম, শেয়ার বাজার লুটপাট, দূর্ণীতিতে দেশকে চ্যাম্পিয়ন বানানো, এক-এগারোর উদ্ভব এগুলি সবই হচ্ছে রাজনীতির দূর্বৃত্তায়ন ও কম্প্রোমাইজের কিছু ছিটে-ফোটা নমুনা মাত্র। রাজনীতিবিদগন আপোষহীন ক্ষমতায় যাবার জন্য, যার ফলে শর্তহীন ভাবে আপোষ করছেন নীতির সাথে, দ্বায়িত্বের সাথে। কালোবিড়াল মারবার কথা বলে মাঠ গরম করছেন অথচ তাদের থলে থেকেই বেরুচ্ছে কালোবিড়াল। তারা কালোবিড়ালের সাথে আপোষ করেই কাজ করেন। সরকারী দ্বায়িত্ব আছি, ঘুষ-দুর্ণীতির সাথে আপোষ করব এটাই যেন স্বাভাবিক, ক্ষমতায় আছি, সন্ত্রাস-চাদাবাজির সাথে আপোষ করব সেটাই স্বাভাবিক। নীতির প্রশ্নে রাজনীতির এই আপোষ, সাধারন মানুষের জীবন কে ঠেলে দেয় সীমাহীন দুর্ভোগের দিকে। অধিকার যে বুঝে পাবার জিনিষ সেটাই আমরা ভাবতে পারিনা বরং পদে পদে আপোষ করে বেচে থাকে সাধারন মানুষ।
আবুল কালাম একজন কৃষক। এক বছরের জন্যে তিন বিঘা লীজ নিয়েছেন মোট ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে। ত্রিশ হাজার টাকা খরচায় আলু চাষ করে ফসল বিক্রি করে পেয়েছেন পচিশ হাজার টাকা। এরপর বার হাজার টাকা খরচ করে ইরি চাষ করে ধান বিক্রি করেছেন কুড়ি হাজার টাকায়। আর একটি ফসল তথা আমন চাষ শুধু বাকি। আমনে সাধারনতঃ খরচ কম হয়, তার হিসেবে সাত থেকে আট হাজার টাকায় আমন ধান চাষ করে ধানের বর্তমান দাম থাকলে সর্বোচ্চ পনের হাজার টাকা পেতে পারেন। তার মানে ফসল আবাদের খরচ আর আয় বাদ দিলে থাকে দশ হাজার টাকা। জমি লীজের টাকা বিবেচনায় নিলে ক্ষতি দাঁড়ায় কুড়ি হাজার টাকা। আর নিজের সারা বছরের পরিশ্রম আর ভোগান্তি তো ফ্রী। সারের অতিরিক্ত মুল্য, সময় মত সার না পাওয়া, নিম্নমানের বীজ, সেচের জন্য বিদ্যুত না পাওয়া কত কি।
এভাবেই আবুল কালামের মত লাখো প্রান্তিক চাষী সুখ, স্বচ্ছলতা, লাভ সব কিছুর সাথে আপোষ (কম্প্রোমাইজ) করে পেটে ভাতে খেটে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। এক বছর কম্প্রোমাইজ করছে সামনের বছরের আশায়। পরের বছর হয়তো অন্য কোনো সমস্যায় ফসল মার খাচ্ছে। এই কম্প্রোমাইজ শেষ করে নিজের অধিকার বুঝে পাওয়া তার আর হয় না।
দেশের অসংখ্য শিক্ষিত বেকার যুবক একটি চাকরির জন্য জুতোর তলা ক্ষয় করে চলেছেন। তাদের হিসেব কে রাখে? কেউ হয়তোবা অসুস্থ মা-বাবার চিকিতসা কিম্বা ছোট ভাই-বোনের পড়াশোনা অথবা বিবাহ যোগ্যা বোনের বিবাহের প্রয়োজনের মত আশু দরকারকে কম্প্রোমাইজ করছেন। কেউ হয়তোবা আজীবন লালিত নীতির সাথে কম্প্রোমাইজ করে সন্ত্রাশ অথবা দুই নাম্বারী কাজে জড়িয়ে যাচ্ছেন। নিকটজনের সান্নিধ্য কম্প্রোমাইজ করে দালালের হাতে সর্বস্ব তুলে দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। যেখানে কেউ হয়তো কাজ পাচ্ছেন, কেউ জেলে পচে মরছেন, কেউবা কফিনের বাক্সে চড়ে স্থল সীমানা কিম্বা নৌকায় চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে জীবন দিচ্ছেন। আর যারা সবকিছুর পর বেচে যাচ্ছেন তারাই দিনের পর দিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে দেশে মুল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। আমাদের এই ভিআইপি রা নিকটজন দের সান্নিধ্য কম্প্রোমাইজ করছেন, বিদেশে আমাদের মিশন গুলোর অবজ্ঞা-অবহেলা, দেশে ফিরে এয়ারপোর্টে কর্মকর্তাদের দুর্ব্যাবহারের সাথে কম্প্রোমাইজ করছেন। তারপর হয়তো রাস্তায় নেমে সন্ত্রাসী/ছিনতাইকারীর সাথে কম্প্রমাইজ করে দেশে আনা সম্পদ টুকু তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতির রিপোর্ট আমরা পড়ি পত্রিকায়, সচিত্র প্রতিবেদন দেখি চ্যানেলের কল্যাণে। কিন্ত কতজন আমরা উপলব্ধি করি নিম্ন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ গুলো কি কম্প্রোমাইজ করে যাচ্ছে? কোনো পরিবার হয়তো সঞ্চয় ভাঙ্গাচ্ছেন, কেউ বাচ্চাকে স্কুল থেকে টেনে কাজে লাগিয়ে দিচ্ছেন, কেউ হয়তো আগে সপ্তাহে একদিন মাছ-মাংস খেতেন এখন মাসে একদিন খাচ্ছেন। কত পরিবার রাতে উপোস থেকে ঘুমাতে যায়, কে তার খবর রাখে? একজন ছা-পোষা নীরিহ মানুষকে যখন সন্ত্রাসীরা ফোন করে চাঁদা দাবী করছে, তিনি জীবন বাচানোর স্বার্থে তার সাথে কম্প্রোমাইজ করছেন। কারন তাদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায় মেয়েদের টিজ করা হচ্ছে, ভিকারুন্নেসার মত নামকরা প্রতিষ্ঠানের পরিমলদের জন্ম হচ্ছে, সোনার ছেলেরা ধর্ষনের সেঞ্চুরী করছে। দু-এক জন হয়তো প্রতিবাদ করে কিম্বা অন্যভাবে সংবাদ মাধ্যমে আসছেন কিন্ত হাজারো বোন এগুলির সাথে কম্প্রোমাইজ করে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই লিস্ট আর বাড়িয়ে লাভ কি? আসলে সাধারন মানুষের বেঁচে থাকাটায় এক ধরনের কম্প্রোমাইজ। কিন্তু এর মধে কোন আর্ট নেই। রয়েছে শুধু মাত্র বেচে থাকবার তাগিদ। রয়েছে ঘুনে ধরা পচা সমাজ ব্যবস্থার প্রতি অসহায় আক্রোশ আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে নিভৃতে চোখের পানি ফেলা।
রাজনীতিবিদ গন “কম্প্রোমাইজ” মুক্ত হতে পারলে আমাদের জীবন অন্য রকম হতে পারত। সাধারন মানুষ যেন ন্যূনতম অধিকার নিয়ে বাচতে পারে সেটা নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব নেন বলেই তো রাজনীতিবিদ গন আলাদা। তাঁরা জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেন।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান তৈরী, দ্রব্যমুল্য নিয়ন্ত্রন এসব তো রাষ্ট্রের কাজ। কিন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে তারা জনগনের কথা ভুলে গিয়ে ক্ষমতা পাকা করার জন্য কম্প্রোমাইজ করেন কালো টাকার সাথে, স্বৈরাচারের সাথে, দুর্ণীতির সাথে।
শিক্ষার হার বৃদ্ধি, তথ্য-প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি আর উন্নত দেশ সমুহের নাগরিক অধিকার যদি সাধারন জনগণকে সচেতন করতে পারে, জনগণ যদি নিজের অধিকার বুঝে নেবার জন্য আপোষহীন হতে পারেন তাহলে কিন্ত রাজনীতিবিদ দের পরিবর্তন না হয়ে উপায় থাকবে না। আমরা যে রকম আমাদের নেতারাও সেরকম, তাদের উত্থান তো আমাদের মাঝ থেকেই। আমরা ভোটের আগে নেতার দশ টাকা খায়, নেতা নির্বাচিত হবার পর আমাদের পেটে পাড়া দিয়ে হাজার টাকা বের করে নিয়ে যায়। দুর্ণীতিবাজ লোক কে আমরা সংবর্ধনা দেই কারণ টাকা আছে আর সৎ হবার কারণে গরীব যে তাকে টিটকারি করি। যদি আমরা দুর্ণীতি কে ধিক্কার দিতে পারি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারি, নিজেরা যে কাজ করি সেখানে নীতির প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থাকি, তবে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবর্তন হবে, আমরা হয়ত নীতির প্রশ্নে আপোষহীন নেতৃত্ব তৈরী করতে পারব। সাধারন মানুষ অধিকারের সাথে আপোষ নয়, অধিকার নিয়ে বাচতে শিখবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন