১৯৯০ সাল, শীতের সময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে অধ্যয়নকালীন সময়, অনার্স শেষ করে মাষ্টার্স-এর ক্লাস পুরোদমে এগিয়ে চলছে, এমন সময়, প্রয়াত শিক্ষক ডঃ আসাদ-উজ-জামান এবং ডঃ মোহাম্মদ মহব্বত খান জানালেন এক সুখবর, যে খবরে ক্লাসের সকল সতীর্থ বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে এক দারুণ চাঞ্চল্য দেখা দিলো, সকলেই উচ্ছসিত, উতফুল্লিত হলেন।কারণ এই বারও যথারীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লোক প্রশাসন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষা সফরের আওতায় সার্ক দেশ সমূহ ভ্রমণের অনুমোদন প্রদান করেছেন।যথারীতি বিকেলের মধ্যেই বিভাগীয় চেয়ারম্যানের (তখন সম্ভবত মরহুম প্রফেসর মোফাজ্জালুল হক চেয়ারম্যানের দায়িত্ত্বে ছিলেন) দপ্তর থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে সুখবরটি পাকাপোক্ত করে দেওয়া হলো।
পরদিন প্রফেসর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, ডঃ জেরিনা রেহমান খান, ডঃ মোহাম্মদ মোহাব্বত খান, ডঃ কামরুল আলম খান সহ আমাদের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বিভাগীয় সেমিনার রুমে জরুরী সভায় বসলেন, বিস্তারিত আলাপের পর সার্ক সফরের যাবতীয় প্ল্যান-প্রোগ্রাম-এর প্রাথমিক প্রস্তুতির কথা জানিয়ে দেওয়া হলো।সব কিছু ঠিক-ঠাক মতো চলছিলো, কিন্তু বাধ সাধলো আমাদের জন্য নির্ধারিত বাজেটের অপ্রতুলতা নিয়ে।সিদ্ধান্ত হলো স্যূভেনির থেকে বিজ্ঞাপন বাবত সফরের বাকী টাকা সংগ্রহ করে আমাদের জন্য অনুমোদিত সার্ক শিক্ষা সফর সম্পন্ন করা হবে।
সার্ক শিক্ষা সফর উপলক্ষ্যে নির্ধারিত সকল কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে আমরা সকল ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকবৃন্দ সহ বাক্স-পেটরা সবাভিব্যবহারে তখনকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উপস্থিত হয়ে যাই। বিমান বন্দরের সকল আনুষ্টানিকতা সেরে আমাদের বহনকারি ডিসি-১০ আকশে উড়ে, তখন আমাদের সকলের চোখে-মুখে রাজ্যের অনেক উৎসুখ নতুন দেশ দেখার, নতুন পরিবেশে ভ্রমণ করার,শিক্ষা সফর সফল করতে আমাদের সকল ক্লান্তি যেন নিমিশেই আকাশে মিলিয়ে গেলো অজানা-অচেনা এক অনন্দে।একই সাথে ব্যথিত এই কারণে, দীর্ঘদিনের সাথী অনেক বন্ধুরা নানাবিধ কারণে আমাদের এই সফরের সঙ্গী হতে পারেনাই, তাদের অনুপস্থিতি আমরা সব সময়ই অনুভব করেছি।
কোলকাতা দমদম এয়ার পোর্টে আমাদের নিয়ে ডিসি-১০ যখন অবতরণ করে, তখন আমাদের কারো ধারণাই ছিলোনা, সেখানকার টেম্পারেচার এতো অধিক ও প্রখর রৌদ্র তাপ হতে পারে, ঢাকাস্থ ভারতীয় কালচারাল সেন্টার এর সাথে আলোচনাকালে কখনো আমাদেরকে আবহাওয়ার এই আস্বাভাবিক তারতম্যের কথা ব্রীফ করেছিলেন বলে আমরা কেউই মনে করতে পারিনাই।আশ্চর্য হয়ে যাই, কী করে এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উনারা এড়িয়ে গেলেন।ঢাকার চেয়েও অধিক গরমে আমরা সকলেই জবু-তবু অবস্থা। যাই হউক বিমানবন্দরের সকল আনুষ্টানিকতা সেরে আমরা কোলকাতায় হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।বিকেল বেলা আমরা ৩৪ জন ছাত্র-ছাত্রী সহ শিক্ষকবৃন্দ ভিক্টোরিয়া পার্কে ভ্রমণ শেষে সর্বশেষ আমেনিয়া হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে কোলকাতার অনেক স্মৃতি-বিজড়িত জায়গা ও দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করে পায়ে হেটে হোটেলে আসার পথে প্রয়াত পরিচালক, নির্দেশক, নাট্যকার, লেখক সত্যজিত রায়ের সাথে একান্ত ব্যক্তিগত সাক্ষাতের দূর্লভ কিছু স্মৃতি আজো অম্লান হয়ে আছে।উল্লেখ্য আমরা যখন একমাসব্যপী সফর শেষ করে ফিরতি যাত্রায় কোলকাতা রিটার্ণ করি, ঠিক সেদিনই সত্যজিত রায় ইহলোক ত্যাগ করেন।ঐ সময় সত্যজিত রায়কে বেশ রোগে কাবু দেখে গিয়েছিলাম।তারপরেও বাংলাদেশের ও এর জনগণের ভূয়সী প্রশংসা করতে ভুলেননি।
পরদিন আমরা দিল্লীর উদ্দেশ্যে গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস যোগে আমরা রওয়ানা হই। ভারতে আসার আগে গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেসের এতো নাম-দাম শুনেছিলাম, এর ভ্রমণের মজাটাই আলাদা, এর টিকেট প্রাপ্তি অনেক দূর্লভ-যদিনা আপনি মাস তিনেক আগে থেকে ঠিকেট কনফার্ম না করে থাকেন, হাওড়া ষ্টেশনে এসে আমার শোনা সেই সব কাহিনী সত্য প্রমাণিত হতে দেখে আরো অভিভূত হলাম।আমাদের জন্য নির্ধারিত কোচের দরজার সামনে আমাদের ৩৪ জন ছাত্র-ছাত্রীদের নাম সহ শিক্ষকবৃন্দের সকলের নাম-দাম সহ টিকেট নাম্বার প্রিন্ট করে বিজ্ঞপ্তি লাগানো, ট্রেনের টিকেট চেকার সেই লিষ্ট ধরে-ধরে আমাদেরকে গীতাঞ্জলীতে উঠতে দিলেন।গীতাঞ্জলীর রাজকীয় আতিথেয়তায় আমরা সকলেই মুগ্ধ।সারা রাতের দীর্ঘ ভ্রমণের সময় গীতাঞ্জলীর ষ্টুয়ার্ট আর ষ্টাফদের উষ্ণ আথিথেয়তা সত্যি মনে রাখার মতো, খাবারের মান ছিলো উন্নত মানের, সাথে চা,কফি,আইসক্রিম, আর যারা নিরামিষভোজী তাদের জন্যও সমান ব্যবস্থা, এমনকি মদ্যপায়ীদের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা এখনো আমাদের মানষ পটে ভেসে আছে সমানভাবে।আমাদের মধ্যে তখন মোটা মামুন নামে পরিচিত আমার বন্ধু মণিরুজ্জামান মামুন, আলমগীর কবির খান(যে পাতলা খান নামেই ব্যপক পরিচিত ছিলো, একটু আধটু এতে অভ্যস্থ ছিলো সৌখিন বশে)রাতব্যপী আলো-আধারির খেলাচ্ছলে মিষ্টি-মধুর গাণ আর ষ্টুয়ার্টদের কমিক্স সত্যি উপভোগ্য এবং মনোমুগ্ধকর ছিলো।সকালবেলা গীতাঞ্জলী ষ্টাফদের পরিবেশনায় সকালের নাস্তা আমাদের সারারাতের ভ্রমণের ক্লান্তিকে ভরিয়ে দিয়েছিলো।
দিল্লী রেলওয়ে ষ্টেশনে আনুমানিক সকাল দশটারও কিছুক্ষণ আগে আমরা পৌছি।সেখান থেকে আমাদের জন্য নির্ধারিত বাস নিয়ে চলে দিল্লীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ইয়থ হোষ্টেলে।অল্প বিশ্রামের পর গোসল শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি দিল্লী শহরটি ঘুরে দেখার জন্য।বন্ধু-বান্ধবীরা বিভিন্ন গ্রুপে-গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমরা সিদ্ধান্ত নেই সন্ধ্যা নাগাদ সকলেই এক জায়গায় এসে জড়ো হবো আর সেটা হলো দিল্লীর পালিকা বাজার।যাবার আগে চলে ছবি তোলার পালা, ইয়থ হোষ্টেলের রং-বেরং এর সতেজ ফুল অনেকের কাছে বেশ আকর্ষণীয় ছিলো, বিশেষ করে বন্ধু গায়ক আব্দুল্লা আল মামুন, খালেদ মোর্শেদ মডি, আশরাফুজ্জামান মীরণ এবং জিন্নাহ ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যা অনেকের কাছে ছিলো বেশ উপভোগ্য। কেউ কেউ বিশেষ করে আমাদের মেয়ে বন্ধুরা, যাদের নাম না নিলেই নয়, তাদের মধ্যে লিপি, লতা, কণা, মিথু, শিল্পী,দিপীকা, রুমু, বউ বাজার ভ্রমণে শপিং-এ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।বউ বাজার হয়ে আরো দু-এক জায়গা ঘুরে আমরা সন্ধ্যা নাগাদ পালিকা বাজারে এসে জড়ো হই।সেখানে সন্ধ্যাবেলা ভীষণ ভীড়।মনে হয় যেন কোন মেলা বসেছে।মাটির নীচে শপিং সেন্টারের ঢুকতে সিকিউরিটি চেক করে সকলকে প্রবেশ করতে হয়। সবচাইতে বড় আশ্চর্য হয়ে যাই, তখনকার সময়ে প্রতিটি দোকানে ম্যনেজার থেকে শুরু করে সেলস পার্সন সবাই মহিলা, স্মার্টভাবে প্রতিটি দোকানে ক্রেতাদের সাথে দেন-দরবার করে চলেছে, পালিকা বাজারের এক কোণে কোলকাতার মতোই পাওয়া গেলো বাংলাদেশী টাকা লেন-দেনের কালোবাজারীদের, কোলকাতা সহ দিল্লীর বউ বাজার, পালিকা বাজার প্রভৃতি স্থানেই বাংলাদেশী ১০০টাকার তখন খুব কদর, যা আমাদের কাছে বেশ অবাকই লাগে।কিছুক্ষণ ক্রেতা-বিক্রেতা সেজে লক্ষ্য করে দেখলাম কালোবাজারে বাংলাদেশের ১০০টাকা তখন খুব দামী এবং দেদারছে বিক্রী হচ্ছে।দিল্লীস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের সাথে সাক্ষাত কালে এই বিষয়টি কর্মকর্তাদের নজরে আনলে উনারা বেশ তাচ্ছিল্যের সাথে এড়িয়ে যান, ঐ সময় বাংলাদেশে এরশাদ সরকার ক্ষমতাসীন।
দিল্লীতে সফরের দ্বিতীয় দিন প্রথমে আমরা গেলাম স্বরাজ ভবনে, যেখানে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতি-বিজড়িত এমনকি ইন্ধিরা গান্ধী নিহত হওয়ার স্থানটিকে বিশেষব্যবস্থায় দর্শকদের জন্য অক্ষত অবস্থায় রাখার দৃশ্য দেখে চোখে জল এসে যায়। ইন্ধিরা স্মৃতি জাদুগর ঘুরে ঘুরে দেখার এক পর্যায়ে এসে চোখ আটকে যায়, দেখলাম ইন্ধিরার সাথে হাসি-মুখে করমর্দন অবস্থায় আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি।বুকটা গর্বে ভরে উঠেছিলো।
স্বরাজ ভবন ভ্রমণ শেষে আমরা চলে গেলাম ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবন দেখতে সকলেই, সেখান থেকে গান্ধীজী সহ রাজীব গান্ধীর সমাধি দেখলাম।সেখান থেকে গেলাম জওহর লাল নেহরু বাস ভবন, নেতাজীর স্মৃতি বিজড়িত বাস ভবন ভ্রমণ শেষে আমরা দিল্লীর অনেক নানা দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করলাম, রাতে লাইট এন্ড সাউন্ড এর মাধ্যমে এক বিশেষ কায়দায় অতীত ঐতিহ্য পরিস্ফুটনের দৃশ্যাবলী অবলোকনের জন্য স্থান রিজার্ভ করে চলে আসলাম।সেখান থেকে আমরা সকলেই গেলাম বাহাই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থান, দিল্লীর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরবর্তীতে অবস্থিত অষ্ট্রেলিয়ার হারবার এর ন্যায় স্থাপিত নান্দনিক শিল্প-শৈলীতে ভরপুর বাহাইদের এই ধর্মীয় উপাসনালয়ে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করলাম, আমাদের মুসলমান বন্ধু-বান্ধবীরা বুঝে না বুঝে বাহাইদের মতো ধর্মীয়
উপাসনায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে, প্রার্থনা শেষে তারা যখন বেরিয়ে আসে, তখন আমরা এ নিয়ে অনেক হাসা-হাসি করি, যে তোমরা কী নান্দনিকতায় অভিভূত হয়ে ধর্ম চেইঞ্জ করে ফেলেছ? (চলবে)
আগামী কিস্তিতে দিল্লী-আগ্রা-তাজমহল-রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গ-
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন