জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি অংশ নিচ্ছেন চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে নির্বাচিত ছাত্রশিবিরের প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন জেলায় তাদের দাঁড়িপাল্লার পক্ষে ভোট চাইতে দেখা গেছে। অথচ এসব নেতারা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আগে ‘লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি’র বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। করেছিলেন শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংরক্ষণের অঙ্গীকার। ভোটের প্রচারে ছাত্র সংসদ প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হয়। এতে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদকসহ অধিকাংশ পদে জয় পান ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেলের প্রার্থীরা। ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম জামায়াতের মনোনীত একাধিক প্রার্থীর নির্বাচনী জনসভায় অংশ নিয়েছেন।
গত ২১ নভেম্বর সকালে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপে দেশ। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী আহতের পাশাপাশি আবাসিক হল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভয়ে শিক্ষার্থীরা শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলসংলগ্ন কর্মচারী ভবনে অবস্থান নেন। অথচ সে সময় সাদিক কায়েম ছিলেন যশোর ও খুলনায় জামায়াতের পৃথক ছাত্র গণজমায়েতে।
ডুমুরিয়ার শাহপুর আন্দুলিয়া ফুটবল মাঠে উপজেলা জামায়াতের অনুষ্ঠানে সাদিক কায়েম ছাড়াও বক্তৃতা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) জিএস মাজহারুল ইসলাম। সাদিক কায়েম বলেন, ‘ইনসাফের প্রতীক কী? দাঁড়িপাল্লা। তারুণ্যের প্রথম ভোট ইনসাফের পক্ষে হোক।’ একইদিন যশোরের ঝিকরগাছায় ছাত্র গণজমায়েতে সাদিক কায়েম ছাড়াও ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক আরমান হোসেন বক্তৃতা করেন।
২২ নভেম্বর আবার তিন দফা ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। সে দিন প্রথমে একদিনের জন্য ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত দেয় ঢাবি কর্তৃপক্ষ। পরে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় ১৫ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতিতে ২২ নভেম্বর সাদিক কায়েম ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াত প্রার্থীর প্রচারে। নবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে ছাত্র-যুব সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সাদিক কায়েম বলেন, ‘দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিয়ে সবাইকে বৈষম্যহীন, ন্যায় ও ইনসাফের নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে আসতে হবে।’
সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) ভিপি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) ভিপি ইব্রাহিম হোসেন রনি। তারা দুজনই ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত।
জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক আদর্শিক। একে লেজুরবৃত্তি বলা ঠিক হবে না। সবাই জানে আমরা একটি দলের পক্ষ থেকেই নির্বাচিত। এখন তাদের কার্যক্রমে যেতে পারব না, এটা কেমন? আমি শিবির ও ছাত্র সংসদ– দুটির কাজই করছি। ছাত্র সংগঠন হিসেবে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। যেমন ছাত্রদলের কমিটির ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত আসে, শিবির তেমন নয়। ইব্রাহিম হোসেন রনি, চাকসুর ভিপি
গত ২৯ নভেম্বর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ জামায়াতের ছাত্র ও যুব সমাবেশে বক্তব্য দেন সাদিক কায়েম। উপজেলা জামায়াতের আমির ফয়জুর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেট-৪ আসনের জামায়াতের প্রার্থী জয়নাল আবেদীন। ডাকসুর পরিবহনবিষয়ক সম্পাদক আসিফ আব্দুল্লাহ ছিলেন বিশেষ অতিথি।
গত ৪ ডিসেম্বর বিকেলে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে দাঁড়িপাল্লায় ভোট চান তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগর কমিটির সাবেক সভাপতি মোস্তফা ফয়সাল পারভেজ। নন্দীগ্রাম মনসুর হোসেন ডিগ্রি কলেজ মাঠে পারভেজের উদ্যোগে আয়োজিত ছাত্র ও যুব সমাবেশে ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম, চাকসুর ভিপি ইব্রাহিম হোসেন ও রাকসুর ভিপি মোস্তাকুর রহমান দাঁড়িপাল্লায় ভোট চান।
গতকাল শুক্রবারও (৫ ডিসেম্বর) একটি নির্বাচনী জনসভায় দাঁড়িপাল্লায় ভোট চেয়েছেন সাদিক কায়েম। সুনামগঞ্জের ছাতক শহরের ট্রাফিক পয়েন্টে আয়োজিত ছাত্র-নাগরিক সমাবেশে সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারবাজার) আসনের জামায়াতের প্রার্থী আব্দুস সালাম আল মাদানির জন্য ভোট চান তিনি। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ডাকসু কার্যনির্বাহী সদস্য শাহিনুর রহমান ও সর্বমিত্র চাকমা।

চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে ছাত্রশিবির। জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক নেই বলে সব সময় দাবি করে সংগঠনটি। নির্বাচনী প্রচারকে ছাত্র সংসদের শিবির নেতারা আদর্শিক অবস্থান বর্ণনা করছেন। চাকসুর ভিপি ইব্রাহিম হোসেন রনি স্ট্রিমকে বলেন, ‘শুধু জামায়াত নয়, ন্যায়, ইনসাফ ও দুর্নীতির বিপক্ষে যেসব প্রার্থী আছেন, তারা আমন্ত্রণ জানালে আমরা হাজির হব।’
লেজুরবৃত্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক আদর্শিক। একে লেজুরবৃত্তি বলা ঠিক হবে না। সবাই জানে আমরা একটি দলের পক্ষ থেকেই নির্বাচিত। এখন তাদের কার্যক্রমে যেতে পারব না, এটা কেমন? আমি শিবির ও ছাত্র সংসদ– দুটির কাজই করছি। ছাত্র সংগঠন হিসেবে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। যেমন ছাত্রদলের কমিটির ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত আসে, শিবির তেমন নয়।’
জাকসুর জিএস মাজহারুল ইসলাম বলেন, জামায়াত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় ছাত্রশিবিরকে প্রভাবিত করে না। শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার যে কারো নির্বাচনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। সে জায়গা থেকেই আমি যাদের যোগ্য মনে করছি, তাদের প্রচারে যাচ্ছি। এ তালিকায় জামায়াত রয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েমের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি।
শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতারণা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হাসানুজ্জামান বলেন, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট উইং চেয়েছিল কেন? যাতে কোনো দলীয় রাজনীতির প্রভাব ক্যাম্পাসে না থাকে। আসন্ন নির্বাচনে জাকসু প্রতিনিধিদের যোগ দেওয়াকে ইতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই। ভুলে গেলে চলবে না– রাজনীতির চেয়ে তাদের এখন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি পরিচয় বড়।
ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু তৌহিদ মো. সিয়াম জাকসুর জিএস পদপ্রার্থী ছিলেন। তিনি স্ট্রিমকে বলেন, চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে নির্বাচিতদের দেশের প্রতি দায় আছে, এটা সত্য। পাশাপাশি এটাও সত্য, ক্যাম্পাস পুরো দেশের রাজনীতির সামগ্রিক চিত্রকে দেখায়। নির্দিষ্ট দলের পারপার্স সার্ভ করতে সারাদেশে ঘুরে বেড়ানো তাদের উচিত নয়। যা দেখা যাচ্ছে, জামায়াতের এক্সটেনশন হিসেবে কাজ করছে ছাত্রশিবির।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময়ই বোঝা গিয়েছিল শিবিরের নির্বাচিতদের জামায়াত ব্যবহার করবে। এজন্যই তাঁরা এই নির্বাচনে অর্থ ঢেলেছিল। এখন জনপ্রিয়তা বাড়াতে তাদের ব্যবহার করছে জামায়াত। তারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রাজনীতি না রেখে বাইরে চলে গেল, এটি লেজুরবৃত্তির আরেক ধাপ।
অন্তর্বর্তী সরকারের পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক লেখক ও গবেষক রাখাল রাহা ফেসবুকে ডাকসু নেতাদের জামায়াতের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার সমালোচনা করেছেন। সাদিক কায়েমের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেন, তুমি (সাদিক কায়েম) এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ৪০ হাজার ছেলেমেয়ের নির্বাচিত প্রতিনিধি। অভিভাবক হিসেবে আমরা চেয়েছি তুমি সেই পুরোনো সুবিধাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চা থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত রাখবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দুর্বৃত্ত রাজনীতির মহড়াখানা বা আঁতুড়ঘর করবে না। কিন্তু সেটা না করে ঠিক সাবেকী কায়দায় তুমি যে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক চর্চা ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনছো, তা নতুন ছাত্রলীগ হিসেবে ক্যাম্পাসে শিবিরকে প্রতিষ্ঠা করবে এবং যার ওপর ভর করে জামায়াত হয়ে উঠবে আওয়ামী লীগের আরেক বর্বরতম সংস্করণ।
ছাত্রদল মনোনীত ডাকসুর পরাজিত জিএস প্রার্থী ও কবি জসিম উদ্দীন হল ছাত্রদলের আহ্বায়ক শেখ তানভীর বারী হামিম ফেসবুকে লিখেছেন, যাদের দায়িত্ব ছিল ঢাবি শিক্ষার্থীদের কল্যাণে দিনরাত পরিশ্রম করা, তারা আজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে হেলিকপ্টারে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে জনসভায় ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি আরও লেখেন, আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই আপনারা প্রতারকদের চিনছেন, তাদের ব্যবহার দেখছেন এবং আপনাদের মূল্যবান জবাব বিবেচনাধীন রাখছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রকিবুল হাসান স্ট্রিমকে বলেন, শিবির বরাবরই শিক্ষার্থীদের কাছে লেজুড়বৃত্তিক ঘরানার বাইরের রাজনৈতিক সংগঠন পরিচয় দেয়। জামায়াতের প্রচারে ভিপি জাহিদের অংশগ্রহণ সত্যিই দৃষ্টিকটূ। এটি হয়তো বেইআইনি নয়। তবে আমি অনৈতিক মনে করি।