পাঁচ দফা দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ সমমনা ৮ দল এবার আসন সমঝোতা নিয়ে নানা হিসাবনিকাশ কষছে। কোন দল কতো আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হতে পারবে, কার কোথায় অবস্থান ভালো এসব নিয়ে চলছে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। চলছে আসনভিত্তিক জরিপ। অপরদিকে পাঁচ দাবিতে ৭টি বিভাগীয় শহরে সপ্তাহব্যাপী সমাবেশ কর্মসূচি শেষ করেছে এসব দল। এসব সমাবেশে আট দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সারা দেশে নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে রাজপথের এই কর্মসূচিকে ভোটের রিহার্সেল হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, মূলত ৭টি বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে তৃণমূলের রাজনীতিতে ৮ দলের সাংগঠনিক শক্তি সামর্থ্যরে জানান দেয়ার পাশাপাশি নির্বাচনী ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন তারা।
জুলাই সনদের আইনি স্বীকৃতির জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, ফ্যাসিবাদের দোসর ১৪ দলের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণসহ পাঁচ দফা দাবিতে গত জুলাই থেকে রাজপথের কর্মসূচিতে সরব রয়েছে এই ৮ দল। গত ১১ই নভেম্বর রাজধানীতে সমাবেশের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ৮ দলের শীর্ষ নেতারা এক মঞ্চে ওঠেন। পরবর্তীতে ৮ দলের লিয়াজোঁ কমিটির কয়েক দফা বৈঠকে চূড়ান্ত হয় বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি। শনিবার সিলেটে বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে এই কর্মসূচি শেষ হয়।
আগামীকাল সোমবার ৮ দলের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকের পর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানা গেছে। লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সমমনাদের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা আছে। এক আসনে এক প্রার্থীর ব্যাপারে সবাই একমত। কে কোন আসনে জিততে পারবেন, কোথায় কার রাজনৈতিক অবস্থান কেমন এই বিষয়গুলো আট দলের বিবেচনায় আছে। এ ছাড়া আট দলের শীর্ষ নেতাদের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। জামায়াত কতো আসন ছাড় দেবে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. হামিদ আযাদ বলেন, আমাদের তো কোনো নিজস্ব আসন নেই যে ছাড় দিতে হবে।
৩০০ আসনে আমাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা আছেন। আট দলের প্রয়োজনে যেকোনো প্রার্থী সরে দাঁড়াবেন। এজন্য কোথাও সড়ক অবরোধ জ¦ালাও পোড়াও ভাঙচুর হবে না। আমাদের লক্ষ্য থাকবে জয়। যেখানে যার জয়ের পাল্লা ভারী মনে হবে সেখানে ৮ দলের তরফে সেই প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হবে। অন্য রাজনৈতিক দলের মতো অমুক দলকে এত আসন ছেড়ে দেয়া-না দেয়ার কিছু নেই বলে জানান ড. হামিদ আযাদ।
প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব প্রার্থী তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ৮ দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে সেটা উপস্থাপন করা হবে। শীর্ষ নেতারা যাচাই-বাছাই এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তালিকা চূড়ান্ত করবেন। তিনি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য কেবল প্রার্থী হওয়া নয়-বিজয়। আট দলের বিজয়ের সম্ভাব্য প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেয়া হবে বলে জানান মাওলানা জালাল।
৫ই আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায়ের পর থেকেই জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান, ইসলামী আন্দোলনের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই) ইসলামী দলগুলোকে এক কাতারে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেন। তাদের উদ্যোগে গত ১৬ মাসে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক ও আলাপ-আলোচনা হয়। তবে সব দল না এলেও জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে আছে এমন ৮টি ইসলামী সমমনা দলের মধ্যে যুগপৎ অবস্থান তৈরি হয়েছে। দলগুলো হচ্ছেÑ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে ইতিমধ্যে ৮ দলের তরফে আসনভিত্তিক জরিপ চালানো হয়েছে। এই জরিপের ভিত্তিতে কোন দলের কোন নেতাকে কোন আসনে প্রার্থী দেয়া হবে তা চূড়ান্ত করা হবে। এ ছাড়া সম্ভাব্য এই নির্বাচনী সমঝোতায় আরও কয়েকটি দলকে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এডভোকেট এহসানুল মাহবুব যোবায়ের বলেন, আসন সমঝোতার বিষয়টি শীর্ষ নেতাদের সক্রিয় বিবেচনায় আছে। এ ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতিও হয়েছে। আট দলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এমনটি দাবি করে তিনি বলেন, আসন সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে রাজি হয়ে আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকটি দল যোগ দিতে পারে।
এদিকে কট্টর জামায়াতবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক কিছু দল এখনো ৮ দলের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। তারা জামায়াতকে ‘মওদুদীবাদী’ বলে আখ্যায়িত করে। তবে ধর্মভিত্তিক কিছু কর্মসূচি ছাড়া ওই দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কম। তারপরও তাদের এক কাতারে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে করে ইসলামপন্থিদের সব ভোট এক বাক্সে পড়ে।
তবে ৮ দলের একাধিক সূত্র বলছে, কোন দল কতো আসনে নির্বাচনে আগ্রহী বা বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সেটা মাঠ জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হচ্ছে। সূত্র মতে, বৃহত্তর স্বার্থে সব দলেই সর্বোচ্চ ছাড়ের মানসিকতা আছে। ইসলামী দলগুলো সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়ে আসুক এটাই তাদের টার্গেট। জানা গেছে, ৮ দলের শীর্ষ নেতাদের পাস করিয়ে আনার বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতারও আভাস দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন। এই দলের মধ্যম সারির এক নেতা বলেন, আমরা এবং জামায়াতে ইসলামী বড় দল। এই দুই দলের রাজনৈতিক অবস্থান প্রায় সমান। তবে জামায়াত যেহেতু আগে পার্লামেন্টে ছিল; সেক্ষেত্রে তারা একটু বেশি পেতে পারে।