অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দিয়েছে। সরকার এখানে দরদ দেখিয়েছে কিন্তু কোনো দায় দেখায়নি। সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির মাধ্যমে সরকার সব রাজনৈতিক দলকে আপাতদৃষ্টিতে খুশি করলেও বাস্তবে দেশের বৃহত্তর জনগণকে ফাঁকি দিয়েছে। এই আদেশের মাধ্যমে মৌলিক সংস্কারের দিকে যাওয়া যাবে না।
শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন দলটির নেতারা। এ সময় নেতারা বলেন, বাহাত্তরের ফ্যাসিবাদী কাঠামো দূর করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই আদেশের মধ্যে দিয়ে আমরা বাহাত্তরের সংবিধানের পথেই হাঁটছি। এক হাসিনা যাওয়ার পর আরেক হাসিনা আসার প্রস্তুতি চলছে।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছিল। সেখানে কিন্তু নোট অব ডিসেন্ট ছিল। জুলাই সনদটা কীভাবে বাস্তবায়নের মতো আইনি ভিত্তির প্রয়োজন আমরা কিন্তু এই দাবিটা তুলেছিলাম। পরে রাজনৈতিক অঙ্গনে সব জায়গায় আলোচনাটা শুরু হয়। সবাই এটা বুঝে যে, আসলে একটা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া প্রয়োজন বা আইনি ভিত্তি প্রয়োজন। সরকার আইনি ভিত্তি দিয়েছে। সরকার এখানে দরদ দেখিয়েছে কিন্তু সরকার কোনো দায় দেখায়নি। অর্থাৎ আপনার যখন কোথাও কম্পেশন থাকবে আপনার রেসপন্সিবিলিটি নিতে হবে। সরকার এখানে তরকারির বাটি থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক চামচ, এক চামচ করে ভাগ করে দিয়েছে। বিএনপিকে এক চামচ দিয়েছে, জামায়াতকে এক চামচ দিয়েছে কিন্তু জনগণের প্লেট- ওটা খালি হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আমরা কী চেয়েছিলাম? এই গণঅভ্যুত্থানের পরে ৭২-এর যে ফ্যাসিবাদী সংবিধান, সেই সাংবিধানিক কাঠামোকে পরিবর্তন করে জনগণের একটা কাঠামো নিয়ে আসতে। যাতে নতুন করে কেউ হাসিনার মতো আবিষ্কৃত না হয়ে জনগণের ওপর গুলি চালাতে না পারে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, এক হাসিনা যাওয়ার পরে আরেক হাসিনা আসার জন্য আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, আমরা জুলাই ঘোষণাপত্র থেকে শিক্ষা নিয়ে সেখানে কিন্তু সাইন করতে চাইনি। আমরা বলেছিলাম আপনি যে আদেশটা দেবেন, এই আদেশের ড্রাফটটা আমাদেরকে আগে দেখাতে হবে। কিন্তু সরকার এই ড্রাফটটা না দেখিয়ে নিজস্ব ক্ষমতা বলে একটা আদেশ জারি করেছে। যিনি ড্রাফটটা করেছেন, আমি নাম তার উচ্চারণ করব না। তার মনে যদি বাংলাদেশের জনগণ থাকত, এই ধরনের ড্রাফট উনি তৈরি করতেন না। এ ধরনের আদেশ তিনি তৈরি করতেন না।
তিনি বলেন, এটা আদেশ হয়েছে কিন্তু একটা জনবিরোধী আদেশ হয়েছে। উনার মাথায় ছিল বিএনপির প্রেসক্রিপশন। কারা এই আদেশটা দিয়েছে, এটা বাংলাদেশের সব মানুষ জানে। উনি গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এই পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানকে কীভাবে মুজিবীয় সংবিধানের ভেতরে ঢোকানো যায় এই প্রচেষ্টাই করে যাচ্ছেন। উনি আমাদের আইন উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। উনি যদি জনগণকে মাথায় রাখতেন এই ধরনের আদেশের ড্রাফটিংটা করতেন না।
মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, তারা (বিএনপি) সংস্কার কমিশনে গিয়ে গুন্ডামি করল। সেখানে যখন সবাই, সব দল একটা বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছে, সেখানে তারা ভেটো দিল। বলল, আমরা এটা মানব না। খেলায় আছি, কিন্তু তালগাছটা আমার। সংস্কার কমিশন আসলে বিপদে পড়েছে। তারপরও দেশের স্বার্থে ওই দলের নোট অব ডিসেন্ট রেখে আমরা সামনের দিকে এগিয়েছি।
পাটওয়ারী বলেন, বর্তমান যে পরিস্থিতিতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হয়েছে, তারা বলেছিল একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। আমরা বলেছি এটার আদেশ দিতে হবে। সরকার আদেশ দিয়েছে, এটা আমরা পেয়েছি। আমরা জানিয়েছিলাম যে ড. ইউনূসকে দিতে হবে, সাহাবুদ্দিন এটা দিতে পারবে না। আমরা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি পেয়েছি কিন্তু নৈতিক ভিত্তির জায়গাটা আমরা পাইনি। এই জুলাই সনদের শুরুতে সরকার গণঅভ্যুত্থান শব্দটা উচ্চারণ করেছে। সার্বভৌম অভিপ্রায়ের যে প্রকাশ সেটা জনগণ থেকে নিয়েছে। কিন্তু সেই সার্বভৌম অভিপ্রায়ের যে সাইন, যার মাধ্যমে দিয়েছে, উনি কিন্তু জনগণের ওপর কয়েক দিন আগে গুলি চালিয়েছিলেন। সরকার এখানে আইনি ভিত্তি দিল। কিন্তু এই জুলাই সনদকে সে অপবিত্র করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদ আদেশ বাস্তবায়নে যে আদেশ জারি করা হয়েছে সেখানে অনেক বিষয়ই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। যার ফলে জুলাই সনদ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। সংস্কারের পয়েন্টগুলো এক না করে আলাদাভাবে রাখা হয়েছে।
আখতার বলেন, গণভোটের যে বিষয়টি স্পষ্ট হলেও গণভোট কি নোট অব ডিসেন্টসহ হবে নাকি নোট অব ডিসেন্ট ছাড়াই হবে সে বিষয়টি স্পষ্ট না। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নোট অব ডিসেন্টসহ নাকি ডিসেন্ট ছাড়া সে বিষয়ে দ্রুত সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে। সনদে যেসব বিষয় অস্পষ্ট রয়েছে সেগুলো স্পষ্ট হলেই স্বাক্ষর করবে এনসিপি।
অনুষ্ঠানে এনসিপির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।