এই বিষয়টা বুঝতে হলে প্রথমে আমাদেরকে দুইটা বিষয়কে আলাদা করতে হবেঃ গণভোটের টাইমিং এবং গণভোট ইটসেলফ।
জামায়াত নির্বাচনের আগে গণভোট চাইছিল, আর বিএনপি নির্বাচনের দিনেই গণভোট চাইছিল। বিএনপির কথা রাখা হইছে।
নির্বাচনের আগে গণভোট হলে জামায়াত মনে করেছিল এটা তাদের কিছু এডভান্টেজ দিবে। যেহেতু সংস্কারের জন্য গণভোট হচ্ছে এবং বিএনপি সংস্কার নিয়ে কথা বলতে চায় না, তাই গণভোটের ক্যাম্পেইন জামায়াতের জন্য একটা মোমেন্টাম এনে দিত। আমিও ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলাম, নির্বাচনের আগে গণভোট হোক। তাতে সংস্কার, জুলাইয়ের আকাঙ্খা নির্বাচনী প্রচারণা ও প্রতিশ্রুতির মূল বিষয়বস্তু হয়ে উঠত এবং রাজনৈতিক দলগুলো এগুলো মানতে কমবেশি বাধ্য হত।
গণভোটের টাইমিংয়ের ইস্যুতে বিএনপি জিতছে। জামায়াত হারছে।
কিন্তু গণভোট ইটসেলফ?
বিএনপি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে রেখেছিল। যেমন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন, দুদক, পিএসসি ইত্যাদি জায়গায় নিয়োগের সময় চেক এন্ড ব্যালেন্স, উচ্চকক্ষে পিআর তারা চায়নি। ইউনুস সরকার বিএনপির এই ডিসেন্টিং বিষয়গুলোকে গণভোটের সরাসরি প্রশ্ন বানিয়ে দিয়েছেন (ক এবং খ নং প্রশ্নে)। তারা মনে করেছেন যে, এই বিষয়গুলো নন নেগোসিয়েশিয়েবল, এগুলোকে একটা দলের ইচ্ছার ওপরে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এজন্য এগুলোকে জনগণের অভিপ্রায়ের ওপরে ছেড়ে দিয়েছেন।
জামায়াত ও এনসিপি বিএনপির এইসব নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে আপত্তি তুলেছিল এবং এগুলো নিয়ে তারা বেশ সরব ছিল। তাদের কথা শুনতে সরকার বাধ্য হয়েছে।
এখন বিএনপি পড়ছে বেকায়দায়। তারা যদি একটু বুদ্ধিমান হয় তাহলে বুঝতে পারার কথা যে, তারা "না" ভোটের পক্ষে ক্যাম্পেইন করতে পারবে না। এই ভুল করলে, দেশের জনগণ মনে করবে বিএনপি আওয়ামী লীগ ও ইন্ডিয়ার সাথে আঁতাত করে গণভোটের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু গণভোট সংস্কারের জন্য হচ্ছে, বিএনপিকে একটা সংস্কারবিরোধী দল হিসেবে মানুষ দেখা শুরু করবে।
বিএনপি অলরেডি গণভোট যেন না হয় তার জন্য ক্যাম্পেইন করেছে। তারা "না" ক্যাম্পেইন করেছে, একবার বলেছে সংবিধানে গণভোট নাই, গণভোট দিয়ে সংবিধান সংস্কার করা যাবে না, আরেকবার বলেছে গণভোট থেকে আলু, পেঁয়াজের ইস্যু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে যারা গণভোট চাচ্ছে বিএনপিপন্থী এক্টিভিস্ট ফাহাম তাদেরকে "বোকাচোদা" পর্যন্তও বলেছে।
বিএনপির নোট অব ডিসেন্টের অনেক বিষয় গণভোটের অংশও হয়ে গেছে। ফলে বিএনপি গণভোটকে কখনো মনেপ্রাণে আর ওউন করতে পারবে না। এদিকে বিএনপি সংস্কার নিয়ে কথাও বলতে চায় না। এই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি গণভোটের সাথে সাইকোলজিক্যালী মোটেও এলাইন্ড না। বিএনপি এখন আর "হ্যাঁ" ভোটের পক্ষে ক্যাম্পেইন করতে পারবে না।
তারমানে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি গণভোট নিয়ে "না"ও বলতে পারবে না, "হ্যাঁ"ও বলতে পারবে না। গণভোট নিয়ে বিএনপির কোন রাজনীতি আর নাই। নিজেদের খোঁড়া গর্তে বিএনপি নিজেই পড়েছে।
জামায়াত এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ গণভোটের পক্ষে সাইকোলজিক্যালি ফুলি এলাইন্ড। অন্যতম বড় দল হিসেবে একমাত্র জামায়াতই "হ্যাঁ" ভোটের জন্য ক্যাম্পেইন করবে। যেহেতু সংস্কারের জন্য গণভোট হচ্ছে, জামায়াত যদি নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বড়সড় ও ইফেক্টিভ ক্যাম্পেইন চালাইতে পারে, তাহলে "সংস্কার", "গণভোট" এবং "জামায়াত" সমার্থক (সিনোনিমাস) হয়ে যাবে। ফলে "হ্যাঁ" ভোটের জন্য ক্যাম্পেইন জামায়াতের নির্বাচনী ভোটে কনভার্ট হবে। আপনি শিওর থাকেন, জামায়াত এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে।
জামায়াত জানে তারা বিশাল একটা দান জিতছে। কিন্তু মনে রাখবেন, জামায়াত রাজনীতির পুরানা খেলোয়ার। তারা এখন এমন এক ভাব ধরবে যেন ইউনুস সরকার বিএনপির আবদারকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, জামায়াতের দাবীগুলো মানছে না।
এতে যেটা হবে, জামায়াত বিরোধী কিছু সুশীল ও মিডিয়া এই ভেবে ঠান্ডা থাকবে যে, ইউনুস জামায়াতের কথা পাত্তা না দিয়ে বিএনপির কথা শুনতেছেন। অন্যদিকে জামায়াতকে খুশি রাখার জন্য ইউনুস সরকারকেও জামায়াতকে কিছু কনসেশন দিতে হবে, সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচন রিলেটেড নিয়োগগুলো যেন পুরোপুরি বিএনপির দিকে চলে না যায়, যেন একটা ব্যালেন্স থাকে, যেন একটা ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন হয়। এজন্য জামায়াত নির্বাচনের আগে গণভোটের সেই দাবি থেকে এক চুলও নড়বে না। এটা তাদের একটা ইফেক্টিভ বার্গেইনিং টুল।
আসল ইস্যু গণভোটের টাইমিং না, আসল বিষয় হচ্ছে গণভোট ইটসেলফ। এই গণভোটকে কোন দল ক্যাপচার করতে পারতেছে। যে দল গণভোটকে ক্যাপচার করতে পারবে, নির্বাচনী মাঠেও সেই দল এগিয়ে থাকবে।
আপনি কাকে এগিয়ে রাখবেন?