কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে শেখ হাসিনাকে নানাভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে—‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’, ‘বহিষ্কৃত প্রধানমন্ত্রী’ বা ‘তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী’। এক হিসেবে এই ধরনের বর্ণনা ভুল নয়। যদিও ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নির্বাচনগুলো ছিল সাজানো এবং এগুলো নিয়ে প্রচুর সমালোচনাও হয়েছে। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে অবশ্য হাসিনা জয়ী হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মূল প্রশ্নটা হলো—সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে শেখ হাসিনাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলাটা কি যুক্তিসংগত? সাংবাদিক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা, সাংবাদিকতা বিষয়ে অধ্যয়ন এবং বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাংবাদিকতা পড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে আমার বিশ্বাস—এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের সতর্কভাবে এর নৈতিক পর্যবেক্ষণগুলো বিবেচনা করতে হবে।
২০২৩ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ দিয়ে শুরু করা যাক। ওই নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘বাই, মিস্টার : হোয়াই (মোস্ট) জার্নালিস্টস টার্নড এগেইন্সট কার্টেসি টাইটেলস’। এই নিবন্ধে ব্যাখ্যা করে বোঝানো হয়েছে, কেন বহু সংবাদ প্রতিষ্ঠানে মিস্টার, মিস এবং এ ধরনের অন্য আনুষ্ঠানিক টাইটেলগুলো পরিত্যাগ করা হয়েছে। এর কারণ হলো, এগুলোর ব্যবহার হলে সংবাদের টোন বিকৃত হতে পারে, অযাচিত শ্রদ্ধা দেখানো হতে পারে এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। নিবন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে—“একজন ঘৃণ্য ব্যক্তি কি আদৌ বদান্যতা পাওয়ার উপযুক্ত হতে পারে? ভাবুন, যদি হিটলারকে ‘মিস্টার হিটলার’ বলা হয়...।” সংবাদকক্ষের প্রায় ঐকমত্যে এ ব্যাপারে উত্তর এসেছে—‘না।’ যদিও হিটলার ১৯৩৩ সালে বৈধভাবেই জার্মানির চ্যান্সেলর মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তার সরকার দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে একটা সর্বাত্মকবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদরা তাকে ‘জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর’ বলেন না। তারা বলেন ‘নাৎসি স্বৈরশাসক’, ‘জার্মান একনায়ক’, অথবা শুধু ‘হিটলার’। কারণটা হলো নৈতিক স্বচ্ছতা। ‘সাবেক চ্যান্সেলর’-এর মতো পদ ব্যবহার করা হলে অপরাধকে স্বাভাবিকীকরণ করা হবে।
হাসিনাকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করা কি যুক্তিসংগত? আমার উত্তর হলো, ‘না।’ যারা হাসিনার কর্মকাণ্ড—হত্যা, গুম ও রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের ভেতর দিয়ে গেছেন, তাদের কাছে হয়তো এই তুলনা গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে অপরাধের মাত্রা নয়, তুলনা করা হচ্ছে সাংবাদিকতার ফ্রেমিং নিয়ে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভে প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। আরো শত শত মানুষ হাত-পা হারিয়েছে, অন্ধ হয়ে গেছে, অথবা হাসিনার আমলে নিখোঁজ হয়েছে। আন্দোলনের পর হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে।
এই প্রেক্ষাপটে তাকে শুধু ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বলার অর্থ হলো তার শাসনামলের নৈতিক ও আইনি অপরাধের দিকটিকে অগ্রাহ্য করা। মনে হতে পারে, সাধারণ গণতান্ত্রিকভাবে এখানে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেই সময়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছিল, ব্যাপক হত্যাকাণ্ড হয়েছে এবং সাংবিধানিক শৃঙ্খলা পুরো ভেঙে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়ে হাসিনা সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ নিয়েছিলেন, যে শপথ তিনি বারবার ভঙ্গ করেছেন। অগণতান্ত্রিক নির্বাচন, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ, বিরোধীদের জেলে পাঠানো, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ এবং সন্ত্রাসের রাজত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ এখন বিদ্যমান। তার সরকারের বিরুদ্ধে তার শপথের প্রতিটি প্রধান নীতি এবং জাতির স্বাধীনতাকালীন দলিল পদদলিত করার অভিযোগ রয়েছে। সাংবাদিকের কাজ হলো স্পষ্টভাবে তথ্য জানানো। কাউকে স্বতঃসিদ্ধ সম্মানসূচক পদবি দেওয়া নয়।
হ্যাঁ, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বললে নিরপেক্ষ শোনাতে পারে। কিন্তু সবসময় নিরপেক্ষ থাকাটা তথ্যগতভাবে সঠিক নয়। নিরপেক্ষ শব্দাবলি বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, যদি এর মাধ্যমে ব্যাপক নির্যাতনের ইতিহাসের স্বাভাবিকীকরণ করা হয়। এটা অপরাধীকে দায়বদ্ধতা থেকে সুরক্ষা দেয় এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের কাছে একটা বার্তা যায় যে, এই সমাজ নিয়মিত রাজনীতি আর অস্বাভাবিক অপরাধের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। এটা নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির জন্য অপমানেরও কারণ হতে পারে। ছয় বছর বয়সি বাসিত খান মুসার কথা ভাবুন। জুলাই বিক্ষোভের সময় নিজ বাড়ির গেটের কাছে গুলিবিদ্ধ হয় এই শিশুটি। তার মাও কয়েক মিনিট পরে গুলিতে নিহত হন। তাদের পরিবারের কাছে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ নিরপেক্ষ কোনো পদবি নয়, এটা যন্ত্রণাদায়ক উচ্চারণ।
শেখ হাসিনা আজ আন্তর্জাতিক আইনের চোখে সেইসব অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। তার অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ চলছে। কোনো প্রেক্ষাপট ছাড়া এখন যদি তার আনুষ্ঠানিক পদবি ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ ব্যবহার করা হয়, তাহলে তাকে একটা মর্যাদার স্ট্যাটাস দেওয়া হবে। সেটা করা হলে তার সব অপকর্ম ঢাকা পড়ে যাবে, যেগুলো জনগণের এখন জানা প্রয়োজন।
ইতিবাচক সাংবাদিকতায় ভাষাকে ফ্রেমিং হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যে লেবেল ব্যবহার করা হয়, সেটা পাঠকের কাছে গুরুত্ব আর দায়িত্বের একটা ধারণা তৈরি করে। আর সে কারণেই এপি থেকে নিয়ে রয়টার্স—বিশ্বের বেশির ভাগ মিডিয়ার স্টাইল গাইডে ভদ্রতাসূচক উপাধি বা পদমর্যাদার লেবেল এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ এতে বর্ণিত চরিত্রগুলো বৈধতা পেতে পারে।
শেখ হাসিনাকে আলাদা করে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বলাটা সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলা উচিত।
অন্তত এটুকু করা উচিত যে, যখন তাকে এই উপাধিতে উল্লেখ করা হবে, তখন একই সঙ্গে তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপট, সংবিধান লঙ্ঘন এবং তার সহিংস বহিষ্কারের তথ্যগুলো উল্লেখ করা উচিত। এটা শুধু স্টাইলের প্রশ্ন নয়, বস্তুনিষ্ঠতার প্রশ্ন। সমাজ যেভাবে তার নেতাদের এবং ইতিহাসকে বিচার করে, ভাষা সেটাকে ফ্রেমের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে। ভাষার যে রাজনীতি, সেটা সাংবাদিকদেরকে একটা ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ করে দেয়। যেকোনো বিশেষ বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল রেখে কোনো বিষয় বা ঘটনাকে ফ্রেমিং করার মাধ্যমে তারা এটা করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হাসিনাকে যদি শুধুই ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বলা হয়, তাহলে তার অপকর্মগুলো ঢাকা পড়ে যায় এবং তাকে একজন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিত্রিত করার ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশেষ করে যারা তার ইতিহাস জানে না, তারা এই বিভ্রান্তির শিকার হবে। হিটলারসহ আরো বহু ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা গেছে—তাদের অপরাধগুলো যখন প্রকাশিত হয়ে গেছে, তখন স্পষ্টতা ও নৈতিক নির্ভুলতার জন্য মিডিয়ার ভাষা অবশ্যই বদলে গেছে।
সমালোচকরা হয়তো বলবেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ কথাটা এড়িয়ে গেলে রিপোর্টের রাজনীতিকরণ করা হবে। আসলে এর উল্টাটাই সত্যি। প্রাসঙ্গিক যথার্থতাই হলো বস্তুনিষ্ঠতার মূল ভিত্তি। একজন নেতার শাসনকাল যখন নিয়মতান্ত্রিক হত্যা, গুম, দুর্নীতি আর নিপীড়ন দিয়ে চিহ্নিত হয়, তখন সেই তথ্যগুলো বাদ দেওয়াটাই আসলে একটা রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যেটা সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তোলে।
সংবাদকক্ষকে অবশ্যই প্রশ্ন করতে হবে, কার জন্য আমরা কাজ করছি—ক্ষমতাধর নাকি জনগণের জন্য? বাংলাদেশের সাংবাদিকদের এখন বেছে নিতে হবে তারা পতিত সরকারের অবশিষ্ট মানুষদের জন্য সুখকর খবর প্রকাশ করবেন, নাকি পাঠকদের তারা পূর্ণাঙ্গ ও অস্বস্তিকর সত্যটাও তুলে ধরবেন। প্রতিটি সংবাদকক্ষকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়, পাঠকের সঙ্গে তারা কী সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। সেই সম্পর্কটা সুবিধাবাদের ভিত্তিতে তৈরি হবে, নাকি সততার ভিত্তিতে। জনসেবার দৃষ্টিকোণ থেকে সাংবাদিকতার যে ঘোষিত উদ্দেশ্য—প্রতিটি সাংবাদিকতার পদক্ষেপ আর কাজকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা উচিত।
শেষ বিচারে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ হলো মর্যাদাসূচক একটা উপাধি, যেটা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়া নেতাকে বলা যেতে পারে। যখন কোনো নেতার শাসন শেষ হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্য দিয়ে, তখন মর্যাদাসূচক ভাষা ব্যবহারের অর্থ হলো ওই অপরাধকে মেনে নেওয়া। শেখ হাসিনাকে শুধু ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বলার অর্থ হলো অসম্পূর্ণ তথ্য দেওয়া। এটা বিভ্রান্তিকর, দায়মুক্তির প্রচেষ্টা এবং নৈতিকভাবে অসমর্থনযোগ্য। সাংবাদিকদের পাঠকদের কাছে সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপটসহ সত্য পৌঁছানোর দায় আছে, তাদের শব্দালংকারের আরামে গা ভাসালে চলবে না।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টার্ন নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশান্স বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর