বিডিআর হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ সব চিত্র। শেখ হাসিনার সরকারের চাহিদা অনুযায়ী পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মূল ঘটনা আড়াল করে বানোয়াট বর্ণনা তৈরি করা হয়েছিলো। সত্য প্রকাশের চেষ্টা করতে গিয়ে বহু বিডিআর সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী গুম হন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়। সিপাহি সেলিমকে নির্যাতন করে হত্যার চেষ্টা করা হয় এবং হাবিলদার মহিউদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জবানবন্দি থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম বাদ দিতে সাক্ষীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়। এদিকে ৬৪ জন বিডিআর সদস্য এখনো নিখোঁজ; তারা জীবিত কি না, কেউ বলতে পারেন না। ঘটনার ১০ দিনের মধ্যে ৯ মার্চ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৩৪ জন বিডিআর সদস্য অস্বাভাবিকভাবে মারা যান। এদের কারও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর বিডিআর মসজিদের পেশ ইমাম সিদ্দিকুর রহমানকে রাজসাক্ষী করতে চাপ ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। নির্যাতনের মুখে তিনি আতঙ্কিত ও অসুস্থ হয়ে পরবর্তী সময়ে মারা যান। প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের তদন্তদল কারাগারে আটক বিডিআর সদস্যদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তাদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখেছে। আসামিরা জানিয়েছে, জোরপূর্বক সাক্ষ্য আদায়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর এ হত্যাকাণ্ডের নতুন তদন্তে মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ৩০ নভেম্বর কমিটি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়।
স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ আমলে সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত কমিটি বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধানে গভীরে না গিয়ে গতানুগতিকতার আশ্রয় নিয়েছে। কিছু বেসামরিক ও আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঘটনাকে প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকতে পারে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী, তার ছেলে লেদার লিটন এবং অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার কাঞ্চনের সন্তান জাকের বিদ্রোহে গভীরভাবে জড়িত। সেনা কমিটির প্রতিবেদনে আরও উচ্চপর্যায়ের তদন্তের সুপারিশ থাকলেও সে সময়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কমিশন মতামতে জানায়, সে সময়ের সেনা তদন্ত কমিটি তথ্য উদ্ঘাটনে উদ্যোগী থাকলেও মতামত প্রদানে কিছুটা সতর্ক অবস্থান নেয়।
পুলিশ কর্মকর্তাদের দায় সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে সমর্পিত অস্ত্র যথাযথ হেফাজতে না নিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক অস্ত্র সমর্পণ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন এবং পুলিশি দায়িত্ব সঠিকভাবে নিশ্চিত করেননি। তিনি সেদিন জিম্মি অবস্থায় থাকা সব পরিবারকে উদ্ধার করার দায়িত্বে থাকলেও শুধুমাত্র নিজের কন্যা ও কিছু পরিবারকে উদ্ধার করেন। সত্য গোপন করে তিনি হত্যাকারীদের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ তৈরি করেন এবং অপরাধীদের পলায়ন রোধে ব্যবস্থা নেননি।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ডিএমপির সাবেক কমিশনার নাইম আহমেদ ক্রাইমসিন নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের পলায়ন ঠেকাতে ব্যর্থ হন। তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (এসবি) ও বর্তমান আইজিপি বাহারুল আলম অনুমানভিত্তিক তথ্য দিয়ে কমিশনের তদন্তে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধীদের ফাঁসান। মাঠপর্যায়ের এসবি টিমের পরিচয় বা প্রয়োজনীয় তথ্য কমিশনকে না দিয়ে অসহযোগিতা করেন। সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম পাঁচ সেনা অফিসারকে ফাঁসাতে মিথ্যা তথ্য দেন এবং তদন্তে সহযোগিতা করেননি।
সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ ও তার দলের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনে সাতটি অভিযোগ আনা হয়- নারী ও শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনায় মামলা না করা, সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও অভিযোগপত্র না দেওয়া, আবার সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ না করা, মোবাইল ফোন সিডিআর সংগ্রহ করেও প্রযুক্তিগত প্রমাণ উপস্থাপন না করা, সেনা অফিসারদের খুনি, আলামত ধ্বংসকারীদের ও পলায়নে সহায়তাকারীদের বিষয়ে তদন্ত না করা। কাহার আকন্দের দল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেনি। তারা বিরোধীদলীয় নিরীহ নেতাকর্মীদের মামলায় ফাঁসিয়ে সাজা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন এবং স্বাধীন তদন্ত কমিশনকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না দিয়ে অসহযোগিতা করেন।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটে। এতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন।