একটি মানসম্মত মেডিকেল কলেজে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার তার অনেকটাই নেই সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজে। এখানে হাসপাতাল এখনো চালু হয়নি, ফলে শিক্ষার্থীরা হাতেকলমে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে নানা সমস্যায় জর্জরিত কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ। বিক্রমপুর মেডিকেল কলেজের অবস্থাও ভালো নয়। এমন অনেক সমস্যায় জর্জরিত বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। এসব মানহীন কলেজ দেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে উঠছে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মান তলানিতে। অবকাঠামো, শিক্ষক সংখ্যা, হাসপাতালের সংযুক্তি এবং শিক্ষার মান না থাকায় এ কলেজগুলো ভবিষ্যতে নিম্নমানের ডাক্তার তৈরি করবে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন এবং ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের সুপারিশ অনুযায়ী, এসব কলেজ বন্ধ করা বা শিক্ষার্থীদের অন্য স্বীকৃত কলেজে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এসব কলেজ থেকে পাস করা ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের অনেকেই রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে উঠতে পারেন।
সরকারের তদন্তেও অনেক কলেজই মানহীন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়ে এসব কলেজ বন্ধের সুপারিশও করা হয়েছিল, যদিও পরে সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৭টি সরকারি ও ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিজিএমই) তথ্য অনুযায়ী, পুরো ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে গুরুতর শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষকের ছয় হাজার ৪৪৬টি অনুমোদিত পদের মধ্যে খালি রয়েছে দুই হাজার ৭০০টি, অর্থাৎ ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ পদ খালি রয়েছে। ঘাটতি সবচেয়ে বেশি অধ্যাপক পর্যায়ে, যেখানে ৬৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ পদ খালি।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের পর নির্মিত মাগুরা, নীলফামারী, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর, নওগাঁ ও নেত্রকোনা—এই ছয়টি মেডিকেল কলেজের মান নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। এ কলেজগুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই, হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত নয় এবং নানা সংকটের সম্মুখীন।
রাজনৈতিক বিবেচনায় হাসপাতাল
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ আমলের কিছু প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও কর্মকর্তা কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ছাড়াই নেত্রকোনা, চাঁদপুর, নওগাঁ, নীলফামারী, মাগুরা ও হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজ অনুমোদন দিয়েছিলেন। তবে এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো স্থায়ী ক্যাম্পাস, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যথেষ্ট জনবল বা গবেষণাগার নেই। ফলস্বরূপ, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং মানসম্মত চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না।
এসব মেডিকেল কলেজের মধ্যে ২০১৫ সালে প্রশাসনিক অনুমোদন পায় হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজ। ক্লাস নেওয়ার জন্য স্থান না পাওয়ায় তখন কোনো শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য অনুমোদন পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সালে কলেজটির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। তবে তা চলছে সদর আধুনিক হাসপাতালে। শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটির দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলা নির্বাচন করা হয়েছে। হবিগঞ্জ-লাখাই সড়কের পাশে সদর উপজেলায় প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ক্যাম্পাস গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকলেও কার্যকর অগ্রগতি হয়নি।
অপর পাঁচটি মেডিকেল কলেজ ২০১৮ সালে অনুমোদন পায় এবং পরবর্তী বছর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এর মধ্যে নেত্রকোনা মেডিকেলের ক্লাস চলছে সদর হাসপাতালের কয়েকটি কক্ষে। আট বছরেও নিজস্ব কোনো ভবন হয়নি কলেজটির। এরই মধ্যে গত বছর আসন সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৭০ করা হয়েছে । একই সঙ্গে রয়েছে শিক্ষক সংকটও। কলেজের গবেষণাগারে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় বইয়ের ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। হাতেকলমে শেখার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা।
এদিকে চাঁদপুর মেডিকেলের জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়নি এখনো। সদর হাসপাতালের মাত্র আটটি কক্ষেই চলছে এই কলেজ। স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকায় শিক্ষার্থীদের জায়গার সংকুলান হয় না। এক ব্যাচের ক্লাস চলাকালীন অন্য ব্যাচকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কলেজটির কোনো নিজস্ব হোস্টেলও নেই। একটি ভাড়া ভবনে করা হয়েছে আবাসনের ব্যবস্থা। প্রায় একই অবস্থা নওগাঁ, নীলফামারী ও মাগুরা মেডিকেল কলেজেরও।
শিক্ষার্থীরা যা বলছেন
সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, একটি মানসম্মত মেডিকেল কলেজে যা যা থাকা উচিত, তার অনেক কিছুই এখন পর্যন্ত অনুপস্থিত। হাসপাতাল যেহেতু চালু হয়নি, তাই ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। ফলে দক্ষতার প্রশ্নও থাকে। হাসপাতাল চালুর জন্য বিভিন্ন চেষ্টা-তদবির করার পর এখনো স্পষ্টভাবে বলা যায় না, হাসপাতাল কবে চালু হবে।
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, হাসপাতাল পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে গাফিলতি করছে প্রশাসন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মারপ্যাঁচ এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর অপেশাদারিত্ব, ঢিলেমি ও সময়সাপেক্ষ কাজের কারণে হাসপাতাল চালুর অনিশ্চয়তা বাড়ছেই। বারবার তদারকি করার পরও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এই দুই শিক্ষার্থী জানান, সুনামগঞ্জ মেডিকেল কলেজের একাডেমিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকসহ সব ধরনের স্টাফের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতাল চালুর জন্য প্রয়োজনীয় অনেক রিসোর্স এখনো আনা হয়নি, কখন আসবে তা-ও নির্দিষ্ট নয়। একই সঙ্গে কলেজের একাডেমিক রিসোর্সেরও অভাব রয়েছে।
এদিকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, হাসপাতাল পুরোপুরি চালু না হওয়ায় ব্যবহারিক প্রশিক্ষণে ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষক ও একাডেমিক শিক্ষায় সমস্যা না থাকলেও সার্জারি, ইমার্জেন্সি, গাইনি, চক্ষু ও নাক-কান-গলা বিভাগ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। শিক্ষার্থীরা রোগীর কাছে যেতে অন্য হাসপাতালে যাচ্ছেন, যা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যবহারিক প্রশিক্ষণে বাধা দিচ্ছে।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন মানহীন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বন্ধের সুপারিশ করেছে। গত ৫ মে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন পেশ করা হয়। প্রতিবেদনে স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি ৩২টি সুপারিশের মধ্যে চিকিৎসা শিক্ষার মানোন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য সমন্বিত ও কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের সব মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম নিয়মিত মূল্যায়ন করা উচিত। এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, কলেজ সংখ্যা ও আসন সংখ্যা পুনর্বিন্যাস করতে হবে। মানহীন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বন্ধ করতে হবে। তবে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি এড়াতে তাদের অন্যান্য স্বীকৃত মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরের ব্যবস্থা রাখতে হবে। দেশে ১১০টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৩৭টি সরকারি। এর মধ্যে নেত্রকোনা, চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, মাগুরা ও নীলফামারী সরকারি মেডিকেল ন্যূনতম মান নিশ্চিত করতে পারছে না। প্রায় ২০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজও মান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ।
যদিও সরকার মানহীন মেডিকেল কলেজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত থেকে পরে সরে আসে। পরিবর্তে ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে এসব মেডিকেলে ভর্তির আসন সংখ্যা কমানো হয়েছে। ১০ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারি ৩৭টি মেডিকেল কলেজের মোট ৩৫৫টি আসন কমিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আলোচিত ছয়টি মেডিকেলে আসন ৭৫ থেকে কমিয়ে ৫০ করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ মেডিকেলের ৭৫টি আসন অপরিবর্তিত রয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট ৭২২টি আসন কমানো হয়।
ভবিষ্যৎ ঝুঁকি
মানহীন কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসক রোগীর জীবন ও দেশের স্বাস্থ্যসেবা বিপন্ন করতে পারে। সমাধান না করলে পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে ডাক্তার তৈরির মান গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইউনাইটেড হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক মুর্তজা শাহরিয়ার আমার দেশকে বলেন, ‘একজন মেডিকেল স্টুডেন্টের শেখার সময়ে ভালো শিক্ষক যেমন জরুরি, একই সঙ্গে হাসপাতালে রোগী দেখে তাদের চিকিৎসা প্রক্রিয়া অবজার্ভ করে শেখাটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যদি এমন হয় যে, কোনো মেডিকেলে যোগ্য শিক্ষক সংকট আছে কিংবা সেখানে রোগীদের দেখে শেখার সুযোগ কম, তবে এমবিবিএস লেভেলে শিক্ষার্থীদের শেখাটা পূর্ণাঙ্গ হয় না। এমন হলে শিক্ষার্থীদের সেলফ কনফিডেন্স যেমন কম থাকে, তেমনি পেশাগতভাবেও দক্ষতার ত্রুটি হবে। উন্নত বিশ্বের মেডিকেল স্টুডেন্টদের সঙ্গে আমরা যদি নিজেদের তুলনা করি, সেখানে আমাদের লক্ষ্য থাকবে এই যে, দক্ষতা ও যোগ্যতার দিক থেকে যেন তাদের ও আমাদের মাঝে কোনো পার্থক্য না থাকে। এমন হতে হলে শেখার পরিবেশ মানসম্পন্ন হওয়া নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন চিকিৎসক আমার দেশকে বলেন, মানহীন মেডিকেল কলেজ থেকে যারা পাস করছেন, তাদের অনেকেই পেশাগতভাবে রোগী দেখার জন্য উপযুক্ত নন। মানহীন মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকরা রোগীকে সঠিকভাবে চিকিৎসা দিতে অক্ষম হতে পারেন, যা রোগীর জীবন ও সুস্থতায় ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, প্রকৃত দোষী হলেন সে ব্যক্তিরা, যারা দুর্নীতির মাধ্যমে এসব কলেজ অনুমোদন ও পরিচালনা করেছেন, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করেছেন।