Image description

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের শেষ কর্মদিবস ২৭ ডিসেম্বর। এর আগেই রাষ্ট্রকে খুঁজে নিতে হবে নতুন প্রধান বিচারপতি। কে এই পদ পূরণ করতে পারেন, এ পদ অলঙ্কৃত করার যোগ্যতা কি- সেটি বিবৃত রয়েছে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে। সে অনুসারে আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের অনেকেরই এ পদ অলঙ্কৃত করার যোগ্যতা রয়েছে। রেওয়াজ হচ্ছে, আপিল বিভাগে কাজ করছেন- এমন বিচারপতিগণের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া। যদিও বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সরাসরি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে। ব্যতিক্রম এই দৃষ্টান্তদৃষ্টে হাইকোর্ট বিভাগ থেকেও প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হতে পারেন। চর্চিত রেওয়াজ বলছে, আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয়া। এর মধ্যে বয়সে সিনিয়র বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি পদে অধিক ‘যোগ্য’ বলে বিবেচনা করা হয়। আবার কর্মে দক্ষতা বিচারে অনেক সময় সিনিয়রিটি ভাঙার রেওয়াজই বেশি।

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারপতি রয়েছেন ৭ জন। বাকিরা হলেন, বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো: রেজাউল হক, বিচারপতি এসএম এমদাদুল হক, বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি অবসরে গেলে আপিল বিভাগের বিচারপতি সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ জনে। এর মধ্যে বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম সিনিয়র। তাঁর পরপরই রয়েছেন বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী। মো: আশফাকুল ইসলাম স্বাভাবিক অবসরে যাবেন ২০২৬ সালের ১৪ জুলাই। তাকে প্রধান বিচারপতি করা হলে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন সাড়ে ৬ মাস। এরপরই বাংলাদেশকে এ পদের জন্য খুঁজে নিতে হবে আরেক জনকে। কর্মে সিনিয়রিটি বিবেচনায় বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের পর বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলামই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ-যোগ্য। ‘কর্মদক্ষতা’র ভিত্তিতে দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় সিনিয়র বিচারপতিকেও ‘প্রধান বিচারপতি’ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আপিল বিভাগের বিচারপতি মো: জুবায়ের রহমান চৌধুরীকেও দেয়া হতে পারে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ। মো: জুবায়ের রহমান চৌধুরী স্বাভাবিক অবসরে যাবেন ২০২৮ সালের ১৭ মে। সিনিয়রিটির দিক থেকে আপিল বিভাগের তৃতীয় সিনিয়র বিচারপতিকেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের নজির রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিচারপতি মো: রেজাউল হকেরও সম্ভাবনা রয়েছে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভের। আপিল বিভাগের এই বিচারপতি স্বাভাবিক অবসরে যাবেন বিচারপতি মো: জুবায়ের রহমান চৌধুরীরও আগে, ২০২৭ সালের ২৩ এপ্রিল।

মহামান্য প্রেসিডেন্ট সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত কাকে দেশের ২৬তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন- সেটিই এখন দেখার বিষয়। এবারের বিচারপতি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, তার সময়কালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়ায় সংবিধান অনুযায়ী তিনি হতে পারেন পরবর্তী ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’র প্রধান উপদেষ্টাও।

বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম : বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলামের জন্ম ১৯৫৯ সালের ১৫ জুলাই। পিতা: বিচারপতি একেএম নূরুল ইসলাম। মাতা-কবি জাহানারা আরজু। বিচারপতি নূরুল ইসলাম বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট (১৯৮৬-১৯৮৯) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি এইচএম এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি অনার্স এবং এলএলএম করেন। ভারত থেকে এফআইসিপিএস সম্পন্ন করেন। আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট বারে তালিকাভুক্ত হন ১৯৮৩ সালে। ২০০৩ সালের ২৭ আগস্ট তিনি সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০৫ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে স্থায়ী হন। ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। শিক্ষা ও কর্মজীবনে তিনি ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, ইতালি, তুরস্ক, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, কাজাখ রিপাবলিক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটান সফর করেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিদেশ সফরে গেলে তিনি একাধিকবার ‘প্রধান বিচারপতির কার্যভার’ গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি আপিল বিভাগের চেম্বারকোর্টের বিচারপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২টি উচ্চতর গ্রেড প্রদান, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদমর্যাদাক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স), বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস গ্রন্থ বিকৃতি এবং ২০০৫ সালে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধে হাইকোর্টের দেয়া রায় কঠোরভাবে অনুসরণের নির্দেশ প্রদান বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলামের আলোচিত রায়।

বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী : বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর জন্ম ১৯৬১ সালের ১৮ মে। তার পিতা-মরহুম এএফএম আব্দুর রহমান চৌধুরী। মাতা- বেগম সিতারা চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি অনার্স করে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম করেন। পরে আন্তর্জাতিক আইনের ওপর যুক্তরাজ্য থেকেও এলএলএম সম্পন্ন করেন। জুবায়ের রহমান চৌধুরী ১৯৮৫ সালে সুপ্রিমকোর্ট বারে আইনজীবী হিসেবে অ্যানরোল্ড হন। হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন ২০০৩ সালের ২৭ আগস্ট। ২০০৫ সালে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে স্থায়ী হন। ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট তাকে আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। কর্মজীবনে তিনি বেলজিয়াম সফর করেন। এ ছাড়া তিনি উচ্চশিক্ষা এবং বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রামে প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড ইউনিভার্সিটি, কানাডা, মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর, সিঙ্গাপুর এবং নেপাল সফর করেন।

সরকারি কর্মচারীদের পেনশন সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত রায়, নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার অধিকার সংক্রান্ত রায়, সরকারি কর্মকর্তাদের ১৫০ দিনের বেশি অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) রাখা অবৈধ ঘোষণা, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণা বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর আলোচিত রায়।

বিচারপতি মো: রেজাউল হক : মো: রেজাউল হক ১৯৬০ সালের ২৪ এপ্রিল জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা- মো: তাজিমুল হোসেন, মাতা- উম্মে কুলসুম হোসেন। ১৯৮৪ সালের ৮ এলএলবি-এলএলএম সম্পন্ন করে এপ্রিল জেলা বারে আইনজীবী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন ১৯৯০ সালের ২১ জুন। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ২০০৬ সালের ২ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে স্থায়ী হন। ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট তাকে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভিন্ন রায় এবং আদেশের কারণে বিচারাঙ্গনে তিনি আলোচনার জন্ম দেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রায় হচ্ছে, সাম্প্রতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় প্রদান, আপিল বিভাগের চেম্বার জাস্টিস হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত আ’লীগ নেতা-কর্মীদের জামিন স্থগিতকরণ, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল আদেশ, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি থাকাকালে বিচারপতি মো: রেজাউল হক এবং ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চের দেয়া আদেশ- ‘শুধুমাত্র মেডিকেল প্রমাণের অনুপস্থিতির ভিত্তিতে একজন ধর্ষণ অভিযুক্তকে নির্দোষ বলা যায় না- মর্মে আদেশ আলোচনার জন্ম দেয়। আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ লাভের পর বিচারপতি মো: রেজাউল হক বহুবার চেম্বার জাস্টিসের দায়িত্ব পালন করেন।