বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কখনো ঐতিহাসিক, কখনো টানাপড়েন। কখনো রাখিবন্ধনের আবার কখনো বৈরী। শেখ হাসিনার জমানায় এসে হয়ে গেল একতরফা, আত্মসমর্পণমূলক। ৫ই আগস্ট পট পরিবর্তনের পর এই সম্পর্ক দাঁড়ালো প্রতিহিংসার। চললো কাল্পনিক আর আজগুবি প্রচার। সম্পর্ক পরিণত হলো শত্রুতায়। শুরু হয়ে গেল মিডিয়াযুদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মারমুখো ও আক্রমণাত্মক রূপে আবির্ভূত হলো। ঢাকায় সরকার পরিবর্তন হচ্ছে- এটা ছিল রোজকার ঘটনা। সরকার তখন চুপ। কিন্তু বিরামহীন প্রচারণা চললো। শেখ হাসিনাও নিরাপদ দূরত্বে থেকে এতে ঘি ঢাললেন। ভারত সরকার ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিলো। বন্ধ হলো ভিসা, এমনকি মানবিক ভিসাও। সীমিত হয়ে গেল যোগাযোগ। ভারতের ভোজ্য তেলের রমরমা ব্যবসা ছিল ঢাকায়। সেটা গেল আমেরিকায়। পাকিস্তান পেলো কাপড়-চোপড়ের ব্যবসা। চীন তো হাসপাতাল খুলে বসলো। এমনকি হালাল রেস্টুরেন্টও। পর্যটক আর চিকিৎসার জন্য রোগীরা ছুটছেন কুনমিংয়ে।
ওদিকে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা-বিবৃতির ভাষাও বদলে গেল। মানুষ হত্যাও বেড়ে গেল সীমান্তে। দু’দেশের মধ্যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্কও স্থবির হয়ে গেল। অঘোষিত রণাঙ্গনে পরিণত হলো দু’দেশের সীমান্ত। এর আগে ৫ই আগস্ট সীমান্ত খুলে দিলো ভারত। দলবেঁধে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশ ছাড়লেন। অসমর্থিত খবর- প্রায় ৫০ হাজার নেতাকর্মী আশ্রয় নিলেন ভারতে। এভাবেই চললো প্রায় ১০ মাস। জুন থেকে নাটকীয় পরিবর্তনের দিকে পরিস্থিতি গড়াতে শুরু করলো। ইউরোপীয় একটি দেশের দূতিয়ালিতে ভিন্ন এক পরিস্থিতি। দরজা খুললো আলোচনার। সীমিত পর্যায়ের যোগাযোগ। তবে সংশয় আর সন্দেহ মাঝখানে দেয়াল হয়ে রইলো। কোথায় যেন গোলমাল। তৃতীয় দেশটি আলোচনার তাগিদ দিলো। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও এখানে অনেকখানি।
তারা জানিয়ে দিলো, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন কাম্য নয়। ভূ-রাজনৈতিক কারণে দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিকল্প নেই। নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ব্রেন্ট ক্রিস্টেনসেন এমন বার্তা নিয়ে খুব শিগগিরই ঢাকায় আসছেন। এই পটভূমিতেই ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। প্রাথমিক আলোচনার পর দিল্লিতে ড. খলিলকে আমন্ত্রণ জানান অজিত দোভাল। বৈঠকটি হয় অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে। দু’পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব কমানোর তাগিদ আসে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে মনোযোগ দেন তারা। এর আগের খবর- ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনেকটা নাটকীয়ভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার নীতি পরিবর্তনের পক্ষে মত দেন। জাতীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় নরেন্দ মোদির টুইট এরই স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। এজেন্সিনির্ভর কৌশল বাদ দিয়ে মোদি রাজনৈতিকভাবে সম্পর্কোন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেন নীতিনির্ধারকদের বৈঠকে।
দু’দেশের মধ্যে ১৫ মাস কূটনীতি ছিল অনেকটা অনুপস্থিত। এজেন্সির ওপর নির্ভশীল ছিলেন ভারতের নীতিনির্ধারকরা। পর্যালোচনা করে তারা দেখতে পান- ওই কৌশল ভুলে ভরা। এতে সম্পর্কের উন্নতি হবে না। বরং আরও তিক্ততা বাড়বে। ঢাকায় ভারতবিরোধী কাফেলা আরও লম্বা হবে। দু’দেশের সম্পর্কোন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি-কৌশল সাজালেন নরেন্দ্র মোদি। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, নরেন্দ্র মোদি নিজেই এখন বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ও দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহ আরও সক্রিয় হলেন। অন্তর্বর্তী প্রশাসনের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘোষিত নীতি নিয়ে এগুতে থাকলেন ড. খলিল। কে ছোট, কে বড় বিবেচনায় নয়- ইউনূস বিশ্বাস করেন সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক। খলিল দিল্লির বৈঠকে এটাই তুলে ধরলেন। সংবিধানে আছে- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’। এই দৃষ্টিভঙ্গির কিঞ্চিত পরিবর্তন। ‘বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্ব’- এটাই এখন অগ্রাধিকার। খলিল-দোভাল বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে জানা যায়নি। এনিয়ে কেউ কথা বলছেন না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা হয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যায়।
ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, তাদের নীতি-কৌশলের কারণে ঢাকায় ভারতবিরোধী প্রচারণাই শুধু বাড়েনি, এই সুযোগে অন্য একটি শক্তি ঢুকে পড়েছে। যা এক সময় উদ্বেগের কারণ হতে পারে। ’৭১ সনে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারতের যে অবদান ছিল তাও মানুষ ভুলে যাবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নের পরামর্শ দেন কেউ কেউ। তারা বলেন, বাংলাদেশকে কোনো অবস্থাতেই হাতছাড়া করা যাবে না। হাত বাড়াতে হবে বন্ধুত্বের। সম্পর্ক করতে হবে স্বাভাবিক। ঢাকার তরফে বলা হয়েছে, দরজা খোলা, যে কেউ আসতে পারে। আমরা কাউকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানাইনি।
এখানে বলে রাখা ভালো- এই মুহূর্তে ভারতের ভেতরেই বাংলাদেশ নীতির কড়া সমালোচনা করছেন কেউ কেউ। এরই মধ্যে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা কিছুটা থেমেছে। বদলে গেছে মিডিয়ার শিরোনামও। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভুল নীতির কারণে একইভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোও ভারত থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাচ্ছে। যার সুযোগ নিচ্ছে দূরের এবং কাছের শক্তি।