মানুষ এমন একটি পুলিশ বাহিনী দেখতে চায়, যারা রাজনৈতিক স্বার্থে নয়, জনগণের স্বার্থে কাজ করবে। এর জন্য তাদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে নয়, যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে হতে হবে। সব পর্যায়ে রাজনীতিমুক্ত করা গেলে পুলিশ বাহিনী স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। রাজনৈতিক দলগুলো পুলিশ বাহিনীর রাজনীতিকীকরণ করবে না, এমন প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন। আলোচনার বিষয় ছিল– বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়। প্রথম আলো ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতি যৌথভাবে এ আয়োজন করে।
বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (অবসরপ্রাপ্ত) ও বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সহসভাপতি ইয়াসমিন গফুর। আলোচনায় পুলিশের অতীতের সংকট, বর্তমান পরিস্থিতি ও সামনের দিনের করণীয় নিয়ে মতামত উঠে আসে।
বৈঠকে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, পুলিশকে দানবীয় বাহিনী পরিণত করেছিলেন শেখ হাসিনা। আমি সরকারে গিয়েও বোঝার চেষ্টা করেছি পুলিশ কেন অত্যাচার করে। এর অনেকগুলো দিক আছে। কেউ করে সরকারি দলের আদেশে। আবার কেউ করে নিজ স্বভাবে। সে ক্ষমতাশালী হতে চায়, টাকা বানাতে চায়। সরকার তাকে যতটুকু অত্যাচার করতে বলে, তার থেকেও দশ গুণ বেশি করে। উদাহরণ হিসেবে তিনি সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের কথা বলেন। তিনি বলেন, সরকার নিশ্চয়ই তাঁকে বলেনি হিন্দুদের জায়গা দখল করে রিসোর্ট বানাও।
আসিফ নজরুল বলেন, আমার লোক, তোমার লোক– এটা আওয়ামী লীগ আমলে ভয়াবহ অবস্থায় গিয়েছে। বাংলাদেশে যত খারাপ কাজ, সেটা প্রথম আওয়ামী লীগ আমলে শুরু হয়েছে, ’৭৩ সালের আওয়ামী লীগের আমলে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে নির্যাতন, মৃত্যু, ভুয়া নির্বাচন, দলীয়করণ– সবকিছু শুরু করেছে আওয়ামী লীগ, বাকিরা অব্যাহত রেখেছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আমার লোক, তোমার লোক– কালচার থেকে বিএনপি, জামায়াতকে বের হয়ে আসতে হবে। এনসিপি ও ছোট দলগুলোকেও বের হয়ে আসতে হবে। ছোট দলগুলো বা উদীয়মান দলগুলো এ ব্যাধি থেকে মুক্ত নয়। সম্প্রতি দুই পুলিশ কর্মকর্তার বদলি নিয়ে বড় দুই দল থেকে টেলিফোন পাওয়ার কথা উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, একদল সরাতে বলেছে, আরেক দল বলছে– সরালেন কেন?
আইন উপদেষ্টা বলেন, এর মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে আটক করা ব্যক্তির স্বজনদের জানাতে হবে। গুমসংক্রান্ত আইনে সংশোধন করা হয়েছে, যাতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বজনকে জানাতে বলা হয়েছে। না জানালে গুম হিসেবে গণ্য হবে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, গত নভেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। এই সময়ের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। একটা জায়গায় এখনও হতাশা থেকে বের হতে পারছি না। অনেকে বলছেন, পুলিশ কমিশন এখনই করতে হবে। রাজনৈতিক সরকার এলে এটি হবে না। তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কী? উনারা (রাজনৈতিক নেতা) আমাদের অভিভাবক। তারা দেশ পরিচালনা করেন। তাহলে তাদের কেন আস্থায় রাখতে পারব না। এটা হতাশাজনক। সেই ভয় থেকে বলি, রাজনীতি ও কার্যনির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত একটা স্বতন্ত্র বডির আওতায় আমাদের (পুলিশ) নিয়ে যান। ওই আস্থাটা কেন পাচ্ছি না? তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতারা দেশ চালাবেন; কিন্তু তারা কোনো প্রভাব বিস্তার করবেন না– দেশ এমন অবস্থায় কবে যাবে।
বাহারুল আলম বলেন, গত ১৫ বছরে আমরা কীভাবে ব্যবহার হয়েছি, এর আত্ম-অনুসন্ধান করতে হবে। যারা দেশ পরিচালনা করেন বা করবেন (রাজনৈতিক দল), তারা এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসবেন বলে আশা করি।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, কার্যকর স্বাধীনতা আমাকে দেন। মামলা তদন্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আমার কাছে যেন কোনো নির্দেশনা না আসে। কীভাবে পুলিশ পরিচালিত হবে তা বইতে লেখা আছে। আমাকে ওই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৩ ধারাতে পুলিশের ওপর সরকারের অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটা সংস্কার করতে হবে। নতুন পুলিশ আইনও হোক। সুখের কথা হলো, অন্তর্বর্তী সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমরা পুলিশের সাহায্যের জন্য যাই। অনেক সময় তারা সহায়তা করে, তবে কিছু ক্ষেত্রে তারা কাঠামোগত, রাজনৈতিক বা জবাবদিহি সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যর্থ হয়।
তিনি স্বীকার করেন, যদিও পুলিশ প্রায়ই জনসমালোচনার মুখোমুখি হয়; তবুও তারা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংকটের সময় তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রথম আলো সম্পাদকের পর্যবেক্ষণ, আশির দশক থেকে বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারেনি। তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থবহ সংস্কারের জন্য একটি বাস্তব সুযোগ রয়েছে, যেখানে পুলিশ বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্যরা সক্রিয়ভাবে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংস্কারের প্রস্তাবনা তৈরি করছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি সিলেকশন কমিটির নেতৃত্ব দেন, তাহলে ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ অব্যাহত থেকে যাবে।
আগের পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মতিউর রহমান বলেন, ওই কমিশন একশর বেশি প্রস্তাবনা তৈরি করেছিল, যার মধ্যে ১৮টি প্রস্তাবনাকে তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নযোগ্য বলা হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে ১১টি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে বেশ কয়েকটি সুপারিশ এখনও কার্যকর করা হয়নি। যেমন স্বচ্ছ জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ স্থাপন, কারা পরিস্থিতি উন্নত করা, নারীদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং সব থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের বাধ্যতামূলক করা।
মতিউর রহমান একটি প্রধান অবাস্তবায়িত প্রস্তাবও তুলে ধরেন। সেটি হলো– আদালতের আদেশ ছাড়া এফআইআরবিহীন অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার নিষিদ্ধ করা। তিনি বলেন, পুলিশ কর্তৃপক্ষ এটিকে ‘অবাস্তব’ বলে মনে করেছে। কারণ মামলা দায়েরের সময় সব সন্দেহভাজনের নাম জানা যায় না।
পুলিশকে রাজনীতিমুক্ত করার ওপর জোর দিয়ে প্রথম আলো সম্পাদক বলেন, আমরা সবাই এমন একটি পুলিশ বাহিনী চাই, যারা রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, বরং জনগণের সেবা করবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার নিশ্চিত না হলে চলমান পুলিশ সংস্কার উদ্যোগে বড় কিছু অর্জিত হবে না। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর এখনও প্রশাসনে দলীয় প্রভাব বিস্তারের সংস্কৃতি চলমান। এখনও নিয়োগ-পদোন্নতি থেকে শুরু করে কাকে ত্যাগ করা হবে, কাকে ত্যাগ করা হবে না, মামলা-বাণিজ্য, গ্রেপ্তার ও জামিন-বাণিজ্য সবকিছু চলছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নতুন পোশাকের চেয়েও পুলিশের বাসস্থান ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নে নজর দেওয়া বেশি জরুরি। তিনি মিরপুরের একটি পুলিশ ব্যারাকের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে ২০০ কর্মীর জন্য একটি বাথরুম। ৬০ স্কয়ার ফিটের একটি ঘরে ২০ জন ঘুমায়।
পুলিশ শুধু ব্যবহৃত হয়েছে বিষয়টি এমন নয়; বরং তারা এটাকে উপভোগ করেছে– এমন মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ক্ষমতা ব্যবহার করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও নিয়েছেন। তাই কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক পরিবর্তনও জরুরি।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, অভ্যুত্থানের পরও পুলিশের আচরণের পরিবর্তন হয়নি। এটি এক অদ্ভুত ব্যাপার। বিভাজিত সমাজে আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ–এমন নানা তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
নুরুল হুদা বলেন, বাড়ি ফরিদপুর বা ফরিদপুরের আশপাশে হয়, তাহলে কোনো নিয়োগ, পদোন্নতি হবে না। আবার আরেক সময় বগুড়ায় বাড়ি, দিনাজপুরের বাড়ি হলে চাকরিতে নেওয়া যাবে না বা ক্ষেত্রবিশেষে পদোন্নতি হবে না। এ ধরনের মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার বা পেশাদারি মনোভাব ফেরানো কঠিন হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, বিএনপির অনেক নেতা আছেন, যাদের নামে ৩০০, ৪০০ বা ৪৫০ করে মামলা আছে। গায়েবি মামলা, যিনি মারা গেছেন তাঁর নামেও মামলা। তিনি বলেন, পুলিশের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল মানবাধিকার রক্ষা করা, তাদেরই একটা অংশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল। বাক্স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার বদলে বাক্স্বাধীনতা হরণ করেছে তারা।
পুলিশের বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে পুলিশ সংস্কার কমিশনের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। তিনি বলেন, সুশীল সমাজের যারা পুলিশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বোঝেন এবং সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনে যুক্ত করতে হবে তাদের।
নূর খান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশের বিভিন্ন জেলার পুলিশ লাইন্সগুলো গোপন কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছিল। বিভিন্ন জেলা ও বিভিন্ন কারাগার থেকে মানুষ নিয়ে এসে সেখানে নির্যাতন করা হতো। এ ছাড়া এএসআই ও এএসপি দুই ধাপে পুলিশের নিয়োগ ব্যবস্থার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য সাইফুল আলম খান বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে পুলিশের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকা উচিত নয়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা আমার বাসার কাছাকাছি। পুলিশ সদস্যরা কীভাবে তাঁর বাসায় যেতেন, তা দেখেছি। এসব বন্ধ না করলে পুলিশকে হাত-পা বেঁধে সাঁতরানোর নির্দেশ দেওয়ার মতো অবস্থা হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, বিগত ১৫ বছরে পুলিশে রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে পুলিশের পেশাগত মান উন্নত করতে হবে। তিনি বলেন, পুলিশ নিয়ে সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা বদলাতে কাজ করতে হবে। পুলিশ সম্পর্কে শিশুদের কাছে জানতে চাইলে ভয়ের কথা বলবে। আরেকটু বড় হলে বলে– শুধু ঘুষ খায়।
আলোচনায় অংশ নেন পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতির সভাপতি এম আকবর আলী, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের ও পুলিশের অতিরিক্ত আইজি কাজী মো. ফজলুল করীম।