Image description
ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল । সিন্ডিকেটে হোতা দুই নার্স । টাকা দিলেই মিলে ট্রেনিং, সুবিধাজনক ডিউটি ।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই নার্স ঘুস ও চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এতে সাধারণ নার্স ও রোগীরা অসহায় হয়ে পড়েছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স সোহেল আহমদ ও ইমরান আহমেদ তপাদার। সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন নার্সিং সুপারভাইজার রাশেদা আক্তার, আইসিইউ ইনচার্জ সাব্বির আহমেদ তফাদার প্রমুখ।

ঘুস বাণিজ্যের খাতের মধ্যে রয়েছে-নার্সদের ডিউটি রোস্টার, নাইট ডিউটি, ইনচার্জ পদ, আইসিইউ সিট, টিচিং ও ট্রেনিং বাণিজ্য, ডোপ টেস্ট। প্রতিটি খাতে সিন্ডিকেট সদস্যরা ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুস ও চাঁদা আদায় করেন। চাহিদামতো টাকা না দিলে নানা লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও মানসিক হেনস্থার শিকার হতে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ হেনস্থার শিকার হন।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পেরিয়ে সিন্ডিকেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালেও প্রভাব বিস্তার করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও সোহেল ও ইমরান প্রভাবশালী ছিলেন। নার্সিং অ্যাসোসিয়েশনের সিওমেক শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে আওয়ামী লীগ প্যানেল থেকে তারা নির্বাচিত হন। ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ নার্সদের সঙ্গে কথা বলে সোহেল ও ইমরান সিন্ডিকেটের নানা বাণিজ্যের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। হেনস্থার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নার্স যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালজুড়ে অনিয়মের জাল বিছানো হয়েছে। এর অডিও রেকর্ড যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে।

বিশেষায়িত ট্রেনিংয়ের জন্য নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর প্রতি বছর নার্সদের নাম চেয়ে চিঠি দেয়। যোগ্যতা থাকলেও সিন্ডিকেটের প্রভাবে ট্রেনিং সাধারণ নার্সদের ভাগ্যে জুটে না। প্রতিটি টেনিংয়ের জন্য সোহেল-ইমরান সিন্ডিকেট মোটা অংকের ঘুস নিয়ে নাম নির্ধারণ করে। নার্সরা জানান, পাঁচ দিনের ক্লিনিক্যাল নার্সেস ট্রেনিংয়ের জন্য মনোনীত হতে চাইলে সোহেল-ইমরান সিন্ডিকেটকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়। ১৪ দিনের অভিযোজন ট্রেনিংয়ের জন্য পাঁচ হাজার টাকা, ২৮ দিনের আইসিইউ-সিসিইউ ট্রেনিং নিতে হলে ১০ হাজার টাকা, ২৮ দিনের কার্ডিয়াক ট্রেনিংয়ের জন্য ১০ হাজার টাকা, ২৮ দিনের নবজাতক সেবা ট্রেনিংয়ের জন্য ১০ হাজার টাকা, পাঁচ দিনের ফুড ও নিউট্রিশন ট্রেনিংয়ের জন্য ১ হাজার টাকা, তিন দিনের পিআইএমএস ট্রেনিংয়ের জন্য ৫০০ টাকা ঘুস দিতে হয়। এক বছরের নার্সিং শিক্ষকতা প্রশিক্ষণে শুধু নাম প্রস্তাবের জন্য ১৫ হাজার টাকা ঘুস দিতে হয়। চাকরি প্রায় শেষের দিকে এমন শতাধিক নার্সের ভাগ্যে ট্রেনিং জোটেনি। সোহেল-ইমরান সিন্ডিকেট এরইমধ্যে অর্ধশতাধিক ট্রেনিংয়ের অর্থ কামিয়ে নিয়েছে।

অবৈধ অর্থ উপার্জনের অন্যতম খাত ডিউটি বাণিজ্য। সুবিধাজনক ডিউটি রোস্টারের জন্য সিন্ডিকেটকে মাসে মোটা অংকের টাকা ঘুস দিতে হয়। বেসরকারি ক্লিনিক ও নার্সিং কলেজে অনেক নার্স নিয়মবহির্ভূত কাজ করেন। এ জন্য হাসপাতালে সুবিধাজনক সময়ে ডিউটি পেতে তারা মরিয়া হয়ে উঠেন। এ সুযোগ দিয়ে সোহেল-ইমরান মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। নিয়ম অনুযায়ী-প্রতি সপ্তাহে তিন দিন সকাল ও তিন দিন বিকালে ডিউটি করার কথা। কিন্তু এ সিন্ডিকেটকে মাসোয়ারা দিলে মাসের পর মাস সুবিধা অনুযায়ী সকালে অথবা বিকালে ডিউটি রোস্টার মিলে। নার্সদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী-এ সুবিধার জন্য প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। মাসে পাঁচ দিন রাতের ডিউটি করার নিয়ম থাকলেও সিন্ডিকেটের সুবিধাভোগীরা দুই-তিনমাস পরপর রাতের ডিউটি করেন। এ কারণে সাধারণ নার্সদের মধ্যে চাপ তৈরি হয়। অনেক নার্সকে মাসে ১০ দিন করে রাতের ডিউটি করতে হয়। সিন্ডিকেটকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন নার্সিং সুপারভাইজারের সাহায্যকারী উপ-সেবা তত্ত্বাবধায়ক রাশেদা বেগম।

নিু মধ্যবিত্ত ও গরিব রোগীরা সাধারণত আইসিইউ সেবার জন্য সিওমেক হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আসন সীমিত হওয়ায় দীর্ঘ সিরিয়াল থাকে। এ সুযোগ নেয় সিন্ডিকেট। সেখানে ইনচার্জ হিসাবে বসানো হয়েছে ইমরানের স্বজন সাব্বির আহমেদকে। সিরিয়াল যতই দীর্ঘ হোক-সিন্ডিকেটকে টাকা দিলে সিট মিলে।

সিন্ডিকেটের ঘুস বাণিজ্যের আরেকটি খাত ডায়ালাইসিস। এখানে ঘুসছাড়া সঠিক সময়ে সেবা মিলে না। এখানকার নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য সমীর চন্দ্র দাসের হাতে। ঘুস দিলে ড্রাগ মার্কার ডোপ টেস্টের ফলাফল বদলে যায়। সিন্ডিকেটের সদস্য এনায়েত আল আমিনকে টাকা দিলে নিগেটিভ সার্টিফিকেট মেলে। নেশাখোর হলেও টাকা দিলে ফলাফল অনুকূলে পাওয়া যায়।

অভিযোগের বিষয়ে নার্সিং অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক সিনিয়র স্টাফ নার্স সোহেল আহমদ বলেন, এসব তথ্য মিথ্যা বানোয়াট। আওয়ামী লীগের সময় প্রভাব খাটানোর বিষয়ে তিনি বলেন, সে সময় আমাদের নানা বক্তব্য দিতে হয়েছে। কোনো জায়গায় কাউকে বসানো আমার দায়িত্ব নয়। রাশেদা আক্তারকে নার্সিং উপসেবা তত্ত্বাবধায়কের সাহায্যকারী হিসাবে পদায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, রাশেদার স্বামী বিএনপি নেতা। তিনিই তাকে বসিয়েছেন। আমরা বরং রাজি ছিলাম না।

নার্সিং অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যসচিব ইমরান আহমেদ বলেন, সিওমেকে কোনো সিন্ডিকেট নেই। যারা বলছেন তারা ভুয়া তথ্য দিচ্ছেন। নিজের চাচাতো ভাইকে আইসিইউ ইনজার্চ হিসাবে পদায়নের বিষয়ে তার কোনো হাত ছিল না বলেও তিনি জানান। আওয়ামী লীগের সময় নির্বাচন করার বিষয়ে তিনি বলেন, এককভাবে নির্বাচন করে সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলাম।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. কামরুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, সাধারণ নার্সরা কিছু অভিযোগ করেছেন। এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।