মাফিয়া শাসক শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দিশাহারা হয়ে পড়ে নয়াদিল্লি। দিশাহারা মোদি সরকার শেখ হাসিনাকে আবার বাংলাদেশের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এর কারণ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে দেড় যুগে ভারত বাংলাদেশে যেসব অপকর্ম করেছে, তা গোটা বিশ্ববাসীর সামনে ফাঁস হওয়ে যাওয়ার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে ভারত। হাসিনার আমলে ভারত বাংলাদেশে যা করছে, তা যদি বিশ্ববাসী জানতে পারে তাহলে উন্মুক্ত হয়ে যাবে মুখোশের আড়ালে ভারতের প্রকৃত কদর্য চেহারা। ভারতের এই নোংরা চেহারা যাতে বিশ্ববাসী দেখতে না পারে, সেজন্য নয়াদিল্লি আবার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফেরাতে একের পর এক গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। হাসিনা পতনের পর বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে চূড়ান্ত বিদ্বেষ আর শত্রুতামূলক নীতি গ্রহণ করে নয়াদিল্লি।
হাসিনাকে হারিয়ে ভারতের বিদিশা অবস্থা এবং তাকে আবার ক্ষমতায় ফেরানো অথবা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ভারত এখন পর্যন্ত যেসব কর্মকাণ্ড করেছে, তার পেছনের কারণ বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুবই পরিষ্কার। কিন্তু জনতার রোষে ক্ষমতাচ্যুত একজন গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধী অপরাধী শাসকের জন্য ভারত কেন এত দিওয়ানা—এ বিষয়টি বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের মানুষের তেমন জানা ছিল না। বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী অনেক গণমাধ্যমের বিভিন্ন খবর থেকে এখন তারাও জানতে পারছেন, বাংলাদেশকে কীভাবে ভারত তাদের প্রতি সম্পূর্ণ নতজানু আর নামেমাত্র একটি রাষ্ট্রে পরিণত করে সর্বগ্রাসী শোষণব্যবস্থা চালু করেছিল। বিশ্ববাসী জানতে পারছেন, বিডিআর গণহত্যা থেকে সর্বশেষ জুলাই গণহত্যায় ভারতের সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে।
বিশ্বে এখন এটি প্রতিষ্ঠিত—শেখ হাসিনা ছিলেন একজন কুখ্যাত স্বৈরশাসক। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি নিজ দেশের মানুষের ওপর গণহত্যা পরিচালনা করেছেন। টানা দেড় দশক ধরে নিষ্ঠুরতম সব উপায়ে তিনি তার বিরোধীদের দমন করেছেন। শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও দলের লোকজন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছেন লুটপাটের মাধ্যমে। তিনি নির্বাচনের নামে বারবার গোটা দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এবং গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করেছেন। গোটা বিশ্বের সামনে এখন পরিষ্কার, শেখ হাসিনার মতো এ ধরনের একজন অত্যাচারী শাসককে বাংলাদেশের ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছিল ভারত। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দাবিদার ভারত শেখ হাসিনার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করে মাফিয়াতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।
অন্যদিকে ভারতের সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে বাংলাদেশকে ভারতের একটি কলোনি তথা শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ চলত নয়াদিল্লির নির্দেশে। নয়াদিল্লির সহায়তায়ই শেখ হাসিনা দেড় দশক ধরে বিরোধীদের গুম, খুন, আয়নাঘর, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো বর্বরতার নজির স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের সব অস্ত্রধরী বাহিনী, সব গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অনুগত লোকদের বসিয়ে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারের অবাধ সুযোগ করে দিয়েছিল শেখ হাসিনা ও তার সরকার। ফলে হাসিনা সরকারের সব অপরাধ তথা বিডিআর হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সর্বশেষ জুলাই গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাসহ বিরোধীদের গুম-খুনেরও দায় বর্তায় ভারতের ওপর।
জুলাই গণহত্যায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’ সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমন করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’ একটি গুপ্তহত্যা বাহিনী গঠন করে। এর নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ডেল্টা সেভেন’। আন্দোলন চলাকালে ঢাকা মহানগরজুড়ে স্নাইপার দিয়ে ব্যাপকভাবে গণহত্যাসহ বিভিন্ন নাশকতায় এ গুপ্ত বাহিনীর জড়িত থাকার ভয়াবহ তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে।
শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশকে তুলে দেওয়া হয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’-এর হাতে। ভারত বাংলাদেশের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ সেনা সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভবনের দুটি ফ্লোর অলিখিতভাবে র’-এর জন্য বরাদ্দের খবর প্রকাশের ঘটনায়। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব গোয়েন্দা সংস্থা চলত সরাসরি নয়াদিল্লির নির্দেশনায়।
শেখ হাসিনার পতনে ভারত যেসব কারণে বিচলিত হয়ে পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বিডিআর গণহত্যায় তাদের জড়িত থাকার ঘটনা বিশ্বদরবারে প্রকাশ হয়ে পড়বে। সেজন্য বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আবার তদন্তে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনে বাধা আসে শুরুতেই। ভারতের প্রতি অনুগত, মাফিয়া ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসররা চেষ্টা করেছে কমিশন গঠন ঠেকাতে। কিন্তু পরে দেশপ্রেমিক বিভিন্ন মহলের প্রবল দাবির কারণে কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু তারপর দেশবিরোধী শক্তি নতুন করে মাঠে নামে কমিশন যেন স্বাধীনভাবে সঠিক কাজটি করতে না পারে সেজন্য।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারত সরাসরি জড়িত—এ বিষয়ে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যসহ অনেক সামরিক ও বেসামরিক লোকজন, অনেক প্রত্যক্ষদর্শী অনেক দিন ধরে প্রকাশ্যে অভিযোগ করে আসছিলেন। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে নিহত সেনা কর্মকর্তা মেজর তানভীর হায়দারের স্ত্রী তাসনুভা মাহা প্রকাশ্যে গণমাধ্যমের সামনে অনেকবার বলেছেন, তাকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তিনজনকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনেছেন।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ভারত সরাসরি জড়িত—এ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে জাতীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় কমান্ডো ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ২৪ জন পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত ছিল। এ বিষয়ে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। তাসনুভা মাহা কমিশনের সাক্ষ্যে বলেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের পরপরই দরবার হল থেকে তার স্বামী তানভীর হায়দার তাকে ফোন করে বলেছেন, সেখানে ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড অব ইন্ডিয়ার লোকজন আছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আগে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের বৈঠকের পর পুরো পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। ভারতের হুমকির কারণে ঘটনার পর পিলখানায় অভিযান পরিচালনা করা যায়নি। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ বলেছেন, ‘তখন পিলখানায় সেনা অভিযান চালাতে গেলে ভারত বাংলাদেশের হামলা চালাবে, এই হুমকি ছিল।’
সাবেক সেনাপ্রধানের এ বক্তব্যের পর এ ঘটনায় ভারতের জড়িত থাকার বিষয়টি আর আড়াল করার কোনো উপায় নেই।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় সরকারি প্রতিবেদনে ভারতের জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতকে ধসিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তাছাড়া পিলখানা হত্যায় ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী অনেক সাক্ষীর আওয়ামী আমলে পরিকল্পিতভাবে হত্যার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অনেক আগে থেকেই অনেকে বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করে দেওয়া, যাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো ভারতের বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে উঠতে না পারে। কমিশনের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত এবং এ পরিকল্পনা করা হয় দীর্ঘ মেয়াদে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা।
একটি দেশের সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করে সেই দেশকে নতজানু করে রাখার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যার মিশনে ভারতের জড়িত থাকার ঘটনাকে বাক্সবন্দি করে রাখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ভারতের একটি কলোনিতে পরিণত হয়। ভারতের প্রশ্রয়ে শেখ হাসিনা একজন মাফিয়া ও ফ্যাসিবাদী শাসকে পরিণত হন। গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের নজির সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশে ভারতের স্থায়ী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর বিচারের নামে নাটক সাজিয়ে হত্যা করা হয় জাতীয়তাবাদী ইসলামপন্থি রাজনৈতিক নেতাদের। শাপলা চত্বরে গণহত্যা থেকে শুরু করে আয়নাঘরসহ গত দেড় দশকে বাংলাদেশে যত অপরাধ হয়েছে, তার সবকিছুর এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হত্যা করে মাফিয়াতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ছিল বিডিআর হত্যাকাণ্ড। বিডিআর হত্যাকাণ্ডবিষয়ক সরকারি প্রতিবেদনে ভারতের নাম উঠে আসায় হাসিনা সরকারের যাবতীয় অপরাধের জন্য এখন ভারত কেবল নৈতিকভাবে দায়ী নয়, বরং সরাসরি অভিযুক্তের তালিকায়। তদন্ত কমিশনের এই প্রতিবেদনের আলোকে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের নতুন করে বিচার করতে হবে। তখন বিচারের অংশ হিসেবে অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে আওয়ামী লীগ ও ভারতের কারা কোন পর্যায়ে কীভাবে জড়িত। এর ফলে এটি তখন আইনি ভিত্তি পাবে। বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এটি করতে হবে। কারণ এটি এখন সর্বজনগ্রাহ্যভাবে প্রতিষ্ঠিত, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে পাকিস্তানকে ভাঙার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ থেকে। তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ভবিষ্যতে তাকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা, যাতে এই দেশটি কখনো ভারতের নিরাপত্তার জন্য কোনো হুমকি হিসেবে বিরাজ না করে। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের পর থেকে ভারত বাংলাদেশকে নতজানু করার মিশন নিয়ে মাঠে নামে, যার বাস্তব নমুনা এদেশের মানুষ দেখেছে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা শেখ হাসিনার টানা দেড় যুগের শাসনামলে। যেখানে ভারতের লক্ষ্য বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেখানে ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশকে আরেকটি কাশ্মীর, গাজা অথবা মিয়ানমারে পরিণত করার, সেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অপরাধসহ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপের ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া মানে একটি দেশের জন্য আত্মহত্যার শামিল। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় না আনা মানে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা এবং ভবিষ্যতেও বাংলাদেশবিরোধী এ ধরনের অপকর্ম চালু রাখার বৈধতা দেওয়া।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ