ভোটের সময় প্রার্থী আর তাঁর কর্মীদের নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকে না। ছুটতে থাকেন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। যে করেই হোক প্রার্থীর কথা পৌঁছে দিতে হবে প্রতিটি ভোটারের কানে। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতির সভা-সমাবেশ, লিফলেট-পোস্টারে হয়তো আর সেটা শতভাগ সম্ভব হতো না।
যুগটা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের। হাতের এক মোবাইল ফোনের মধ্যে যেন গোটা জগৎ-সংসার। রাজনীতি কিংবা ভোটও তাই বাদ যাচ্ছে না। আগামী সংসদ নির্বাচনে দল ও প্রার্থীদের একটি বড় অংশ এ সুযোগ নেবে। যুগের গুরুত্ব বুঝে নির্বাচন কমিশনও আচরণবিধিতে প্রথমবারের মতো সংযুক্ত করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের বিষয়টি।
আচরণবিধি কার্যকর হবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই। তার আগেই অবশ্য কিছু দল ও প্রার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। দল-আদর্শ আর নিজের রাজনৈতিক বার্তা দিয়ে ভোটারদের কাছে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছেন।
কড়ি ছাড়া কি আর ভোটারের দরজায় কড়া নাড়ার সুযোগ মিলবে। কাজটা করতে তাই গুনতে হচ্ছে অর্থ। বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে এ দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার ফেসবুকের। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ফেসবুকে রাজনৈতিক নেতাদের বিজ্ঞাপনের পরিমাণও তত বাড়ছে। ফেসবুকে ‘সামাজিক বিষয়, নির্বাচন এবং রাজনীতি’ সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন নিয়ে তথ্য থাকে মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে। এই অংশে গত তিন মাসে (৪ সেপ্টেম্বর-২ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ থেকে বুস্টিংয়ের (বিজ্ঞাপন) শীর্ষে থাকা ২০টি পেজের মধ্যে অন্তত ১০টিতেই সরাসরি রাজনৈতিক দল ও নেতা সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। এই ১০টি পেজের মধ্যে আটটি থেকে আবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং এই দলের নেতাদের সম্পর্কে বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। বাকি দুটি পেজে জামায়াতে ইসলামী এবং এই দলের নেতাদের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। অপর ১০টি পেজ রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কি না, তা শনাক্ত করা যায়নি যথাযথ তথ্য না থাকায়।
১০টির মধ্যে ৮টি বিএনপি-সম্পর্কিত
মেটা অ্যাড লাইব্রেরির তথ্য বলছে, বিজ্ঞাপনে তিন মাসে ফেসবুক বুস্টিংয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে ‘Bangladesh Nationalist Party-BNP’। তিন মাসে এই পেজের খরচ ৪ হাজার ৮৮৫ ডলার। ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে ‘BNP Media Cell’। গত তিন মাসে এই পেজের খরচ ৪ হাজার ৭২৯ ডলার। তাদের ২০টি বিজ্ঞাপন মেটা অ্যাড লাইব্রেরিতে রয়েছে।
গত তিন মাসে ফেসবুক বুস্টিংয়ে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ নামের পেজ। এই পেজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের নেতারা পরিচালনা করেন। তিন মাসে তাঁরা বিজ্ঞাপনে খরচ করেছেন ৪ হাজার ২১৫ ডলার।
সপ্তম অবস্থানে রয়েছে ‘Tarique Rahman’ নামের পেজ। এই পেজ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ। গত তিন মাসে এই পেজ থেকে বিজ্ঞাপনে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৫৪৭ ডলার।
১১তম অবস্থানে রয়েছে ‘Rafiqul Amin Bhuiyan’ নামের পেজ। তিন মাসে এই পেজের খরচ ১ হাজার ৫৪৯ টাকা। জানা গেছে, পেজটি নরসিংদী জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল আমিন ভুঁইয়া রুহেলের।
‘মাহবুবুর রহমান ডাবলু’ নামের একটি পেজ রয়েছে ১৬তম স্থানে। এটি নওগাঁ-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী মাহবুবুর রহমানের বলে জানা যায়। গত তিন মাসে এই পেজ থেকে বুস্টিং হয়েছে ১ হাজার ৪১৩ ডলার।
১৭তম স্থানে রয়েছে ‘Shah Reazul Hannan-শাহ্ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজ’ নামের পেজ। এটি গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসনের বিএনপির মনোনীত প্রার্থী শাহ্ রিয়াজুল হান্নানের পেজ। তিনি বিএনপির প্রয়াত নেতা হান্নান শাহর ছেলে। তাঁর পেজ থেকে গত তিন মাসে ১ হাজার ৩৮৭ ডলার খরচ হয়েছে বিজ্ঞাপনে।
মেটা অ্যাড লাইব্রেরির শীর্ষ বিশে থাকা একমাত্র নারীর পেজ ‘Syeda Adiba Hussain-সৈয়দা আদিবা হোসেন’। এই পেজ থেকে তিন মাসে ১ হাজার ২৭৮ ডলার খরচ হয়েছে। পেজটি সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সৈয়দা আদিবা হোসেনের বলে জানা গেছে।
সবচেয়ে বেশি খরচ জামায়াত নেতার
মেটা অ্যাড লাইব্রেরির তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ডলার খরচ হয়েছে ‘Dr. Khaliduzzaman SM’ নামের পেজ থেকে। এটি জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা-১৭ আসনের প্রার্থী ডা. এস এম খালিদুজ্জামানের পেজ বলে জানা যায়। গত তিন মাসে এই পেজ থেকে বিজ্ঞাপনে খরচ করা হয়েছে ১২ হাজার ২৭৪ ডলার।
আর ১৪তম স্থানে আছে ‘Just Hasib’ নামের পেজ। তিন মাসে এই পেজ থেকে ১ হাজার ৫০৩ ডলার খরচ হয়েছে। এখানে দাঁড়িপাল্লার পক্ষে ভোট চাওয়ার কিছু পোস্ট রয়েছে।
ফেসবুকে প্রচারের বিষয়ে বিএনপি নেতা মাহবুবুর রহমান ডাবলুর প্রচারণা সহকারী মোহাম্মদ রাজীব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে অনলাইন প্রচারের মাধ্যমে কম সময়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। তাই আমরা ফেসবুকে প্রচারে গুরুত্ব দিচ্ছি। অফলাইনে যে প্রচার চলে, সেগুলোও আমরা অনলাইনে তুলে ধরছি, যাতে বেশিসংখ্যক মানুষকে সংযুক্ত করা যায়।
বিজ্ঞাপন দিয়েছে ইসিও
বিজ্ঞাপন খরচের হিসাবটা যদি শুধু এক দিনের ধরা হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে, তালিকার একেবারে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ। ৩ ডিসেম্বর এই পেজ থেকে খরচ হয়েছে ১৬০ ডলার।
ইসির আচরণ বিধিমালা কী বলছে
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার গেজেট গত ১১ নভেম্বর প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সেখানে প্রথমবারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবে। তবে তাদের সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি, ই-মেইল আইডিসহ অন্যান্য শনাক্তকরণ তথ্য আগেই রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দিতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা যাবে তফসিল ঘোষণার পর থেকে এবং ভোট গ্রহণ শুরুর ৪৮ ঘণ্টা আগে তা বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে ঘৃণাত্মক বক্তব্য, ভুল তথ্য ও নির্বাচনসংক্রান্ত বানোয়াট তথ্যসহ সব ধরনের ক্ষতিকর কনটেন্ট বানানো ও প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংখ্যালঘু বা অন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে আঘাত করা যাবে না। ধর্মীয় বা জাতিগত অনুভূতির অপব্যবহার নিষেধ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
ফেসবুকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাঠের রাজনীতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘নিউজ ফিডের রাজনীতি’। স্বচ্ছতা, নিয়ম মেনে চলা এবং তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করা গেলে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন গণতান্ত্রিক আলোচনাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। কিন্তু নীতি লঙ্ঘন, বিভ্রান্তিকর প্রচার ও অজানা উৎসের বিজ্ঞাপন রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীলও করতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের প্রতিষ্ঠাতা মিরাজ আহমেদ চৌধুরী জানান, কিছু বিজ্ঞাপন রাজনৈতিক হলেও তা মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে থাকে না। আবার অনেক বিজ্ঞাপনের আধেয় অরাজনৈতিক হওয়ার পরও রাজনৈতিক বলে চিহ্নিত হয়। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে, যিনি টাকা খরচ করছেন, তাঁকে ‘পেইড ফর বাই’ ডিসক্লেইমার দিতে হয়। এখানে ঠিকানা, ফোন নম্বর, ইমেইলসহ বেশ কিছু তথ্য দিতে হয়। অনেকে অসম্পূর্ণ তথ্য দেন। মেটাও মাথা ঘামায় না। তাই মানুষও কে টাকা খরচ করছে তার প্রকৃত তথ্য পায় না।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এখানে ইসির নজরদারি দরকার যে আসলে প্রার্থী বা দলের পক্ষে প্রচারটা কীভাবে হচ্ছে এবং সেখানে কত টাকা ব্যয় হচ্ছে।’