Image description
খালেদা জিয়ার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে শিগগিরই দেশে ফিরবেন -মির্জা ফখরুল

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরছেন-এ নিয়ে জনমনে কৌতূহলের শেষ নেই। ফেরার দিনক্ষণ জানতে দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকের পাশাপাশি অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের আগ্রহের যেন কমতি নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সত্যটা অনেক গভীরে। এর ভেতরে আছে মায়ের জন্য সন্তানের হৃদয়ভাঙা অপেক্ষা, আছে নিরাপত্তার বিষয়। তবে সব কিছু ছাপিয়ে জাতীয়তাবাদের এই কান্ডারি যে দেশে ফিরছেন, তা নিশ্চিত। বিএনপির নেতাদের কেউ বলছেন, দেশে ফেরার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন। কিন্তু তা জাতীয় নির্বাচনের তফসিলের আগে হওয়ার সম্ভাবনা কম। এমনও হতে পারে তিনি মহান বিজয় দিবস পালন করবেন দেশের মাটিতে। আবার কারও মতে, নিরাপত্তার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হলেই দেশে ফিরবেন। অর্থাৎ দেশে ফেরা নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। তবে ফেরার সুনির্দিষ্ট তারিখের বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। শিগগিরই যে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে-তা দলটির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদিকে সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, ‘তারেক রহমান শিগগির দেশে ফিরবেন।’ এই ঘোষণার পরই দেশে ফেরার নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পুরোনো ভিডিও ছড়িয়ে দাবি করা হয় তারেক রহমান দেশের উদ্দেশে রওয়ানা করেছেন। তবে ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্ম ও ওয়েবসাইট দ্য ডিসেন্ট জানিয়েছে, ওই ভিডিওটি পুরোনো এবং বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ছেলে তারেক রহমান দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেবেন। পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে শিগগিরই তিনি দেশে ফিরবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বিএনপির নেতারা জানান, তারেক রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শ, স্বপ্ন ও সংগ্রামের প্রতীক। বহুমাত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে অসীম ধৈর্য, নির্যাতন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবিচল থাকার উদাহরণ তিনি। জাতির দুঃসময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণে তিনি আশার আলো ও ঐক্যের প্রতীক। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভদ্রতা, নৈতিকতা ও সৌজন্যবোধ ফিরিয়ে আনার নিরন্তর আপসহীন সংগ্রামী। বিএনপি ও বাংলাদেশের একজন অপরিহার্য রাজনীতিক। প্রায় ১৭ বছর তিনি যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত। তার ফেরার বিষয়ে নানা কারণে গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। দলের অনেক সিনিয়র নেতাও জানেন না, কবে ফিরবেন তিনি। তবে তার আসার কয়েক দিন আগে বিষয়টি প্রকাশ পাবে। তিনি যেদিন ফিরবেন, যে-ই পরিস্থিতিই হোক না কেন সেদিন লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থক তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে রাজধানীতে জড়ো হবেন। দিনটি দেশের জন্য ঐতিহাসিক দিন হবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।

দলীয় একাধিক সূত্র বলছে, তারেক রহমান দেশে ফিরে কোথায় উঠবেন এবং কোথায় অফিস করবেন, তাও প্রায় চূড়ান্ত। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নিরাপত্তার বিষয় নিয়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। এছাড়া খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখে দুটি বুলেটপ্রুফ বাস ও গাড়ি কেনার উদ্যোগ নেয় দলটি। এই গাড়ি কেনার অনুমতি দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে গাড়ি চলে এসেছে বলে দাবি সূত্রের।

দলীয় সূত্র আরও বলছে, গুলশান-২-এর ‘ফিরোজা’ ভবনে থাকেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এর পাশের ১৯৬ নম্বর বাড়িটি ১৯৮১ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর তৎকালীন সরকার তার স্ত্রী খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেয়। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার গুলশান-২ অ্যাভিনিউ রোডের ১৯৬ নম্বর বাড়ির নামজারি সম্পন্ন করে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র বিএনপি চেয়ারপারসনের হাতে হস্তান্তর করে। দেশে ফিরে এই বাড়িতেই থাকার কথা রয়েছে তারেক রহমানের। চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়েই অফিস করবেন তারেক রহমান। এজন্য তার বসার উপযোগী করেই কক্ষটি সাজানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা যুগান্তরকে বলেন, তারেক রহমান লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আগে গুলশান-২-এর ফিরোজায় উঠতে পারেন। সরকারি সূত্র বলছে, তারেক রহমানের দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই। তিনি যে কোনো সময় দেশে ফিরতে পারেন। তার নিরাপত্তার জন্য যা যা চাওয়া হয়েছে, সেসব বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তিনি দেশে ফিরতে চাইলে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে সরকার।

মঙ্গলবার দুপুরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান, তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। তিনি এখনো ট্রাভেল পাশ চাননি, চাওয়ামাত্র তা ইস্যু করা হবে। তাকে দেশে ফিরতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে সরকার।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে এক ব্রিফিংয়েও এ নিয়ে কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কারও জন্য কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। সরকার সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এখন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসক ও দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তার শারীরিক অবস্থা ‘সংকটাপন্ন’। দলীয় প্রধানের গুরুতর অসুস্থতার খবর নেতাকর্মীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। লন্ডনে থাকলেও ভার্চুয়ালি মা খালেদা জিয়ার শয্যা পাশেই সন্তান তারেক রহমান। প্রত্যেক মুহূর্তে মেডিকেল বোর্ড থেকে চিকিৎসার যাবতীয় আয়োজনে নিবিড় যোগাযোগ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের। স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানও মেডিকেল বোর্ডের সদস্য। এমতাবস্থায় তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন-এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা মতামত তুলে ধরেন নেটিজেনরা। তবে তাদের মতামতকে সম্মান জানিয়ে শনিবার ফেসবুক পোস্টে মায়ের জন্য দোয়া চেয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন তিনি। ‘সংকটকালে মায়ের স্নেহ স্পর্শ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যে কোনো সন্তানের মতো আমারও রয়েছে’ মন্তব্য করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এও বলেন, এখনই দেশে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তার জন্য অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।

এরপরই আলোচনার নানা ডালপালা মেলতে থাকে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রের ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার; যা মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভার পরে এক বিবৃতিতে জানানো হয়। এই বিবৃতির পর ভিভিআইপি হিসাবে বিশেষ নিরাপত্তা নিয়োজিত এসএসএফ সদস্যরা হাসপাতালে ডিউটি শুরু করেছেন।

জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার বলেন, যারা প্রশ্ন করেন এখনই কেন ফিরছেন না, তাদের মনে রাখতে হবে-একজন দায়িত্ববান নেতা শুধু আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন না; সঠিক সময়ের অপেক্ষা করেন। আজ তার জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মাকে বাঁচানো। আর দেশের জন্য তার সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি, ফিরে এসে জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার করা।

তিনি আরও বলেন, তারেক রহমানের দেশের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার ফেরা হবে। কিন্তু, তা হবে শক্তভাবে, নিরাপদে এবং দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে। সেই প্রত্যাবর্তন হবে বাংলাদেশের নতুন সূচনার দিন।

তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা জানান, তারেক রহমান বহুবার বলেছেন, বাংলাদেশই তার হৃদয়। বাংলাদেশই তার বাড়ি, তার শেকড়। তার মা খালেদা জিয়া, যার জন্য তিনি সব সময় ব্যাকুল। মায়ের অসুস্থতার প্রতিটি মুহূর্ত তার জন্য অসহনীয় কষ্টের। একজন সন্তানের কাছে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে? প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে তার একটাই ভাবনা-কবে আমি মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারব? ওই নেতা আরও বলেন, কিন্তু বাস্তবতা অন্য কথা বলে। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী খালেদা জিয়ার জরুরি উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। যে কোনো সময় তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনে স্থানান্তর করতে হতে পারে। সেই প্রস্তুতি নিয়েই তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান লন্ডনে প্রতিটি দিন কাটাচ্ছেন-বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্বসেরা চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে, চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে, শুধু নির্দেশের অপেক্ষায়। লন্ডন তাদের জন্য এখন বিশ্রামের নিবাস নয়; লন্ডন এখন মায়ের জীবন বাঁচানোর অপেক্ষার ঘর। তাই যারা প্রশ্ন করেন এখনই কেন ফিরছেন না? তাদের মনে রাখতে হবে-একজন দায়িত্ববান নেতা শুধু আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন না; সঠিক সময়ের অপেক্ষা করেন।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার আবু সালেহ মো. সায়েম বলেন, তারেক রহমান দেশপ্রেমিক নেতা যিনি দেশের স্বার্থ আগে দেখেন। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অবশ্যম্ভাবী, উপযুক্ত সময়েই তা ঘটবে, দেশের স্বার্থেই ঘটবে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

ধন্যবাদ জানিয়ে তারেক রহমানের পোস্ট-দেশবাসীর সম্মিলিত সমর্থনই আমাদের প্রেরণার উৎস : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা ও দোয়া করায় দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মঙ্গলবার সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, দেশবাসীর সম্মিলিত সমর্থনই জিয়া পরিবারের শক্তি ও প্রেরণার উৎস।

স্ট্যাটাসে তারেক রহমান লিখেছেন, ‘বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য যেভাবে সহযোগিতা ও শুভকামনা জানানো হচ্ছে, জিয়া পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা সবার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বিভিন্ন দেশের নেতা, কূটনীতিক ও বন্ধুগণের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা ও দোয়া সবকিছু আমাদের আবেগ ও অনুভূতিকে গভীরভাবে স্পর্শ করছে।’

তারেক রহমান আরও লেখেন, ‘দেশবাসীর সম্মিলিত সমর্থনই আমাদের পরিবারের শক্তি ও প্রেরণার উৎস। মমতাময়ী দেশনেত্রীর দ্রুত আরোগ্যের জন্য আমরা সবাই নিরন্তর দোয়া করছি। এই কঠিন সময়ে ঐক্য, সহমর্মিতা ও সংহতির জন্য প্রতিটি মানুষের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা রইল।’

উল্লেখ, গুরুতর অসুস্থ হয়ে ২৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছেন খালেদা জিয়া।