রাজধানীর বসুন্ধরায় এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। টানা দশ দিন ধরে তার ফেরার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে পরিবারের সদস্য, দলের নেতাকর্মী এবং দেশের আপামর জনগণ। কিন্তু হাজার মাইল দূরে লন্ডনে অবস্থানরত তার বড় ছেলে এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কি মায়ের শিয়রে ফিরতে পারবেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরা এখন শুধু একজন সন্তানের মানবিক দায়িত্ব নয়, এটা হয়ে উঠেছে বিএনপির রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকা, আসন্ন নির্বাচনে নেতৃত্বের স্বচ্ছতা এবং দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্যও জরুরি ঘটনা।
গত ২৩ নভেম্বর থেকে খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় সময় কাটাচ্ছেন। গত ২৮ নভেম্বর হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটার পর থেকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা গুঞ্জন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ রটাচ্ছেন, তিনি লাইফ সাপোর্টে আছেন, কেউ বা বলছেন তিনি ভেন্টিলেশনের সাপোর্টে রয়েছেন। যদিও মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, বেগম জিয়া সিসিইউতেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন, চিকিৎসা গ্রহণ করছেন এবং কোনো গুজবে দেশবাসীকে কান না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
একদিকে বেগম খালেদা জিয়ার সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থা, অন্যদিকে হাসপাতালের এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির বাইরে রাজনীতির মাঠে এবং সাধারণ মানুষের মনে এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- মায়ের এই চরম দুঃসময়ে কেন পাশে নেই বড় ছেলে তারেক রহমান? কেন দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে তিনি এখনো দেশের মাটিতে পা রাখতে পারছেন না? যেখানে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, যেখানে তারেক রহমানের ফেরার পথে দৃশ্যত কোনো আইনি বাধা নেই বলে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, সেখানে অদৃশ্য কোন সুতোয় আটকে আছে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন?
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দেশে ফেরা কেবল বিএনপির জন্য নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রক্ত এবং খালেদা জিয়ার আপসহীনতার উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে একচ্ছত্র ঐক্যের প্রতীক। গত ১৭ বছর ধরে তিনি দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম চলছে, তার পূর্ণতা পাবে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। আর সেই নির্বাচনে বিএনপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তারেক রহমানের উপস্থিতি অপরিহার্য। তিনি না থাকলে নির্বাচন কেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা এবং দলকে সুসংগঠিত রাখা কঠিন হতে পারে। তাছাড়া তিনি দেশে ফিরলে তা হবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতীকী বার্তা। ৫ আগস্টের পর তৈরি হওয়া রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা পূরণ এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় এই মুহূর্তে তারেক রহমানের ফেরাকে ‘অনিবার্য’ হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
মায়ের মৃত্যুশয্যায় পাশে থাকতে না পারার যন্ত্রণা একজন সন্তানের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা গত ২৯ নভেম্বর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তুলে ধরেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একদিকে দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে বিরামহীন যোগাযোগ, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার না ফেরা নিয়ে নানা অপপ্রচার, সব মিলিয়ে এক চরম মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘সংকটকালে মায়ের স্নেহ-স্পর্শ পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যেকোনো সন্তানের মতো আমারও রয়েছে। তবে এখনই দেশে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আমার জন্য অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।’
তারেক রহমানের এই কয়েকটি বাক্যই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। তারা মনে করছেন, তারেক রহমানের ‘একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’- এই বাক্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে গভীর কোনো রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ। তার এই স্ট্যাটাসের কয়েক ঘণ্টা পরই অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, তারেক রহমানের ফেরার ব্যাপারে সরকারের কোনো আপত্তি নেই। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলও একই সুরে কথা বলেছেন। সরকার এমন কী তার দেশে ফেরার ব্যাপারে একদিনের মধ্যে ‘ট্রাভেল পাস’ ইস্যু করার কথাও জানিয়েছে। তবুও তিনি ফিরছেন না কেন?
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতা দখল করা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন তারেক রহমান। টানা আঠারো মাস কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান। ওই সময় কারাগারে তার ওপর অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে, যার ফলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার মেরুদণ্ডের হাড়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানা যায়। চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি সপরিবারে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। লন্ডনে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়েই গত ১৭ বছর ধরে অবস্থান করছেন।
বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ তার ‘কারাগারে কেমন ছিলাম (২০০৭-২০০৮)’ বইতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘এমনও হতে পারে তিনি (খালেদা জিয়া) জেনারেলদের সাথে এই সমঝোতা করেছিলেন যে, তারেক রহমান আপাতত নিজেকে রাজনীতিতে জড়াবেন না এবং এ মর্মে তারেক রহমান কোনো সম্মতিপত্রে স্বাক্ষরও দিয়ে থাকতে পারেন।’ তবে সেই ‘আপাতত’ শব্দটির মেয়াদ যে এত দীর্ঘ হবে, তা হয়তো কেউ ভাবেননি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ সেদিকেও ইঙ্গিত করে জানাচ্ছেন, সে রকম কিছু হয়ে থাকলে সম্মতিপত্রে এই 'আপাতত' এর সময়সীমা ঠিক কতদিনের, তা কেবল সেসময়ের কুশীলবরা এবং বিএনপির নেতৃস্থানীয়রাই বলতে পারবেন। যদি সেটা বাধার কারণ হয়, তবে এ সরকারের আমলেও তা সমাধান না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
এক-এগারো ও আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৭ বছরে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব মামলার সংখ্যা ৮০-এর অধিক, যার মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, মানি লন্ডারিং মামলা এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা ছিল অন্যতম। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর একে একে সব মামলা থেকে তিনি খালাস বা অব্যাহতি পেয়েছেন। এসব মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় আইনি বাধা কাটলেও, তার পাসপোর্টের জটিলতা এখনো রয়ে গেছে।
২০০৮ সালে তিনি বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ছাড়লেও, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার তার পাসপোর্ট নবায়ন করেনি। ২০১৮ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম দাবি করেছিলেন, তারেক রহমান পাসপোর্ট ‘সারেন্ডার’ করেছেন। যদিও বিএনপি তখন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেও সরকার সেই সারেন্ডার করা পাসপোর্ট দেখাতে পারেনি।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে তারেক রহমানের হাতে বাংলাদেশের বৈধ পাসপোর্ট নেই। সরকার তাকে ‘ট্রাভেল পাস’ দিয়ে দেশে আনার প্রস্তাব দিলেও, এতে তারেক রহমান ও দলের নীতিনির্ধারকদের আপত্তি রয়েছে। ট্রাভেল পাস দেওয়া হয় সাধারণত পাসপোর্টহীন বা অবৈধ হয়ে যাওয়া নাগরিকদের একমুখী ভ্রমণের জন্য। কিন্তু তারেক রহমান দেশের একজন হবু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রাভেল পাস নিয়ে নয়, বরং বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে নিজের ‘সবুজ পাসপোর্ট’ হাতে নিয়েই দেশে ফিরতে চান। এটি তার কাছে কেবল একটি ভ্রমণ নথি নয়, বরং নাগরিক মর্যাদার প্রশ্নও বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
তবে তারেক রহমানের দেশে না ফেরার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেখছেন তার নিরাপত্তা ঝুঁকিকে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ইতিহাসই বলে দেয়, জনপ্রিয় বা পরিবারতান্ত্রিক নেতাদের দেশে ফেরার মুহূর্তটি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। ফিলিপাইনে বেনিগনো একিনো জুনিয়র নির্বাসন থেকে ফেরার পথে বিমানবন্দেরেই গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। পাকিস্তানেও বেনজির ভুট্টো দেশে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাওয়ালপিন্ডিতে জনসমাবেশে আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ হারান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তারেক রহমানের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। এক-এগারোর সময় যে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চাওয়া হয়েছিল, ৫ আগস্টের পর তা ‘মাইনাস ফোর’ ফর্মুলায় রূপ নিয়েছে। এই নতুন ফর্মুলার লক্ষ্য হলো খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার পাশাপাশি তাদের পরবর্তী প্রজন্ম, অর্থাৎ তারেক রহমান ও সজীব ওয়াজেদ জয়কেও রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে মুছে ফেলা। যেহেতু শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয় বর্তমানে ক্ষমতার বাইরে, তাই এখন ষড়যন্ত্রকারীদের মূল লক্ষ্য তারেক রহমান। তাকে সরিয়ে দিতে পারলেই ‘মাইনাস ফোর’ তথা বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বিশ্লেষকদের মতে, এদের মূল লক্ষ্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা নয়, বরং বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করা। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে তারেক রহমানের দেশে ফেরা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, কোনো কারণে নির্বাচন বানচাল হলে বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে, তারেক রহমানের ওপর হামলা হতে পারে ষড়যন্ত্রকারীদের প্রধান টার্গেট।
তারেক রহমানের ফেরার পথে আরেকটি বড় কাঁটা হলো আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি। বিশেষ করে প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের আপত্তি। বিএনপির একাধিক সূত্র ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী ভারতের ঐতিহাসিক অস্বস্তি রয়েছে।
উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের গোপন তারবার্তায় দেখা গিয়েছিল, ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় তারেক রহমানকে ‘দুর্নীতি ও সহিংস রাজনীতির প্রতীক’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনি সুপারিশ করেছিলেন যেন তারেক রহমানের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। যদিও গত দেড় দশকে বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং ৫ আগস্টের পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিএনপির সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে, তবুও সেই পুরনো আস্থার সংকট পুরোপুরি কেটেছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অন্যদিকে, ভারত প্রসঙ্গে তারেক রহমান সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অত্যন্ত পরিপক্ব ও দূরদর্শী মন্তব্য করেছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, তার কূটনীতির মূলমন্ত্র হবে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’। তিনি সেই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে সমতার ভিত্তিতে এবং বাংলাদেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে। আমরা চাই প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, কিন্তু তা হতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে।’ তার এই জাতীয়তাবাদী অবস্থান প্রতিবেশী দেশটির নীতিনির্ধারকদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে বিএনপির একক ক্ষমতায়ন বা তারেক রহমানের নেতৃত্ব রোধে এখনো সক্রিয় রয়েছে।
মায়ের অসুস্থতা এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে যখন বিএনপি নেতাকর্মীরা উদ্বিগ্ন, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে ভিন্ন এক যুদ্ধ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা লক্ষ্য করেছেন, জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া মাহফিল করছে এবং তাকে ‘দেশনেত্রী’ হিসেবে সম্মান জানাচ্ছে। কিন্তু পর্দার আড়ালে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াত আগামী নির্বাচনে নিজেদের একক বা নির্ণায়ক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সেক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা তারেক রহমানের জনপ্রিয় নেতৃত্ব।
৫ আগস্টের পর তারেক রহমান যেভাবে প্রতিটি বক্তব্যে রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন, তাতে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাকেই প্রধান প্রতিপক্ষ ভাবছে। ফলে ফেইসবুক ও ইউটিউবে জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের নিয়ন্ত্রণে থাকা কথিত ‘বট বাহিনী’ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা প্রচার করছে, ‘মায়ের মৃত্যুশয্যাতেও ছেলে ফেরার সাহস পায় না, সে কীভাবে দেশ চালাবে?’- যা মূলত সাধারণ মানুষের আবেগকে পুঁজি করে তারেক রহমানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার কৌশল।
তবে গত ১ ডিসেম্বর সব শঙ্কা ও অনিশ্চয়তার মেঘ অনেকটাই কাটিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে হঠাৎ করেই বেগম খালেদা জিয়াকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ‘বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী’ (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) আইন, ২০২১’-এর ধারা ২(ক)-এর ক্ষমতাবলে এখন থেকে খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা এসএসএফ-এর বিশেষ নিরাপত্তা পাবেন।
এই ঘোষণার পরপরই গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন তারেক রহমান। বৈঠকে উপস্থিত এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তারেক রহমানের নিরাপত্তার বিষয়টি সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে এবং এসএসএফ নিরাপত্তা প্রদানের ঘোষণা তার দেশে ফেরার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাটি দূর করেছে।’
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও ১ ডিসেম্বর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, তারেক রহমান দেশে ফিরলে তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বেগম খালেদা জিয়াকে এসএসএফ নিরাপত্তা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি মূলত তারেক রহমানের নিরাপত্তার পূর্বপ্রস্তুতি। সম্প্রতি উপদেষ্টামণ্ডলীর বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্য পাওয়া গেছে।
বিএনপির একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, আগামী ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। তফসিল ঘোষণার পরপরই, বিশেষ করে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের আগেই বা ঠিক ওই সময়েই দেশের মাটিতে পা রাখবেন তিনি। দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে তিনি আগামী বিজয় দিবস উদযাপন করবেন নিজ দেশে, দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে। তফসিল ঘোষণার এই সময়সীমা এবং তারেক রহমানের ফেরার দিনক্ষণ একই সুতোয় গাঁথা।
মায়ের অসুস্থতা, এসএসএফ সুবিধা প্রাপ্তির ঘোষণা এবং আইনি বাধা অপসারণ- সব মিলিয়ে তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথ এখন অনেকটাই পরিষ্কার। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ১ ডিসেম্বর স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘শিগগিরই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন।’ দলের বিশ্বস্ত সূত্রগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, সম্ভবত আগামী সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই তারেক রহমান ঢাকার মাটিতে পা রাখবেন।
মায়ের শিয়রে বসে সন্তানের হাত ধরার সেই চিরন্তন দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় এখন পুরো বাংলাদেশ। তবে সেই ফেরা শুধু আবেগের নয়, সেই ফেরা হবে একটি নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যাত্রারম্ভ। ষড়যন্ত্র, ভূ-রাজনীতি আর অপপ্রচারের জাল ছিঁড়ে তারেক রহমান কবে ফিরবেন, সেটাই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় কৌতূহল।