Image description
বরিশালের বিএনপি নেতাদের শঙ্কা । গণহারে শাস্তি প্রত্যাহার হলে ভুল বার্তা যাবে ভোটারদের কাছে-স্নেহাংশু সরকার কুট্টি, সভাপতি, পটুয়াখালী জেলা বিএনপি ।

পাঁচ আগস্টের পর নানা অপকর্মে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের দায়ে বহিষ্কৃতদের এখনই দলে ফেরানোর পক্ষে নয় বরিশাল অঞ্চলের তৃণমূল বিএনপি। তাদের ফেরালে ভোটের মাঠে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন দলটির জেলা পর্যায়ের নেতারা। অবশ্য অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের শিকার কিংবা সংগঠনিক বিশৃঙ্খলার দায়ে যারা শাস্তি পেয়েছেন, তাদের ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।

ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার পলায়নের পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বিএনপির একশ্রেণির স্বার্থান্বে^ষী নেতাকর্মীরা। দলীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে যার যার এলাকায় হামলা, ভাঙচুর, দখল, চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠেন তারা। বিএনপিও তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে তাদের বিরুদ্ধে। কারও ব্যক্তিগত অপকর্মের দায় না নিয়ে সারা দেশে বহিষ্কার ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় ৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। বিএনপির ইতিবাচক এই পদক্ষেপের বাইরে ছিল না বরিশাল। বিভাগের ৬ জেলা আর ৪৪ উপজেলায় সাংগঠনিক শাস্তির শিকার হন ১৪০ জনের বেশি নেতাকর্মী। যাদের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি বিলকিস জাহান শিরিন থেকে শুরু করে রয়েছেন জেলা-উপজেলার পদধারী অনেক শীর্ষ নেতা। অপকর্মের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ ও দলের অভ্যন্তরীণ তদন্তে প্রমাণ পাওয়ার পর দলীয় পদ-পদবি স্থগিত থেকে শুরু করে প্রাথমিক সদস্য পদ পর্যন্ত বাতিল করা হয় তাদের। পরে অবশ্য ২-১ জনকে আবার ফেরানো হয় দলে। মাঠপর্যায়ে পরিচালিত তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ না মেলায় দলে ফিরিয়ে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের বিএনপি নেতা রুহুল আমিন দুলালকে। এই ঘটনায় প্রশংসাও পেয়েছে বিএনপি। কিন্তু সমস্যা বেঁধেছে এমন কিছু বহিষ্কৃতদের নিয়ে যাদেরকে ফেরালে ভোটের মাঠে জটিলতায় পড়তে পারে দল। গণহারে এদেরকে ফেরানো হলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা জেলা পর্যায়ের নেতাদের। গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বহিষ্কৃত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকর্মীকে দলে ফেরানোর কারণেই এখন এই শঙ্কা তাদের।

৫ আগস্টের পর বেপরোয়া দখল চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের কারণে বরিশালে সাংগঠনিক শাস্তির শিকার হন বিএনপির ৩৪ নেতাকর্মী। গৌরনদী পৌর বিএনপির সভাপতি-সম্পাদকসহ এই তালিকায় আছেন বরিশাল মহানগর বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের দুই আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব। এছাড়া বাকিরা মূল দলসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা।

বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, আমরা এখন সাধারণ মানুষের কাছে যাচ্ছি ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাইতে। দল যে সিদ্ধান্ত দেবে তা মাথা পেতে নেব। তবে কাকে ফেরানো উচিত আর কাকে নয় সে ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে তদন্ত আর আমাদের মতামত নিক কেন্দ্র। এটাই অনুরোধ। এমন কাউকে ফেরানো উচিত হবে না যার কারণে সাধারণ মানুষের প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে।

বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম শাহিন বলেন, সাংগঠনিক শাস্তি প্রত্যাহারের আগে দল অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে নেবে বলে আমার বিশ্বাস। কেন্দ্র এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না যাতে দলের ক্ষতি হয়। বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার বলেন, যেখানে মাত্র ক’দিন পরেই ভোট, সেখানে বহিষ্কৃত কিংবা শাস্তির শিকারদের গণহারে না ফেরানোই উচিত বলে মনে করি।

নানা অপকর্মে দলকে জনগণের কাছে খারাপ হিসাবে তুলে ধরার দায়ে পটুয়াখালীতে শাস্তির শিকার হয়েছেন বিএনপির প্রায় ৩৭ জন নেতাকর্মী। এরমধ্যে কেবল বাউফলেই দলের ১১ পদধারী নেতাকে দেওয়া হয়েছে শাস্তি। এছাড়া পটুয়াখালী সদর ও কুয়াকাটাসহ অন্যান্য উপজেলায় শাস্তির শিকার হয়েছেন বাকিরা। এদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঘরবাড়িতে হামলা ভাঙচুরসহ দখল ও চাঁদাবাজির।

পরিচয় না প্রকাশের শর্তে বাউফল উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, বিএনপি এখন আমাদের ভোট পাওয়ার আশা করছে। অথচ যারা ৫ আগস্টের পর আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করেছে, বাড়ি-ঘরে হামলা করেছে, তাদের যদি আবার দলে ফিরিয়ে আনা হয় তাহলে আওয়ামী লীগের ভোটারদের কাছে কী বার্তা যাবে? তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বহিষ্কৃতদের অনেকে এখনো আমাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। শাস্তি উঠিয়ে নেওয়া হলে দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলছে তারা। এই অবস্থায় তাদের দলে ফেরাবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত বিএনপির।

পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ায় বিএনপির প্রতি আস্থা বেড়েছে মানুষের। আওয়ামী লীগের ভোটাররা পর্যন্ত এখন নিরাপদ ভাবছে আমাদের। এমন পরিস্থিতিতে গণহারে শাস্তি প্রত্যাহার হলে ভুল বার্তা যাবে ভোটারদের কাছে। আমি মনে করি দল ভেবেচিন্তেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

পিরোজপুরে ৫ আগস্টের পর বহিষ্কারসহ নানা সাংগঠনিক শাস্তির শিকার হয়েছেন বিএনপির ১২ নেতাকর্মী। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাইদুল ইসলাম কিসমত বলেন, অনেক জায়গায়ই শাস্তি প্রত্যাহার করে দলে ফেরানো হচ্ছে নেতাকর্মীদের। আমি এর বিরুদ্ধে নই। তবে আমার কথা হচ্ছে, যাদের কারণে জনগণের সামনে দল প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তাদের ফেরানো হলে প্রভাব পড়বে ভোটে। জনসম্পৃক্ত নয় এমন অপরাধের ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে ইতিবাচক ব্যবস্থা নিতে পারে দল।

বরগুনা জেলা বিএনপির ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলুল হক মাস্টার বলেন, অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী, দুপক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে তদন্তের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যদি প্রমাণ হয় শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের শিকার তাহলে তা তুলে নিক কেন্দ্র। আর দোষী প্রমাণ হলে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা ভোটের মাঠে আমরা যেন বলতে পারি বিএনপি কারও০ ব্যক্তিগত অপকর্মের দায় অতীতেও নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে না।

বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে বরিশাল-৫ (সদর) আসনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, এমন অনেক বহিষ্কৃত আছে যাদের ফেরানো হলে শুধু ভোঠের মাঠে বিরূপ প্রতিক্রিয়া নয়, দলের অভ্যন্তরেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমানে ঐক্যবদ্ধ বরিশাল বিএনপি। সবাই মিলে একযোগে কাজ করছে ধানের শীষের পক্ষে। চলমান পরিস্থিতিতে এমন কারও শাস্তি প্রত্যাহার করা উচিত হবে না যাদের কারণে ধানের শীষের বিজয়ের মসৃণ পথটা এবড়ো-খেবড়ো হয়ে যাবে। আপাতত আমাদের কাছে জরুরি হচ্ছে আসন্ন নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া কিংবা দলের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এমন কাউকে ফেরানো ঠিক হবে না বলে আমি মনে করি।