Image description
দলত্যাগী নেতায় শক্তিশালী হাতপাখা

বরিশালের ৩টি নির্বাচনি এলাকায় শক্ত অবস্থানের জানান দিচ্ছে চরমোনাই পীরের দল ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি থেকে আসা সাবেক দুই সংসদ-সদস্যকে সামনে রেখে তাদের এই অবস্থান। তাদের সঙ্গে আছেন দলের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া), বরিশাল-৫ (সদর) ও পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তারা। বিভাগের ২১ নির্বাচনি এলাকার সবকটিতে প্রার্থী দিলেও এ ৩টি আসনে বিএনপির সামনে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা। এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অবশ্য ভোটের মাঠের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না বিএনপি নেতারা। তাদের মতে, দল ছেড়ে যাওয়া মানে দলের ভোট নিয়ে যাওয়া নয়। বিএনপির ভোট যেমন বিএনপিরই আছে, তেমনই এবার ধানের শীষের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এই গণজোয়ারে ভোটের মাঠে শেষ হাসি ধানের শীষই হাসবে।

পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) : একটিমাত্র উপজেলা মঠবাড়িয়া নিয়ে গঠিত এই নির্বাচনি এলাকায় ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী সাবেক সংসদ-সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজী। বিএনপি-জাতীয় পার্টি ঘুরে চলতি বছরের আগস্টে ইসলামী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন চারবারের সাবেক এই সংসদ-সদস্য। যে কোনো মূল্যে সংসদ-সদস্য হওয়ার টার্গেটে ফরাজীর এই দলবদল অবশ্য নতুন নয়। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমবার সংসদ-সদস্য হন জাতীয় পার্টির টিকিটে। সেবার ভোট পান ২৯ হাজার ৮৩৭। পরেরবার ২০০১-এর নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ছেড়ে যোগ দেন বিএনপিতে। ৬৪ হাজার ৯৫৮ ভোট পেয়ে আবার নির্বাচিত হন। ২০০৮-এ তাকে আর মনোনয়ন দেয়নি বিএনপি। সেবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে হেরে যান। ২০১৪ সালে পুনরায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ২৯ হাজার ৩৪২ ভোট পেয়ে যান সংসদে। ২০১৮-এর নির্বাচনে আবার জাতীয় পার্টিতে ফেরেন ফরাজী। লাঙ্গল প্রতীকে ভোট করে নির্বাচিত হন সংসদ-সদস্য। এরপর নামেন আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার চেষ্টায়। জাতীয় পার্টির সংসদ-সদস্য হয়েও সংসদে শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বক্তব্য দিতে থাকেন। অবশ্য তাকে দলে নেয়নি আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টিও দেয় মাইনাস করে। ফলে ২০২৪-এর নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করলেও হেরে যান ফরাজী। এবার তিনি হয়েছেন হাতপাখার প্রার্থী। সকাল-বিকাল পোশাক পালটানোর মতো দল বদলালেও মঠবাড়িয়ায় রুস্তম আলী ফরাজীর রয়েছে ব্যক্তিগত ভোটব্যাংক। বহু বছর বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিয়ে দরিদ্র একটি শ্রেণির কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তিনি। ফলে আগামী নির্বাচনে এখানে বিএনপির সহজ জয়ে বাধা হতে পারেন এই রাজনৈতিক নেতা। যদিও তা মানতে নারাজ স্থানীয় বিএনপি।

পিরোজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম কিসমত বলেন, ‘রুস্তম আলী ফরাজীর চরিত্র বুঝে ফেলেছে মঠবাড়িয়ার মানুষ। তার রাজনীতি যে কেবলই সংসদ-সদস্য হওয়ার জন্য, তা এখন সবাই জানে। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো, নীতি-আদর্শহীন মানুষকে এবার আর ভোট দেবে না ভোটাররা।’

বরিশাল-৫ (সদর) : বিএনপির ভোটের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত এই আসনে ইসলামী আন্দোলনের হয়ে ভোটে লড়বেন দলটির নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করীম। তার বিপরীতে বিএনপির প্রার্থী পাঁচবারের সাবেক সংসদ-সদস্য, হুইপ, সিটি মেয়র ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মজিবর রহমান সরোয়ার। নিরপেক্ষ নির্বাচনে এখানে কখনোই হারেনি বিএনপি। অপরদিকে সিটি ও জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে বেশ কয়েকবার নিজেদের অবস্থানের জানান দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন। সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই খোকন সেরনিয়াবাতের বিরুদ্ধে ভোটে লড়েন ফয়জুল। ভোট জালিয়াতির সেই নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকদের যেমন রাখা হয় হামলা-মামলার মুখে, তেমনই বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাননি বিএনপি-জামায়াতের ভোটাররা। ভোটের দিন আওয়ামী লীগের হামলায় গুরুতর আহত পর্যন্ত হন মেয়রপ্রার্থী ফয়জুল। এতকিছুর পরও ওই নির্বাচনে ৩৩ হাজারের বেশি ভোট পান তিনি। এছাড়া ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮’র জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে প্রতিবার গড়ে ৩০ হাজারের বেশি ভোট পায় হাতপাখা। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ ৮ ইসলামী দলের ঐক্য যদি শেষ পর্যন্ত থাকে আর সবাই মিলে ফয়জুল করিমকে একক প্রার্থী দেয়, তাহলে জয় পাওয়া কঠিন হবে বিএনপির।

ইসলামী আন্দোলনের বরিশাল জেলা সভাপতি মাওলানা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পাঁচবার সংসদ-সদস্য, মেয়র এবং হুইপ ছিলেন। সব মেলালে জনপ্রতিনিধি হিসাবে ২৫/৩০ বছর ছিলেন ক্ষমতায়। দীর্ঘ এই সময়ে কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে বা বরিশালের জন্য কী করেছেন, এর উত্তর চাইবে এলাকার মানুষ। আমি মনে করি, এবার দল নয়, প্রার্থী দেখে ভোট দেবে ভোটাররা। ফয়জুল করিমের বিরুদ্ধে ঠিকাদারির পার্সেন্টেজ আদায়, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, হত্যার রাজনীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ নেই। বাকি সিদ্ধান্ত ভোটের মাঠে জনতার।’

মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার বলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনে এই আসনে কখনোই হারেনি বিএনপি। তাছাড়া সাধারণ মানুষ এবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিএনপির পক্ষে আছে। ইনশাল্লাহ এখানে ধানের শীষের বিজয় হবে।’

পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) : সাগরপারের এই নির্বাচনি এলাকায় প্রায় কখনোই ভোটে জেতেনি বিএনপি। এবার যখন জেতার একটা দারুণ সম্ভাবনা, ঠিক তখনই গোল বেঁধেছে বিএনপি ছেড়ে ইসলামী আন্দোলনে যোগ দেওয়া সাবেক সংসদ-সদস্য মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে। কলাপাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমানের রয়েছে নির্বাচনি এলাকায় বেশ শক্ত অবস্থান। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ-সদস্য নির্বাচন করেছিলেন তিনি। বিএনপি ছেড়ে হাতপাখায় যাওয়া এই নেতার সবচেয়ে বড় অর্জন ২০০১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ৩৮ হাজার ৯৮ ভোট পাওয়া। ষড়যন্ত্রসহ নানা কারণে দলীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে চলতি বছর বিএনপি ছেড়ে ইসলামী আন্দোলনে যোগ দেন মুস্তাফিজুর। এর পরপরই তাকে এই আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি। এখানে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন। নির্বাচনি এলাকার দুই উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, বিএনপির পাশাপাশি বেশ শক্ত অবস্থান ইসলামী আন্দোলনের এই প্রার্থীর। পেশায় চিকিৎসক মুস্তাফিজ গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিয়ে সমর্থন পাচ্ছেন বহু সাধারণ মানুষের। তাছাড়া মোশাররফের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও ভেতরে ভেতরে তার সঙ্গে রাখছেন যোগাযোগ। কেবল বিএনপি নয়, দুই উপজেলায় থাকা আওয়ামী লীগের ভোটাররাও ঝুঁকছেন মুস্তাফিজের দিকে।

পরিচয় না প্রকাশের শর্তে কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী বলেন, ‘৫ আগস্টের পর এখানে চরম মাত্রায় অত্যাচার, নির্যাতন, সন্ত্রাস আর দখলবাজির শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। এখনো চলছে নীরব চাঁদাবাজি। বিশেষ করে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় অর্বণীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছি আমরা। সারা দেশে বিএনপির ৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে দল। অথচ এখানে বহাল তবিয়তে আছে দলের সন্ত্রাসী দখলবাজ চাঁদাবাজরা। ফলে নীরবে অনেকে মুস্তাফিজকে সমর্থন দিচ্ছে।’

পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, ‘কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নেবে না বিএনপি। তাছাড়া পটুয়াখালীতে আমরা কঠোরভাবে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখছি। সর্বস্তরের জনগণ বিএনপির সঙ্গে আছে। সবাই ধানের শীষ প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। আগামী নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে আমরা তার প্রমাণ দেব।’