Image description

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে ভোটগ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ৮ লাখ কর্মকর্তা প্রয়োজন নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। এ ক্ষেত্রে ‘ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা প্যানেল’ প্রস্তুত করতে গিয়ে ভীষণ বিপাকে পড়েছে ইসি। কারণ, বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ভোটের দায়িত্বে না রাখার রাজনৈতিক চাপ রয়েছে ইসির ওপর। সেসব নির্বাচনের পুরো প্যানেল বাদ দিয়ে নতুন প্যানেল প্রস্তুত করা প্রায় অসম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, দলদাস ট্যাগধারীদের ঢালাওভাবে বাদ দিয়ে নির্বাচনী প্যানেল করা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভব। তদুপরি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে দক্ষতার সঙ্গে প্যানেল প্রস্তুত করতে হবে ইসি ও সরকারের। অন্যথা সেই নির্বাচন নিয়েও সৃষ্টি হতে পারে নতুন বিতর্ক। সব মিলিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে ভোটের মাঠ সাজাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ইসি।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যাঁদের বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই বিগত সরকারের সময় ‘বঞ্চিত’ দাবি করে এখন পদায়িত হয়েছেন। কাজেই তাঁরাও কোনো না কোনো দলের ট্যাগে ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম কর্মকর্তাদের পদায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ভাগবাটোয়ারার অভিযোগ তুলেছেন। তাই দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তা বাছাই করা কঠিন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বাদ দিতে হবে। পাশাপাশি অন্য কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) দেখে ইসির সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। যে কোনো মূল্যে ভালো ও দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে প্যানেল তৈরি করে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে ইসির।

বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন অনুযায়ী নির্বাচনী দায়িত্বে সবার উপরে থাকেন রিটার্নিং অফিসার। এরপর সহকারী রিটার্নিং অফিসার। তাঁর অধীনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের বলা হয় প্রিসাইডিং অফিসার। প্রিসাইডিং অফিসারের সহায়তায় থাকেন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার। শেষ ধাপে পোলিং অফিসার। নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কাঠামো বিধি অনুযায়ী এভাবেই সাজানো।

নির্বাচনী আইন ও অতীতের রেকর্ডে দেখা গেছে, রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসক। গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন ৬৬ জন। তাঁদের মধ্যে ৬৪ জন জেলা প্রশাসক, দুইজন বিভাগীয় কমিশনার। কার্যত এসব রিটার্নিং অফিসারের অধীনেই থাকে ভোটের সার্বিক দায়িত্ব। তাই তাঁদের বলা হয়ে থাকে, ভোট পরিচালনার সর্বেসর্বা। বিগত সময়ের বিতর্কিত নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারদের বিরুদ্ধে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে বিস্তর। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা ইউএনওদের সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন কর্মকর্তা বা সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহকারী রিটার্নিং অফিসার করা হয়। এ দুই ধাপের কর্মকর্তা নিয়োগে যাচাই-বাছাই হয় সাধারণত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ইসিকে এই মন্ত্রণালয়ের সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়। আওয়ামী লীগের ১৭ বছরের শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের অনেকেই জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ক্ষেত্রবিশেষে এখনো রয়েছেন। এ ছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যাঁরা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন তাঁরা বিগত সরকারের সময় বিএনপি-জামায়াতের তকমায় বঞ্চিত ছিলেন বলে দাবি করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর যাঁদের পদায়ন করা হয়েছে, তাঁরা বড় দুটি রাজনৈতিক দলের অনুগত কর্মকর্তা বলে গুঞ্জন রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের ভেতর থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে চলছে নানান আলোচনা।

এরপর নির্বাচনী দায়িত্বে থাকেন প্রিসাইডিং অফিসার। প্রতিটি নির্বাচনের কেন্দ্র প্রধান হিসেবে কাজ করেন তাঁরা। সাধারণত প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পান সরকারি, আধা-সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত/আধা স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও প্রতিষ্ঠানের প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারাও প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এখানে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে লিখিত দাবি করা হয়েছেÑ ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা হাসপাতালসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে যেন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ করা না হয়। এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগে স্বচ্ছতা দাবি করছে। 

প্রিসাইডিং অফিসারের সহকারী হিসেবে কাজ করেন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার। একটি কেন্দ্রে একাধিক বুথ বা ভোটকক্ষ থাকে। আর প্রতিটি ভোটকক্ষের দায়িত্বে থাকেন একজন করে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার। আর প্রত্যেক ভোটকক্ষে একজন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে দুজন করে পোলিং অফিসার থাকেন। সাধারণত ভোটকক্ষে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সহায়তার জন্য তাঁরা নিয়োজিত থাকেন। পোলিং অফিসারদের কাজই থাকে ভোটার তালিকা দেখে ভোট দিতে আসা ভোটারকে শনাক্ত করা।

ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত করতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতির কথা স্বীকার করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনও। বিতর্কিত কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, গত তিন নির্বাচনে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের নিয়ে সবাই সন্দেহ পোষণ করছেন। অনেকে এমন দাবিও করছেন, গত তিন নির্বাচনে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা যেন ধারেকাছেও আসতে না পারেন। এখন ১০ লাখ লোকের (ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা) মধ্যে বাদ দিতে গেলে কম্বলই উজাড় হয়ে যাবে। লোম বাছতে গিয়ে কম্বল উজাড়Ñ অবস্থা হয়েছে আমার।

সিইসি তাই মন্দের ভালো নীতি অনুসরণ করতে চান। এ জন্য তিনি বলেছেন, অন্তর্যামী হলেন একমাত্র আল্লাহ। (কর্মকর্তাদের) অন্তরের মধ্যে দলীয় মনোবৃত্তি আছে কি না, জানা সম্ভব নয়। কিন্তু দলদাসের মতো কাজ করতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত করব। মনের মধ্যে রাজনৈতিক মনোবিলাস থাকলেও কাজে যেন প্রতিফলন না হয়, তা নিশ্চিত করা হবে।

বিগত নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের বাদ দিলেই দলনিরপেক্ষ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা প্যানেল হয়ে যাবেÑ এমনটি বিশ্বাস করেন না টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, এটি বাস্তবে খুবই কঠিন কাজ। কারণ, যাঁরা পূর্বের নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা সবাই সরকারদলীয় প্রভাবে ছিলেন; এমনটি বলা সব সময় যৌক্তিক নয়। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে দলনিরপেক্ষ অনেকেই আছেন। তাই ঢালাওভাবে সবাইকে বাদ দেওয়া উচিত নয়। সরকার বা নির্বাচন কমিশন যদি চায়, তবে অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখা যেতে পারে কারা পূর্বে অবৈধ বা প্রভাবিত নির্বাচনে সহায়তা করেছিলেন। শুধু তাঁদেরই দূরে রাখা উচিত।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা শতভাগ দলীয় প্রভাবমুক্ত কি না, সেটা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে প্রজাতন্ত্র কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যাঁরা দীর্ঘদিন বঞ্চিত ছিলেন বা বিগত সরকারের সময় বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল যাঁদের, এবার তাঁদের নতুন করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও দলীয় প্রভাবের ছায়া থাকতেই পারে। ঢালাওভাবে ধারণা করাটা ভুল হবে যে, বিগত সরকারের সময়ের কর্মকর্তারা ‘দলীয়’, আর বর্তমানে যাঁরা আছেন, তাঁরা ‘নিরপেক্ষ’। এ জন্য প্রত্যেক কর্মকর্তার ট্র্যাক রেকর্ড বা কর্মজীবনের এসিআর যাচাই করা উচিত। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা সন্দেহ আছে, তাঁদের কাজের ইতিহাস অনুসন্ধান করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলি আমাদের সময়কে বলেন, ইসির উচিত যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততা দেখে নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগ করা। যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নিয়োগ করে ভালো কাজটা করিয়ে নেওয়াটাই হচ্ছে ইসির দক্ষতা। এবং সেটাই উত্তম।

আগামী নির্বাচনে কোন পদে কতজন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা

রিটার্নিং অফিসারের সংখ্যা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে গত নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ছিলেন ৬৬ জন। আর প্রিসাইডিং অফিসার ৪২ হাজার ৭৬১ জন। সাধারণত যতগুলো কেন্দ্র থাকে, ততজন প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ করা হয়। এ ছাড়া ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৪৯ জন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার দরকার। পোলিং অফিসার লাগবে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ২৯৮ জন। মোট ৭ লাখ ৭৬ হাজার ৭০৮ জন।