Image description

বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হয়, যা শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনে গড়ায়। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কয়েকজন সাহসী ও দূরদর্শী তরুণ নেতা- তাদেরই একজন সারজিস আলম। 

তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন ছিল ছাত্রসমাজের অন্তর্গত চেতনার বিস্ফোরণ। কোটা সংস্কার আন্দোলন বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটা ছিল মানুষের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ আর সমাজের প্রতি দায়বোধের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ। আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তে কেবল ছাত্র-ছাত্রীরা নয়, সাধারণ জনগণও নতুন এক চেতনায় জেগে উঠেছিল।’ 

সারজিস বলেন, তখন মনে হয়েছিল ছাত্ররা যদি নেতৃত্ব না নেয়, তাহলে জাতি আরও পিছিয়ে পড়বে। কোটা আন্দোলনের সময় আমরা যেমন রাজপথে ছিলাম, তেমনই বিশ্লেষণেও ছিলাম। প্রতিটি দিন, প্রতিটি সরকারি পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করে বুঝে নিয়েছিলাম যে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো কেমন করে বৈষম্যমূলক হতে পারে। তখন ভাবলাম যদি আমরা চুপ থাকি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও আমাদের কোনো জবাব থাকবে না।

এই দায়বোধ থেকেই আমরা নামি। কারণ, আমাদের কারো তো কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। আমরা তো ক্যারিয়ার কিংবা সুবিধা পাওয়ার জন্য নামিনি। বরং আমরা জানতাম, নামলে হয়তো গ্রেফতার হবো, হয়তো নিখোঁজ হবো, হয়তো পরিবার ভেঙে যাবে। তবু মনে হয়েছিল এই দেশটা তো আমাদেরও, এ দেশের ন্যায্যতার প্রশ্নে যদি ছাত্রসমাজ না দাঁড়ায়, তাহলে আর কে দাঁড়াবে?” 

সারজিস আরো বলেন, ‘আমরা নেতৃত্ব নয়, আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছি। এই আন্দোলনের মূল ভাবনা ছিল একক কোনো নেতা বা ব্যক্তির ওপর নির্ভর না করে সমন্বিত ও গণতান্ত্রিকভাবে একটি শক্তিশালী ছাত্র আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলা।’

তরুণ এই নেতা বিশ্বাস করেন যে প্রকৃত পরিবর্তন আসে সংগঠিত জনতার ঐক্য থেকে, যেখানে সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করে, তখন ব্যক্তিবাচক ‘নায়ক’ বাদে সমষ্টিগত শক্তি সামনে আসে।

পঞ্চগড়ের আটোয়ারী থেকে উঠে আসা এই তরুণ প্রথমে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মাধ্যমে, পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অমর একুশে হল থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির প্রতি হতাশ হয়ে তিনি ২০২২ সালে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন।

২০২৪ সালে তিনি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সংগঠক হিসেবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় হন, যা দ্রুত রূপ নেয় সারাদেশব্যাপী এক গণআন্দোলনে।

আন্দোলনের মধ্যমুহূর্তে গ্রেফতার, নির্যাতন এবং রাজপথের সংঘর্ষেও তিনি পিছু হটেননি। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরও সারজিস স্পষ্টভাবে বলেন,‘আমাদের লক্ষ্য পূর্ণ হয়নি, আমরা ফ্যাসিবাদের স্থায়ী অবসান চাই।’ এই বক্তব্যেই তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও সংগ্রামের গভীরতা স্পষ্ট হয়।

আন্দোলনের পর তিনি ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর  সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র প্রধান সংগঠক হিসেবে যুক্ত হন। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পান তিনি। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের পথে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং মানবিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে গড়ে ওঠা নতুন এই ধারার রাজনীতিতে সারজিস আলম আজ এক গুরুত্বপূর্ণ নাম।

এ প্রেক্ষাপটে, এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে সারজিস আলম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) মুখোমুখি হন। এতে উঠে এসেছে তার রাজনৈতিক যাত্রা, আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে তার ভাবনা। 

সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

বাসস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আপনার ছাত্রজীবন কেমন ছিল? বিশেষ করে শুরুটা কেমন ছিল, আর আপনি কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?

সারজিস আলম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার জীবনের অন্যতম বড় সাফল্য ছিল। আমি প্রথম ঢাকায় আসি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু আমার কলেজের কাছাকাছি যে এলাকা, ওই এলাকাতেই ছিলাম। আর ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো আসা হয়নি।  যখন প্রথম আসি, প্রথম বর্ষে, মাথায় একটা জিনিসই ছিল যে হলে থাকতে হবে। কারণ আমি কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করে হলে থাকার সুবিধা অসুবিধাগুলো জানতে পারি।  তারা বলে যে হলে থাকলে অবশ্যই ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, গেস্টরুম করতে হয়। কিন্তু থাকা-খাওয়া, রিডিং রুম সুবিধা বা পরিবেশ খুবই ভালো। আর গ্যাসের সমস্যা, বিদ্যুতের সমস্যা বা অন্যান্য যে সমস্যা এসব থেকে হলে একদম মুক্তি। যাই হোক ঢাকায় আমার কোনো আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত ছিল না তা না। আমার ঢাকায় আত্মীয় ছিল, কিন্তু এতটা কাছের না যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই তাদের বাসায় থেকে যাওয়া যেত। এরপর অমর একুশে হলের মত একটি তুলনামূলক শান্ত ও নিরিবিলি হলে থাকার সুযোগ পাই। সেই হলেই আমার ছাত্রজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয়। প্রথমদিকে গণরুমে থাকতে হয়েছে। চার সিটের রুমে প্রায় ৪০ জন থাকত। ঘুমাতে হতো মেঝেতে। যদিও এই অমানবিক অবস্থা তখন আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হতো। কারণ, সবাই এতে অভ্যস্ত ছিল। সকালে ক্লাস, বিকেলে টিউশনি, রাতে গণরুমে ঘুম এটাই ছিল রুটিন। কিন্তু তবুও মনে হতো, আমি একটা বড় কিছু অর্জনের পথে আছি। সেই কষ্টগুলোকে সহ্য করার শক্তি আসত ভেতরের স্বপ্ন থেকে। প্রথম বর্ষে কখনও মনে হয়নি এগুলো মানুষের ওপর চাপ বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কারণ আমার আশেপাশে হাজার শিক্ষার্থী একই রকম জীবনযাপন করছে। সিনিয়ররা জুনিয়রদের সচেতন করতে পারতেন না, কারণ ছাত্রলীগের ভয় কাজ করত। জানতে পারলে নিশ্চিত হল থেকে বের করে দেওয়া হতো। 

বাসস: আপনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? কীভাবে যুক্ত হলেন, আর পরে কেন সরে দাঁড়ালেন?

সারজিস আলম: ছাত্ররাজনীতি শুরুতে আমার কাছে একটা রোমাঞ্চকর ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র মনে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেককে দেখতাম ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছে। প্রথমে আমিও তাদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। অতিথি কক্ষে যেতাম, স্লোগান শিখতাম, নেতাদের বক্তৃতা শুনতাম। মনে হতো, ছাত্রদের জন্য কিছু করার এটিই শ্রেষ্ঠ পথ।

কিন্তু ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত বিভ্রান্তি তৈরি হতে থাকে। বুঝতে পারি, এখানে একটা ভয়ের সংস্কৃতি আছে। অতিথি কক্ষে (গেস্টরুমে) না গেলে ‘ভালো ছাত্র’, ‘ভবিষ্যতের নেতা’ হওয়া যায় না। অতিরিক্ত আদব-কায়দা না করলে তিরস্কার করা হয়। স্বতঃস্ফূর্ততা নেই, বরং একটা অদৃশ্য নিয়ম-কানুনের বাঁধনে সবাই আবদ্ধ। ২০১৮ এর আন্দোলনে আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল থেকে একটা মিছিল আসে। ওই মিছিলটা রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত আসে। ওখানে আমি একদম সামনে ছিলাম এবং স্লোগান দিয়েছিলাম। তখন থেকেই বিবেকের একটা তাড়না অনুভব করি। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন আমার চোখ পুরোপুরি খুলে দেয়। আমি ফেসবুকে কিছু পোস্ট করেছিলাম, যেখানে ছাত্রলীগের কিছু নেতার কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলি। এরপর আমাকে অতিথি কক্ষে ডেকে নেওয়া হয়, জেরা করা হয়, পোস্ট মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়। এক প্রকার হুমকির মুখেই তখন লেখালেখি বন্ধ করে দিতে হয়। আমাকে বলা হয়, ‘রাজনীতি করতে চাইলে লেখালেখি বন্ধ করতে হবে, আর লেখালেখি চালিয়ে যেতে চাইলে রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে’ তখন আমি দ্বিতীয়টিকে বেছে নিই। এই সিদ্ধান্তে অনেকেই অবাক হয়েছেন কারণ ছাত্রলীগ আমাকে হলের সহ সভাপতির পদ দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি আমার ইচ্ছার প্রতি অনড় থেকে, রাজনীতি না করে লেখালেখি চালিয়ে যাই এবং চাকরি বা বিসিএসের পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি অব্যাহত রাখি। রাজনীতির আদর্শগত স্বপ্ন আর বাস্তবের গা-জোয়ারি, তোষামোদ ও দমননীতি এই দুইয়ের মধ্যে গভীর পার্থক্য বুঝতে পারি। আমি এমন রাজনীতির অংশ হতে পারিনি, যেখানে নিজের বিবেক বিক্রি করতে হয়। নেতৃত্ব মানে যদি দম্ভ, দুর্ব্যবহার আর অন্যায়কে চুপচাপ মেনে নেওয়া হয়, তবে সে নেতৃত্ব আমার নয়। ফলে আস্তে আস্তে আমি রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিই।

বাসস: আপনি ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর কী পরিবর্তন আসে? আপনি কীভাবে এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন? এবং আপনার জীবনে এর প্রভাব কেমন ছিল?

সারজিস আলম:  ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন ছিল আমার জীবনের এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। নির্বাচনে আমি আমার হলে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হই। অনেকেই যেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়, সেখানে আমি একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন করে এই স্থান অর্জন করি। এতে আমার প্রতি ছাত্রদের আস্থা প্রমাণিত হয়। আমি সর্বকনিষ্ঠ ছিলাম কিন্তু সদস্যদের মধ্যে সর্বোচ্চ আর পুরো হলে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলাম। 

যাইহোক ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে মনোনীত হয়েও, আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলিনি। ডিবেট সার্কিট, সংস্কৃতি ক্লাব থেকে শিক্ষার্থীরা মনোনয়ন পেয়েছিল। একুশে হলে ছাত্রলীগ মনোনয়ন দিয়েছিল ১৩ জনকে, কিন্তু নির্বাচিত হয়েছিল সাতজন। অন্যান্য হলে ভোটে বাধা দেওয়ার অভিযোগ থাকলেও, আমাদের হলে সেসব ঘটেনি।

আমি সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে। মোটামুটি ৯০০ জন ভোটার, আমার সংগ্রহ ৬২৪ ভোট, এতে ভেবেছি, আমি শুধু একজন ছাত্র না; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিনিধি। এই জয়ের পর নিজের বিশ্বাসে অটল থাকার ক্লান্তিহীন সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখি এবং অনেক বেশি আত্মসমালোচক হয়ে উঠি।

কারণ, এখন আর আমি শুধু একজন শিক্ষার্থী নই, আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন প্রতিনিধি। আমি চেষ্টা করতাম নিজের কাজ দিয়ে মানুষের আস্থা বজায় রাখতে। কিন্তু আবারও বাস্তবতা আমাকে হতাশ করে। নতুন হলে সভাপতি আসার পর শুরু হয় অতিথি কক্ষে জোর করে ছাত্রদের তোলা, অকারণে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলা, রাজনৈতিক চাটুকারিতা ইত্যাদি। আমি এসবের বিরোধিতা করি, আবার অনেক সময় চুপ থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিই। কারণ আমি বুঝতে পারি আমার অবস্থান আর তাদের আদর্শ এক নয়। একসময় আমি আর কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যেতাম না, অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতাম। আমি যে রাজনীতির স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম, সেটা তো এখনকার দলীয় চর্চার মধ্যে নেই। নেতৃত্বে গিয়ে যদি নিজের আত্মমর্যাদাই হারাতে হয়, তবে সে নেতৃত্ব আমার দরকার নেই।

বাসস: ২০২৪ এর কোটা আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হলেন? কীভাবে সবাইকে সংগঠিত করলেন? প্রথম দিকের গল্পগুলো শুনতে চাই।  

সারজিস আলম: ৫ জুন বিকেলে খবর এল সরকার ১৮ নম্বর পরিপত্র বাতিল করেছে। আমি তখন সায়েন্স লাইব্রেরিতে পড়ছিলাম। মাথায় যেন বাজ পড়লো। সেদিন বিকেলেই আমার ভেতরে একটা ঝাঁকুনি কাজ করল, বুঝতে পারলাম, এটা আর শুধু একটা পরিপত্র নয়, এটা সরকারের পক্ষ থেকে একটা ঘোষণা। সরকার চাইল বলেই এটা বাতিল হলো। এই আন্দোলনটা হবে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। আর সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়ালে আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। বিসিএস পরীক্ষা ভালো দিয়েও চাকরি না পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, ভেরিফিকেশনে বাদ পড়ে যেতে পারি।

তবু সেদিন রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিই যা হয় হোক, আমি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হব। আমার বিসিএস না হলে না হবে। অন্তত আমি প্রিলি-রিটেন-ভাইভা পর্যন্ত দিয়ে দেখিয়ে দেব আমাকে বাদ দিলে সেটা হবে অন্যায়। আমার তখনকার মানসিকতা ছিল যদি কিছু না হয়, তাহলে দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করব, চাকরি করব, কিন্তু এই অনৈতিকতার একটা বিহিত আমি দেখে ছাড়ব।

সেদিন রাতেই, ৫ জুন রাত ১১টার দিকে বাকেরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। সে জানতো যে আমি সায়েন্স লাইব্রেরির অ্যাডমিন প্যানেলের একজন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করি। এর আগে আমরা মোকাররম ভবনের পাশে ক্যাফেটেরিয়ার দাবিতে একটা ছোট আন্দোলন করছিলাম। সেখানে খাবারের দোকানগুলো উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই। শিক্ষকদের জন্য তো ক্যাফেটেরিয়া আছে, কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ ছাত্ররা সেখানে ২০০ টাকা দিয়ে খেতে পারি না। এই সূত্র ধরেই বাকের আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাকের আমাকে বলেন, ৬ জুন সকালে আমরা সোশ্যাল সায়েন্সের সামনে বসব। আমি শোয়েব ভাইসহ আরও দুইজন বন্ধুকে নিয়ে যাই সেখানে। বাইক থেকে নেমে হেঁটে যেতে যেতে মনে পড়ে, আমার বন্ধু হাসনাতকে ডাকি সে ভালো অ্যাকটিভিস্ট, ফেসবুকে ভালো রিচ আছে। ভাবলাম, তাকে যুক্ত করতে পারলে আন্দোলনের প্রভাব বাড়বে। আমি তখনো জানতাম না, বাকের-নাহিদরা আগেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

সেখানে দেখি নাহিদ, আসিফ, কাদের, মাহিন, রিফাত, হান্নান, আবু সাঈদ ভাইসহ অনেকেই ছিলেন। তবে বাকের ছাড়া কাউকে আমি চিনতাম না। পরে ভিডিওতে দেখি তারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল। আমি চিনতাম কোটা সংস্কার আন্দোলনের নূর ভাই, রাশেদ ভাই, ফারুক ভাই, আখতার ভাই, হাসান আল মামুন ভাই এইসব মানুষদের।

৬ জুন শহীদ মিনারে আমরা প্রথম মিছিল করি। সায়েন্স লাইব্রেরি ও সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে আলাদা আলাদা মিছিল গিয়ে শহীদ মিনারে একত্র হই। সেখানে নাহিদ উপস্থাপনা করে, আমিও বক্তৃতা দিই। তারপর রাতে বটতলায় আলোচনা হয়। শুক্র ও শনিবার তো ক্যাম্পাস ফাঁকা থাকবে, তাই কর্মসূচি রোববার (৯ জুন) করা হবে। এরপর ধীরে ধীরে আন্দোলনটা গুছিয়ে আনা শুরু হয়। আমি নিজেও তখন পঞ্চগড় থেকে একটা ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে দিই। কেন কোটা সংস্কারের এই আন্দোলন যৌক্তিক, কেন এটা প্রয়োজন। এইভাবে ধীরে ধীরে আমরা সবাই আমাদের জায়গা থেকে কথা বলতে থাকি, যোগাযোগ করি, তাদের কেউ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে, কেউ ঢাবি হলে, কেউ বাইরে থেকে। শেষ পর্যন্ত, আমরা ১ জুলাই সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে মিছিল শুরু করি, রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত যাই। সেখান থেকে আন্দোলনের মূল পথচলা শুরু হয়। 

বাসস: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামটি কখন ও কীভাবে আসে? আন্দোলনের একতা গঠনের জন্য এই নামের গুরুত্ব কী ছিল?

সারজিস আলম:  আমরা চেয়েছিলাম আমাদেরকে একক নেতা হিসেবে না দেখা হোক। বরং একটা সমন্বয় কাঠামো থাকুক। একই ব্যানারে, একই কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হোক। এটাই ছিল দ্বিতীয় স্ট্র্যাটেজি। কারণ আলাদা আলাদা ব্যানারে থাকলে, আলাদা আলাদা নেতাদের প্রভাবিত বা দমন করা সহজ। একক প্ল্যাটফর্ম হলে সেটা কঠিন। সেই জায়গা থেকে আমরা নাম দিলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রথমে বিভিন্ন ভার্সিটির নামসহ ব্যানার আসছিল, যেমন ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। পরে একরকমভাবে শুধুই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে সবাই আসতে শুরু করল। এতে আন্দোলনের একতা তৈরি হলো, বিভাজন কমে গেল। আমার মনে আছে, আমরা অন্তত ২০টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম পাবলিক, প্রাইভেট মিলিয়ে। এগুলো করতাম আমরা নিজেরা, আমাদের দলের অন্যান্যরা।

বাসস: হল কেন্দ্রিক ছাত্রদের সংগঠিত হওয়া এবং গ্রুপভিত্তিক আন্দোলনের কৌশল কীভাবে তৈরি হলো?

সারজিস আলম: আগে কী হতো, জানেন? কোনো শিক্ষার্থী যদি হলে থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে চাইতো, তাকে গেটেই দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। ছাত্রলীগের ছেলেরা গেটেই থাকতো, বের হতে চাইলে তাকে জেরা করত, ভয় দেখাত, কিছু ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে বাধা দিত। আবার কেউ একা হলে ঢুকতে গেলেও তাকে আটকে দেওয়া হতো। পুরো বিষয়টাই ছিল আতঙ্ক তৈরি করা, যাতে কেউ ব্যক্তিগতভাবে আন্দোলনে যোগ দিতে না পারে।

কিন্তু এবার (২০২৪ সালের আন্দোলনে) আমি দেখলাম, পুরো ব্যাপারটাই বদলে গেছে। শিক্ষার্থীরা এবার আলাদা কৌশল নিয়েছে। তারা একা একা বের না হয়ে, একসাথে বের হয়েছে। এক হলে ঢুকে, সেখান থেকে ৫/৬ জনকে ডেকে নিয়ে সবাই একসাথে বের হয়ে আসছে। আবার হলে ঢোকার সময়ও সবাই একসাথে ঢুকছে।

এই স্ট্র্যাটেজিটা আসলে একদিনে তৈরি হয়নি। এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে মাঠের অভিজ্ঞতা থেকে। আমরা দেখেছি, যখন কেউ একা থাকে, তখন ভয় কাজ করে। রুমে বসে মানুষ ভাবে, ‘আমি যাব, যাব।’ কিন্তু বাইরে কাউকে দেখতে না পেলে সে আর বের হয় না। কিন্তু যখন কেউ দেখে, ৫/৬ জন একসাথে রুমে এসে ডাকছে ‘চল, নিচে নাম’ তখন একটা মানসিক জোর তৈরি হয়। তখন সে আর একা না, তখন সে একটা দল।

এই পুরো প্রক্রিয়াটা সাইকোলজিক্যাল ব্যারিয়ার ভাঙার একটা কার্যকর পদ্ধতি ছিল। আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, সব হলে কী কী ঘটেছে তাতে আমার একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। আমি ২০২১ সালের শিক্ষার্থী, তাই সেই সময়কার হলের সিনারিও আমার খুব পরিষ্কার।

আমার হলে কী হতো? কয়েকজন সিনিয়র ভাই ছিলেন তারা সবাই বিসিএসের পড়ায় ব্যস্ত, কিন্তু তারা ছাত্রলীগেরও গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে ছিলেন। কেউ ছিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারি, কেউ সাংগঠনিক সম্পাদক। এসব পোস্ট ছাত্রলীগে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো অল্প কয়েকজনই পায়। আমার রুমমেট শুভ, আন্দোলনের সময় খুব সক্রিয় ছিল, ওর নাম ছাত্রলীগের জয়েন্ট সেক্রেটারির তালিকায় তিন বা চার নম্বরে ছিল। কৌশিক নামে আরেকজন ছিল, সে দুই নম্বরে ছিল। এই ছেলেরা আন্দোলনের সময় পক্ষ নিয়েছিল শিক্ষার্থীদের। ছাত্ররা কী করত? নিজেদের মতো একটা গ্রুপ ছিল। তারা লনে নামতো, তারপর ডাইনিং থেকে ডাকতো, রিডিং রুম থেকেও ডাকতো। তারপর লনে কিছুক্ষণ স্লোগান দিত। এটা এক ধরনের বার্তা ছিল ‘নামো, সময় হয়ে গেছে।’ সেই স্লোগান শুনে বাকি শিক্ষার্থীরাও নেমে আসতো। পুরো হল জেগে উঠতো।

এইভাবে একটা সময় তৈরি হলো। প্রত্যেকটা হলই যেন নিজে নিজে দায়িত্ব নিয়ে আন্দোলনে নামছে। ব্যানার এলো ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। কিন্তু এই দায়িত্বটা আমরা কেউ গিয়ে দিয়ে আসিনি। এই দায়িত্ব শিক্ষার্থীরা নিজ থেকেই নিয়েছে। এর মধ্যে একটা নিজস্ব অনুভব কাজ করছিল ‘আমরাই যদি না নামি, তাহলে কে নামবে?’ একটা মানসিক জাগরণ তৈরি হয়েছিল। হলগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে দায়িত্ব নিয়েছিল।

আমরা যাদেরকে চিনি, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। যেমন, ছেলেদের হলগুলোতে আমরা জানতাম কে কে আছে। তাদেরকে বলতাম ‘তোমরা কখন আসতেছো, রেডি হচ্ছো কি না?’ এভাবেই ১৮টা হল থেকে একেকটা করে মিছিল নামতে লাগলো। যদি প্রতিটা হলে ১০০ জন করেও নামে, তাহলে তো ১৮০০ মানুষ! আর এই মানুষগুলো যখন একসাথে শাহবাগে দাঁড়ায়, তখন তার প্রভাব হয় বিশাল।

তখন গণমাধ্যম বলে ‘পাঁচ হাজার মানুষ শাহবাগে।’ কেউ বলত ‘১০ হাজার।’ আমরা জানি, সেটা হয়তো ১৫শ কিংবা দু’হাজার, কিন্তু তারা একসাথে ছিল বলেই সেটা দেখায় বিশাল। মানুয়ের সংখ্যার চেয়ে অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায় তাদের ঐক্য। এই পদ্ধতিটা আমাদের আন্দোলনকে শুধু বাঁচিয়ে রাখেনি, এটা আতঙ্কের অবসান ঘটিয়েছে। কারণ একা মানুষ ভয় পায়, কিন্তু দলবদ্ধ মানুষ সাহস পায়। আমাদের আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় মানে ১৪ জুলাই পর্যন্ত এই কৌশলটা আমাদের সবচেয়ে কার্যকর শক্তিগুলোর একটি ছিল।

বাসস: আপনাদের আন্দোলনের কৌশল কী ছিল? কীভাবে নেতৃত্বের সমন্বয় ও সংগঠন চালানো হয়েছিল? 

সারজিস আলম: আমাদের স্ট্র্যাটেজি ছিল মূলত আমরা তিনজন নাহিদ, আমি আর হাসনাত, সিনিয়র সমন্বয়কের যে প্রথম তালিকাটা বের হয়েছিল, সেখানে নাহিদ ছিল এক নম্বরে, তারপর আমি, তারপর হাসনাত। আমরা তিনজন মিলে একটা কোর টিম তৈরি করেছিলাম। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, যে কোনো ঘোষণা বা প্রেস ব্রিফিংয়ে আমরা তিনজন একসাথে উপস্থিত থাকবো। এছাড়াও, বাকের, রিফাত রশিদ, হান্নান মাসুদ, মাহিন, কাদের এরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল।

শাহবাগ মঞ্চে তিনজনই একসাথে কথা বলতাম। একটা সময় আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, মঞ্চে যেতে চাইছিলাম না। তখন পিজি হাসপাতালের পাশের বটগাছটার নিচে বসেছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নাহিদ আমাকে ওখান থেকে ডেকে নিয়ে আসে। বলল, ‘মঞ্চে না থাকলে অনেকে ধরে নেবে তুমি সরে গেছো’। কারণ আমি তো ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা, এটার কারণে যদি মঞ্চে আমি না থাকি, সেটাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হতে পারে। কিন্তু আমি থাকা মানেই একটা ম্যাসেজ এই, আন্দোলনের ভেতরে ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেও কেউ আছে, এবং এটা একটা শক্তি। এই মঞ্চটা সরকারবিরোধী ট্যাগ পায়নি, তার একটা কারণ আমি ছিলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এই আন্দোলনটা সাহস পেয়েছিল কারণ হলে ছাত্রলীগ করে আসা একটা পরিচিত মুখ মঞ্চে ছিল, যার মাধ্যমে অন্য ছাত্ররাও অনুপ্রাণিত হয়েছে। একধরনের সুরক্ষা বা প্রোটেকশনের অনুভূতিও কাজ করেছিল যদি কিছু হয়, আমাদের মতো কেউ পাশে থাকবে।

আমরা চেয়েছিলাম আমাদেরকে একক নেতা হিসেবে না দেখা হোক। বরং একটা সমন্বয় কাঠামো থাকুক। একই ব্যানারে, একই কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হোক, এটাই ছিল দ্বিতীয় স্ট্র্যাটেজি। কারণ আলাদা আলাদা ব্যানারে থাকলে, আলাদা আলাদা নেতাদের প্রভাবিত করে বা দমন করা সহজ। একক প্ল্যাটফর্ম হলে সেটা কঠিন।

আমরা এই কাঠামোয় সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়ক নামে দুই লেয়ারের নেতৃত্ব তৈরি করি। একজনকে যদি গুম, গ্রেফতার বা টার্গেট করা হয়, অন্য লেয়ার দায়িত্ব নিতে পারবে। এটাই ঘটেছিল যখন আমরা ডিবি অফিসে ছিলাম, এক লেয়ার চলে গেল, আরেকটা দাঁড়িয়ে গেল। 

বাসস: ১৪ জুলাই বঙ্গভবনে স্মারকলিপি দিতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? ওইদিন রাতে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বক্তব্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল?

সারজিস আলম: যখন আমরা বঙ্গভবনে স্মারকলিপি দিতে যাই, তখন একটা আশা ছিল যে রাষ্ট্রপতি হয়তো নিজে স্মারকলিপি গ্রহণ করবেন। কিন্তু উনি নিজে না এসে সামরিক সচিবের মাধ্যমে স্মারকলিপি গ্রহণ করালেন। ওখানে আমাদের বসার জায়গাটাও তেমন ছিল না, আমরা ভেবেছিলাম হয়তো ভেতরে বসানো হবে। তো প্রত্যাশার তুলনায় কিছুটা হতাশই হয়েছি।

এরপর আমাদের প্রত্যাশা ছিল শেখ হাসিনা চীন থেকে ফিরে এসে আন্দোলন নিয়ে ইতিবাচক কিছু বলবেন, হয়তো বলবেন ১৮-এর পরিপত্র পুনর্বহাল হচ্ছে। কিন্তু উনি যে টোনে বক্তব্য দিলেন, সেটা ছিল অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ। ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনীরা পাবে না, রাজাকারের নাতি-নাতনীরা পাবে?’ এইভাবে বলার প্রয়োজন ছিল না।

বক্তব্যের শব্দ যেমন বিষাক্ত ছিল, টোনটা ছিল আরও খারাপ। আমি তখন একুশে হলে নিজের রুমে ছিলাম। শুনেই একটা শক খাওয়ার মতো অবস্থা হলো। এরপর থেকেই হলে হলে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান ওঠা শুরু হলো।

বাসস: সেদিন রাতে একুশে হল থেকে মিছিল কীভাবে গড়ে উঠলো এবং আন্দোলন কীভাবে ‘গিয়ার আপ’ হলো?

সারজিস আলম: আমি রুম থেকে বেরিয়ে দেখি ১০-১৫ জন দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।  আমরা নিচে নেমে এসেছি লনে। সেখানে দাঁড়িয়ে স্লোগান শুরু করলাম ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। রিডিং রুম, ডাইনিং সব জায়গা থেকে লোকজন নামতে থাকলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে কয়েকশো হয়ে গেলাম। এরপর গেটে গিয়ে আরও স্লোগান দিলাম, আর লোক বাড়তে থাকলো। আমি নিজে তখন সমন্বয়কের দায়িত্বে, সবাই জিজ্ঞেস করছিল কোন রুটে যাবে মিছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিই শহীদুল্লাহ হল হয়ে যাব।

ওখানে গিয়ে কিছু ছাত্র যুক্ত হলো। এফএইচ হল, কার্জন হল সেখান থেকেও লোকজন বাড়তে থাকলো। এরপর বিশাল মিছিল হয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে বেরিয়ে এলাম।

হাসনাতকেও ফোন দিয়ে ডাকি। সেও যোগ দেয়। আমরা তখন রাজু ভাস্কর্যের দিকে এগোই। দেখি মেয়েদের হল থেকেও মিছিল বের হয়েছে। এরপর আমরা ভিসি চত্বর পর্যন্ত যাই, আবার ফিরে এসে মেয়েদের হলগুলোর সামনে আসি, মেয়েরা বসে পড়ে, ছেলেরা দাঁড়িয়ে যায় চারপাশে। তখন থেকেই আন্দোলন নতুন গতি পায়।

রাত একটা বাজে, ছাত্রলীগ তখন ইন্টারকন্টিনেন্টালে মিটিং করছে।  আমরা চিন্তিত হই, ওরা যদি ঢোকে তাহলে মেয়েদের নিরাপত্তা থাকবে না। আমি, হাসনাত, উমামা, নুসরাত মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নিই মেয়েদের হলে ফেরত পাঠাতে হবে। আমি নিজে সুফিয়া কামাল হল পর্যন্ত দিয়ে আসি।

ছাত্রলীগ তখনো ঢুকতে পারেনি, আমরা ক্যাম্পাসে ছিলাম বলেই। পরে যখন ওরা ঢোকে, তখন আমরা হালকা মজা করে বলি বাংলা সিনেমার পুলিশের মতো, আমরা চলে যাওয়ার পর আসে!

বাসস: ১৫ জুলাই বিকেলে একাত্তর হলে ছাত্রলীগের হামলা এবং ১৬ তারিখের সংঘর্ষ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

সারজিস আলম: ১৫ তারিখ দুপুরে আমাদের ঘোষণা ছিল ভিসি চত্বর হয়ে শহীদ মিনারে বিক্ষোভ মিছিল করবো। কিন্তু খবর আসে একাত্তর হল ও সূর্য সেন হল থেকে ছাত্রদের বের হতে দিচ্ছে না। বাকের মাইক থেকে ঘোষণা দেয়, কয়েকশো জনের মিছিল একাত্তর হলে যায়, সেখানে হামলা হয়, রক্তাক্ত হয় অনেকে।

আমরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিলাম মেয়েদের নিয়ে, উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের নিরাপদ রাখা। ছেলেরা গিয়েছিল পাল্টা ধাওয়া দিতে। পরে, এফবিএসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগ আমাদের ওপর ইট ছোড়ে, মেয়েরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অনেকেই আহত হয়। আমি মেয়েদের নিয়ে ভিসি চত্বর হয়ে এসএম হল পর্যন্ত যাই।

কেউ ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়নি, কারণ আহতরা সেখানে যাওয়ার পর ছাত্রলীগ সেখানেও হামলা করে, গুলি, ককটেল ছোড়ে। ঐদিন হাসনাত ছিল টার্গেট, ও ভিসির অফিস সংলগ্ন জায়গা থেকে বের হতেই ছাত্রলীগের লোকজন ওর পায়ের ওপর পিটায়, পা একেবারে কালো হয়ে যায়। আমি গাড়ি নিয়ে ওকে ইবনে সিনায় নিই, ওখানে চিকিৎসা হয়। তারা একুশে হলে আমার রুমেও আসে । আমাদের রুমের সামনে ছাত্ররা পাহারা দেয়। কারণ আমরা তখন মূল নেতৃত্বে ছিলাম। পরে একুশে হল থেকেও অনেকে শহীদুল্লাহ হলে যায়। কার্জন এলাকার তিনটি হল তখন চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্রলীগ পুরো ব্যাকফুটে চলে যায়।

১৬ তারিখ শহীদ মিনারে গিয়ে বোঝা যায়- অনেকে সেফ জোনে চলে গেছে, হল ছেড়ে চলে গেছে, মেয়েদের উপস্থিতিও অনেক কমে যায়। তবু ওইদিন শহীদ মিনারের অবস্থান কর্মসূচিতে দুই-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণ ছিল অন্য পাশের তিন হলের ছাত্রদের-ওরাই তখন আন্দোলনের ধারক। 

বাসস: ১৬ জুলাই একদিকে ছাত্রলীগের টিএসসিতে অস্ত্রসহ অবস্থান ও আগের দিনের সংঘর্ষের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের বড় অংশের রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেতে চাওয়ার চাপ, এই পরিস্থিতিতে কী ধরনের সংকটের মুখে পড়েছিলেন এবং কীভাবে আন্দোলনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন? 

সারজিস আলম:  ওইদিনের পরিস্থিতি ছিল খুবই জটিল। ছাত্রলীগ অবস্থান নিয়েছিল রাজু ভাস্কর্যে, এবং আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর আসে যে তাদের কাছে অস্ত্র আছে। এই তথ্য আসে পুলিশের ভেতরের আমাদের কিছু ভাই, ইন্টেলিজেন্স এবং আমাদের নিজেদের ছেলেদের সোর্স থেকে। তারা বলছিল, রাজু কেন্দ্রিক ছাত্রলীগ ব্যারিকেড দিয়েছে এবং সেখানে সংঘর্ষের আশঙ্কা প্রবল।

শহীদ মিনারে আমাদের কর্মসূচি ছিল বক্তব্য ও বিক্ষোভের মাধ্যমে শেষ করার। কিন্তু মাঠে যারা এসেছিল তারা চাচ্ছিল রাজু ভাস্কর্য দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল দিতে। আমি, হাসনাত, নাহিদ আমরা কয়েকজন আলোচনা করি। নাহিদরা সিদ্ধান্ত নেয় যে সংঘর্ষ এড়াতে রাজু দিয়ে যাওয়া হবে না, পলাশী ঘুরে শহীদ মিনারে গিয়ে কর্মসূচি শেষ করা হবে। ওরা চলে যায়, আমি আর হাসনাত থেকে যাই, কারণ আমরা দেখতে পাই, উপস্থিত জনতা সেটা মানছে না, তারা রাজুর দিকেই যেতে চায়।

আমি বুঝতে পারি, আগের দিনের সংঘর্ষে আমাদের অনেক সাপোর্ট নষ্ট হয়েছে। যারা ছিল, তারা হয় আহত হয়েছে বা ভয় পেয়েছে। বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণে প্রায় ধস নেমে গেছে, যারা আমাদের জন্য একধরনের প্রতিরক্ষা বলয় ছিল। আমি জানতাম, ওইদিন যদি আরেকটা সংঘর্ষ হয়, তাহলে আমরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তাছাড়া খবর ছিল, ছাত্রলীগের কিছু সদস্য অস্ত্রসহ অবস্থান করছে। যদি ওরা গুলি চালায়, চার-পাঁচজন স্পট ডেথ হয়, তাহলে আন্দোলন হয়তো শেষ হয়ে যাবে। আমার মাথায় তখন কৌশল আসে, সেটা হলো আমি আজকের প্রোগ্রামটা শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করব, যাতে আগামীকাল আবার শক্তি নিয়ে নামা যায়।

এই চিন্তা থেকে সিদ্ধান্ত হয়, আমরা দোয়েল চত্বর হয়ে কার্জনের সামনে গিয়ে প্রোগ্রাম শেষ করব। কিন্তু দোয়েল চত্বরে গিয়ে দেখি, কেউ সরছে না। তখন বলি, আমাদের আগে সরতে হবে, তাহলেই মিছিল সরবে। আমি কার্জনের গেট দিয়ে এফএইচ হলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিওলজি ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত যাই। 

এই সময় হাসনাত বারবার ফোন দিচ্ছিল, বলে, ‘তুমি কই? ক্রাউডকে থামানো যাচ্ছে না, সবাই রাজু যাবে।’ আমি তখনো বলি, না, রাজুতে যাওয়া যাবে না। কারণ আমি স্পষ্ট বুঝেছি যদি সংঘর্ষ হয়, তাহলে আন্দোলন শেষ হয়ে যেতে পারে। একটা বড় অংশকে আগের দিনেই হারিয়ে ফেলেছি। আজ আরেকটা সংঘর্ষ হলে হয় আরও রক্তপাত হবে, নয়তো আন্দোলনের গতি থেমে যাবে। আমি তখন চাইনি, রাতের শাপলা চত্বরের মতো আরেকটা ম্যাসাকার হোক।

তখন আমি হাসনাতকে বলি, আমি কার্জনের দিকে গেলাম। পরে দেখি, মিছিল আর কার্জনে নেই। ওরা কার্জন হয়ে ঢাকা মেডিকেল ঘুরে শহীদ মিনারে গেছে। আমি ফোন দিই, হাসনাত বলে, ‘আমি মিছিল নিয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত চলে এসেছি।’ তখন মিছিল অনেক বড়। আবারো অনেকে রাজু ভাস্কর্যের দিকেই যেতে চাচ্ছে। কিন্তু রাসেল টাওয়ারে পুলিশের ব্যারিকেড ছিল।

আমার মাথায় তখন দুইটা লক্ষ্য, সংঘর্ষ যেন না হয়, আর আন্দোলন যেন সফলভাবে শেষ করা যায়। নিজেদের মধ্যেও যাতে বিভাজন না হয়। তাই আমি মিছিলটাকে ফুলার রোড দিয়ে জগন্নাথ হলের পাশের রাস্তা ধরে ভিসি চত্বরে নিয়ে যাই, সেখানেই প্রোগ্রাম শেষ করি।

অনেকে এই সিদ্ধান্তকে বিতর্কিতভাবে দেখে, বলে আমি ছাত্রলীগের মুখোমুখি হতে দিইনি। কিন্তু আমি জানি, একজন নেতার জায়গা থেকে শুধু আগ্রাসী হলেই হয় না ঠাণ্ডা মাথায়, কৌশল নিয়ে, বিচক্ষণতার সঙ্গে ভাবতে হয়। যারা আমার পাশে ছিল, তারা আগ্রাসী হতে পারে, কিন্তু আমার দায়িত্ব ছিল আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখা। ওইদিন আমি সেই দায়িত্বটা পালনের চেষ্টা করেছি।

বাসস: ১৪, ১৫ ও ১৬ জুলাই দিনে এবং রাতে যে কর্মসূচিগুলো ছিল, বিশেষ করে ১৬ জুলাই রাতের পরিস্থিতি কেমন ছিল? ছাত্রলীগের অবস্থান এবং ক্যাম্পাসের পরিবেশ কী রকম পরিবর্তিত হয়েছিল?

সারজিস: ওই তিনদিনে প্রতি দিন দুটো করে কর্মসূচি চলে। দিনে একটা, রাতে একটা। ১৬ জুলাই রাতে বিশেষ করে ক্যাম্পাসের সব হলেই এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয় ছাত্রলীগকে ঘিরে। ওই পাশের ছাত্ররাও এই আতঙ্ক থেকে অনুপ্রাণিত হয়। আমরা লক্ষ্য করি, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তখন হলগুলোয় বেশি ঢুকে পড়েনি, কারও কাছে কিছু তথ্য গিয়েছে যে ছাত্রলীগের ওপর আক্রমণ হতে পারে। রাতেই সব হল খালি হয়ে যায়, ছাত্রলীগ চলে যায়। সকালেই ক্যাম্পাস পুলিশ-বিদ্রোহী বাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৫ ও ১৬ জুলাই রাত এবং ১৭ জুলাই দিন এই সময়কে আন্দোলনের এক সংকটপূর্ণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যায়। সেই রাত থেকেই হলগুলোয় ছাত্রলীগকে বের করে দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। রোকেয়া হলে আতিকা নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে বের করা হয়, যা অন্য হলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েরাও এই প্রতিবাদের অংশীদার হয়, কারণ যেভাবে তারা অত্যাচারিত হচ্ছিল, তা সহ্য করার মতো ছিল না। এই প্রতিবাদ একসাথে সারা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে, তাই কোন হল আগে বা পরে এমন তুলনা করা কঠিন।

বাসস: ১৭ জুলাই সকালবেলায় সিন্ডিকেট সভার সময় ক্যাম্পাস বন্ধ করার ঘোষণা কীভাবে জানা গেল এবং এই ঘোষণার বিরুদ্ধে আপনারা কী ধরনের প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?

সারজিস আলম: ১৭ জুলাই সকালে আমাদের কাছে খবর আসে যে ওইদিন সিন্ডিকেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হবে এবং সেই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার। একই সঙ্গে সবাইকে হল থেকে বের করে দেওয়া হবে। এই খবর পেয়ে আমি একটি ভিডিও বানাই এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিই, বলি আমরা হল ছাড়বো না। একুশে হল থেকে প্রায় ২৫০-৩০০ ছাত্র মিছিল নিয়ে শহীদুল্লাহ হলের সামনে জড়ো হই। নাহিদ এবং অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সিনেট ভবনের মুখে পদযাত্রার পরিকল্পনা করি। আমরা একুশে হল থেকে বের হয়ে শহীদুল্লাহ হলে আসি, অন্য হলের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। মেট্রোর নিচ দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাশে যাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু বিজিবি ও পুলিশ বাধা দেয়। বাধা পার হওয়ার সময় ককটেল বোমা, সাউন্ড গ্রেনেড এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। আমরা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ি, পরে আবার রোকেয়া হলের কাছে একত্রিত হই। যদিও তারা ভয়ে আমাদের দমাতে চেয়েছিল, আমাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। এরপর আমরা ভিসির চত্বরে বসে ধৈর্য ধারণ করি, যেখানে মূলত একুশে হলের ছাত্ররা ছিল, কিছু ছিল শহীদুল্লাহ ও এফএইচ হলের। 

বাসস: ১৭ জুলাই বিকেলে গায়েবানা জানাজার সময় এবং তার পরে ক্যাম্পাসে কী ঘটনা ঘটেছিল? 

সারজিস আলম: গায়েবানা জানাজা ছিল দুপুর ৩টার দিকে। আমাদের অংশগ্রহণের জন্য একটার দিকে আমরা একুশে হল থেকে শহীদুল্লাহ হলের দিকে যাই। সেখানে তখন সায়েন্সের অন্যান্য বিভাগের ছাত্ররাও যোগ দেয়। জানাজার সময় শহীদ মিনারের পাশে বড় একটি মিছিল এসে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। তখন তারা বুঝতে পারে তারা সংখ্যায় অনেক বেশি, তাদের মনোভাবও পাল্টে যায়, তারা কোথাও বসে পড়বে নাকি বিক্ষোভ মিছিল করবে সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। জানাজা শেষে আমরা রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাত্রা শুরু করি। পুলিশ দুই পাশে ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে ব্যাপকভাবে ককটেল, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপ শুরু হয়। সবাই ছড়িয়ে পড়ে, কেউ কলাভবনের দিকে, কেউ রাজু ভাস্কর্য বা টিএসসির দিকে দৌড়ায়। তখন চোখে পানি পড়ছিল, আমরা শুয়ে পড়ি একটু শান্ত হওয়ার জন্য। পরে হাসনাত ও আমি আবার ভিসি চত্বরে ফিরে যাই এবং সেখানে বসে পড়ি। আমরা ঘোষণা দিই, ‘ক্যাম্পাস ছাড়বো না।’

পুলিশ ও বিজিবি রাবার বুলেট, টিয়ারশেল, ককটেল নির্বিচারে নিক্ষেপ করছিল। আমরা হাসনাতের সঙ্গে গিয়ে কথা বলি, তাদের বাধা দিতে চেষ্টা করি যাতে হামলা বন্ধ হয়। তারা কলাভবনের দিকে গেলে আমরা চেষ্টা করি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। আমরা ভিসি চত্বরে বসে প্রতিবাদ চালাই, যেটা কিছুটা মনোযোগ আকর্ষণ করে, বাইরের হামলা কমে যায়। প্রশাসন পুলিশ দিয়ে হল থেকে সবাইকে জোরপূর্বক বের করে দেয়। রাতে আমি ও হাসনাত ক্যাম্পাসের আশেপাশে এক আত্মীয়ের বাসায় যাই, যাতে প্রয়োজনে আবার ক্যাম্পাসে আসা যায়। আমাদের যোগাযোগ ছিল লালবাগ, চানরখারপুল, আজিমপুরসহ আশপাশের জায়গায় যারা আবার ক্যাম্পাসে আন্দোলন চালানোর জন্য প্রস্তুত ছিল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একটু সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলন চালানো। এইভাবেই ওই দিনের আন্দোলন ধাপে ধাপে স্থগিত হয়।

বাসস: ক্যাম্পাস ছেড়ে দেওয়ার পর আপনারা কী ধরনের নিরাপত্তা আশঙ্কা অনুভব করছিলেন?

সারজিস আলম: ১৭ তারিখ রাতে আমরা ক্যাম্পাস ফাইনালি ছেড়ে দিলাম। তখন পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছিল। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন হলে নির্বিচারে হামলা চালানো হচ্ছিল। আমাদের মনে হচ্ছিল, বিশেষ করে প্রথম সারির কয়েকজনকে তুলে নেওয়া হতে পারে। বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো কিছু ঘটাতে পারে যেন আন্দোলন দমে যায়। ওই রাতে আমি হাসনাতের মামার বাসায় উঠি, ও ছিল সায়েন্সল্যাবে। পরদিন, ১৮ জুলাই সকাল থেকে আমরা আট দশজন আবার আলোচনায় বসি। 

এদিকে আমাদের ওপর সরকারের সাথে আলোচনায় বসার জন্যে চাপ বাড়তে থাকে। কিন্তু দুপুরের দিকে জানতে পারি যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর নির্বিচারে গুলি চলেছে। আমরা তখনই সিদ্ধান্ত নিই, এখন আর কোনো আলোচনা নয়। সবাই পোস্ট দিল ‘রক্ত মাড়িয়ে সংলাপ নয়’।

বাসস: ১৭ জুলাইয়ের পরবর্তী দিনগুলোতে আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায় কেমন ছিল? বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ ও সাধারণ মানুষের ভূমিকা এবং তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে বলুন।

সারজিস আলম: ১৭ জুলাইয়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা নৃশংসভাবে ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়, অস্ত্র চালায়।

এর পর আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়, যা প্রধানত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দেয়। সঙ্গে স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হয়। এটি কয়েক দিনের ব্যাপ্তি, বিশেষ করে ১৮, ১৯, ২০ জুলাই বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, শনিবার তিনটি দিন। ওই তিন দিনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। অনেক গার্মেন্টস কর্মী, মাদ্রাসার ছাত্ররাও এই সময় নেমে আসে, যেখানে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরাও ছিল। ১৮ জুলাই বিটিভির ঘটনায়, মেট্রোরেলে আগুন লাগানো ও ১৯ জুলাই ইন্টারনেট শাটডাউনের মধ্যে এই সহিংসতা তীব্রতর হয়। এই তিনদিনেই প্রায় ৫০-৭০ শতাংশ হতাহতের ঘটনা ঘটে, কিন্তু তা ততক্ষণে প্রকাশ পায়নি। এরপর ২১ থেকে ২৯, ৩০ তারিখ পর্যন্ত আন্দোলনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু হয়, যা আরও ব্যাপক জনসমর্থন পায় ।  

বাসস: এই সময়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে কী ধরনের যোগাযোগ ছিল আপনাদের?

সারজিস আলম: ১৮ তারিখ দুপুরের পরে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের চাপ ছিল যে আমরা যেন তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি। তার আগেই, ১৭ জুলাই রাতেই, ভিসির বাসার কাছে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে মিটিং হয়েছিল। আমরা বলি, তারা যদি আগ্রহী হয়, তাহলে বসা যেতে পারে। কিন্তু ১৮ তারিখ বিকেলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর গণহত্যা শুরু হলে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, কোনো সংলাপ নয়। কিন্তু তারা আমাদের ওপর চাপ বাড়ায়। রাতে ওরা আমাদের লোকেশন ট্র্যাক করে সায়েন্সল্যাবের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় পদ্মা নামের একটা ভবনে। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কোথায় নিচ্ছে। পরে দেখি একটা বিল্ডিং, ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসায়। পাশের রুমে তিন মন্ত্রী আনিসুল, নওফেল, আরাফাত প্রতীক্ষা করছিল। আমরা বলি, আমাদের তুলে এনে মন্ত্রীর সাথে বসানো বিশ্বাসঘাতকতা হবে। আমরা বলি, টেনে-হিঁচড়ে নিতে হলে নেন, না হলে আমরা বসবো না। অবশেষে ওরা মন্ত্রীদের বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয়।

বাসস:  এরপর আপনাদের কোথায় নেওয়া হয়েছিল এবং কেমন ছিল সেখানকার পরিস্থিতি?

সারজিস আলম: ওখান থেকে আমাদের সোজা নিয়ে যাওয়া হয় কাকরাইল মসজিদ আর মৎস্য ভবনের মাঝামাঝি এক পরিত্যক্ত বাড়িতে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী আছে। ভেতরে কিন্তু ফুল এসি, ওয়েল-ডেকোরেটেড, কয়েকটা রুম। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সেখানেই আমাদেরকে রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওরা আমাদেরকে আলাদা করে রাখে, একে একে জেরা করে। কেউ বলে হাসনাত রাজি হয়ে গেছে, এখন তুমি বলো, না হলে তোমার বড় ক্ষতি হবে। ফ্যামিলি নিয়ে নানা রকম ভয় দেখায়। হাসনাতের অন্তঃসত্ত্বা বোন, অসুস্থ মা, বাবা দেশের বাইরে। আমি শুধু টিভি দেখতে পারছিলাম, ফোন ছিল না। মিডিয়া কীভাবে তাদের কথা শুনে হেডলাইন বদলে দিচ্ছে তাও দেখেছি। খাবারও দেয়নি রাতে, পরদিন সকাল, দুপুর পর্যন্ত। হয়তো চেয়েছে আমরা ক্ষুধার্ত থাকলে ভেঙে পড়বো।

বাসস: ওই সময়ে আপনাদের আন্দোলনের দাবিগুলো কীভাবে তৈরি হলো এবং কী নিয়ে আলোচনা চলছিল?

সারজিস আলম: ওইদিন সকাল থেকে আবার জেরা শুরু হয়। পরে আমরা ধীরে ধীরে আমাদের দাবি তৈরি করি। নাহিদ, নুসরাত, হাসিব, মোহনা, রিদি, হান্নান সবার সাথে কথা হয়। ১৫ দফা থেকে কমিয়ে সাত, পরে আট করা হয়। শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়ার দাবি রাখা হবে কি না তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। তখনো আন্দোলন সরাসরি সরকার পতনের দিকে যায়নি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, আইসিটি মন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, সেতু মন্ত্রী এই পাঁচজনের পদত্যাগ চাইলে সরকার টিকে থাকতে পারবে না এই ছিল আমাদের কৌশল। তখন ইন্টারনেট ছিল না, মেসেজ পাঠানো যাচ্ছিল না। বাইরে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। মোবাইল তারা রেখে দিয়েছিল।

বাসস: দাবিগুলো কীভাবে জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে কী ঘটেছিল?

সারজিস আলম:  আমরা নাহিদের পরামর্শে প্রেস ক্লাব বা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলেও কেউ রাজি হচ্ছিল না-সবাই বলছিল, এটা ঝুঁকিপূর্ণ। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বলল, তোমরা মন্ত্রীর কাছে দাও, ওখানেই মিডিয়ার ব্যবস্থা করব। ওদের এজেন্ডা ছিল মন্ত্রীদের সঙ্গে আমাদের বসানো। পরে রাত আটটার পরে আমাদের আবার পদ্মা ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনজন মন্ত্রী আগে থেকেই বসা। আমরা বলি, বসতে আসিনি, দাবি দিতে এসেছি। প্রথমবার বলার পর ওরা ভিডিও বন্ধ করল। কিন্তু আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলি, সেটা প্রচার করা হয়নি। মিডিয়াগুলো শুধু আট দফা প্রচার করলো, বাকি কথা বাদ। আমাদেরকে আবার অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর দিন সকালে ছেড়ে দেয়।  

বাসস: আচ্ছা, এরপর দ্বিতীয়বার আবার কোথা থেকে আপনাদের নিয়ে যাওয়া হয়? ডিবি আপনাদের কখন তুলে নিয়ে যায়? আর খাবারের টেবিলের বিষয়টা কি ছিলো? কি হয়েছিলো সেদিন আসলে?

সারজিস আলম:  ২০ তারিখ রাতে নাহিদকে তুলে নেওয়ার খবর পাওয়ার পরপরই আমরা সক্রিয় হয়ে উঠি। তার বাবার নম্বর যোগাড় করে যোগাযোগ করি, জানতে পারি তিনি তখন ডিবি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছিলেন। আমি এবং হাসনাত সেখানে যাই, এরপর একসঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে যাওয়া, সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য সবই আমরা সমন্বয় করে করি। কিন্তু ততক্ষণে বোঝা যাচ্ছিল, নাহিদের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা একধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে আগে তথ্য উদ্ধার করবে, কে রাজনৈতিক ‘ক্রেডিট’ নেয়। ডিবিও সেই প্রতিযোগিতায় নামে। গণস্বাস্থ্যে নাহিদকে দেখতে যেতে চাইলে আমাকে বাধা দেওয়া হয়। একদিন ঢোকার পথ আটকে দেয় কয়েকজন সিভিল ড্রেসে থাকা লোক। ওইদিনই আবার নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়। আমি তখন ঢাকায় কোথাও নিরাপদ মনে করছিলাম না। মনে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলটাই সবচেয়ে নিরাপদ, অথচ সেটিও তখন বন্ধ। শেষমেশ হাসনাতের মামার বাসায় যাই, সেখান থেকে পরদিন আবার তুলে নেয় ডিবি।

তুলে নেওয়ার পদ্ধতি ছিল ভয়ানক। অস্ত্রসজ্জিত গাড়ি, অন্তত ৩০ জনের মতো সশস্ত্র মানুষ এসে হাজির হয়। আমাদের কোথাও যোগাযোগের সুযোগ না দিয়েই সোজা নিয়ে যায় মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে। সেখানে প্রথমে আমাদের একটি ছোট ঘরে রাখা হয়, জেলখানার থেকেও ছোট। আলো-হাওয়া প্রবেশ করে না, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। না টেলিভিশন, না খবরের কাগজ, না ফোন। শুধু দিনে তিনবেলার খাবার দিত, সেটাও কোথা থেকে এনে খাওয়াচ্ছে জানি না। মানসিকভাবে একঘরে করে ফেলার কৌশল, এটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

এরপর সেই ‘খাবারের টেবিল নাটক’। বলা হলো হারুন স্যার দেখা করবেন। আমরা ভাবলাম, হয়তো জিজ্ঞাসাবাদ হবে। কিন্তু না, সে বলল তোমরা তো আমার ছোট ভাই, আমি নিজের হাতে রান্না করেছি, খাও। জোর করে খাওয়ানো হলো, কেউ না খেতে চাইলে রীতিমতো মানসিক চাপে ফেলা হলো। দুই চামচ মুখে দিতেই ক্যামেরা ধরল, এরপর দেখি পাশের রুমে টিভিতে চলছে আমাদের ছবি! যেন আমরা খুব আনন্দে আছি। পরের দিন একই নাটক আমাদের অভিভাবকদের নিয়েও করা হলো। এই ঘটনাগুলো ছিল ডিবির পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা।

এরপরে আবার একদিন হঠাৎ আমাকে ডাকে। যেতে হবে হারুনের রুমে। দেখি, সেখানে প্রথমে শুধু নাহিদ, পরে আমি, হাসনাত, আসিফ, বাকের, নুসরাত সবার মুখোমুখি দেখা। নাহিদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি স্ক্রিপ্ট, পড়তে হবে। ও আমাকে বলে পড়, এখান থেকে বের হতে হবে।’ আমি অবাক হয়ে বলি, ‘তুমি এটা পড়বে?’ ও বলল, ‘না পড়ে উপায় আছে?’ ওই স্ক্রিপ্টে আন্দোলন প্রত্যাহারের কথা লেখা।

আমরা বুঝেছিলাম, ওখান থেকে বের হতে হলে আপাতত পড়তে হবে। তারপর বাইরে গিয়ে না হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যাবে। সেই প্রেস স্ক্রিপ্টটি পড়ার সময় আট-দশটা ক্যামেরা ভিডিও করছিল। চারপাশে আর্মড অফিসার, কারও মুখে কোনো কথা নেই, ভয়ানক টেনশনের আবহ। ওখানে একটা ঘটনা এখনো মনে পড়ে, নাহিদ লুঙ্গি এমনভাবে পরে ছিল যে ভিডিওতে অশালীন লাগার সম্ভাবনা ছিল। তাই একটা পেপার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছিল। এটাই ছিল ওদের ‘প্রেজেন্টেশন কোয়ালিটি’।

এই পুরো ঘটনাটাকে অনেকে ভুল বুঝেছিল। অনেকে বলেছিল, আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছি। কিন্তু বাস্তবতা ছিল, ওখানে আমাদেরকে দিয়ে জোর করে পড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। এদিকে ওই সময় তারা আমাদেরকে গণভবনে নিয়ে যাওয়ার জন্যেও উঠে পড়ে লেগেছিল।

হারুন আমাদের কনভিন্স করতে না পেরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে, এমনকি চেষ্টা করে শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু বুঝে যায় যদি জোর করে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে সেটা শেখ হাসিনার কাছেও নেতিবাচক বার্তা দেবে। তাই তারা বাধ্য হয়ে থেমে যায়। এর মধ্যেই আন্দোলন বাইরে থেকে আবার জ্বলে ওঠে। রিফাত রশিদ, আব্দুল হান্নান মাসুদ, মাহিন সরকার, কাদের এই চারজন আত্মগোপনে থেকে দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব নেয়। ১ তারিখে পরিকল্পনা ছিল আমাদের গণভবনে বসানো হবে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় বিভিন্ন দিক থেকে।

আমার আসনের এমপি নাইমুজ্জামান মুক্তা আমাকে ফোন দেয়, বলে তুমি, হাসনাত, নাহিদ, বাকের সবাই পরিবারসহ গণভবনে এসো। যা চাও, দেশ ও দেশের বাইরে সব দেওয়া হবে। এমনকি বলেছে, শেখ হাসিনা নিজেই তোমাদের দায়িত্ব নেবেন। তার দরজা সারাজীবনের জন্য তোমাদের জন্য খোলা থাকবে। একাত্তর টিভির একজন সাংবাদিক, রাব্বানীর ভাই গোলাম রুহানী, এমনকি একজন নারী সংসদ সদস্য সবাই চেষ্টা করেছে আমাদেরকে কনভিন্স করতে। কিন্তু আমাদের অবস্থান স্পষ্ট ছিল, এই আন্দোলন কোনো বার্গেনিং-এর জায়গা নয়। এটা আমাদের বিবেক, আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের ছাত্রসমাজের অস্তিত্বের প্রশ্ন।

যাইহোক এরমাঝে একদিন হাসনাত প্রচণ্ড রেগে যায়। সেই ফ্লোরের ডিসি-এডিসিরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে, তখন ওদের রুম থেকে বের হয়ে আসে। আমি বললাম চল একটু ঘুরে আসি। হারুন নিজেই বলে নাও, ওদের নিয়ে পুকুরটার চারপাশে ঘুরে আসো, জুস খাওয়াও। ডিবির পুকুর, মাঝখানে একটা জুসের দোকান। ওখানে নিয়ে আমাদের দুই গ্লাস জুস দিল। ওই জায়গা থেকেই আমরা দেখতে পাই আমাদের দুই-তিন ফ্লোর ওপরে নাহিদদের রাখা হয়েছে। একসাথে আমাদের রাখা হতো না, যেন কোনো পরিকল্পনা করতে না পারি।

ওই অল্প সময়ের মধ্যেই হাসনাত বলল, এভাবে চলবে না, আমাদের অনশনে বসতে হবে। আমি ওর মুখেই প্রথম শুনি অনশনের প্রস্তাব। পরবর্তী সময়ে নাহিদ, আসিফ, বাকেরদের সঙ্গে দেখা হলে, ও আবার একই কথা বলে, একসাথে পরিকল্পনা করে শুরু করতে হবে। এরপরে আমরা জানতে পারি, ওরা তিনজন আগে থেকেই অনশন শুরু করে দিয়েছে। আমরা তখন জানতাম না। জানলে আগে থেকেই শুরু করতাম। আমরাও রাত সাড়ে আটটা থেকে শুরু করি। ওদেরটা চলে ৩২-৩৩ ঘণ্টা, আমাদেরটা চলে প্রায় ২১ ঘণ্টা।

পরদিন সকালে এবং দুপুরে বারবার খাওয়ার জন্য চাপ আসে। ডাক্তার আনা হয় ঢাকা মেডিকেল থেকে, চেকআপ করবে, যদি শরীর খারাপ থাকে, তাহলে তো আবার ডিবির ঝামেলা। তাই তারা অনেক অনুরোধ করেও খাওয়াতে পারেনি। আমরা অনড় ছিলাম।

পরে ২ আগস্ট বিকেল পাঁচটার দিকে আমরা মুক্ত হই, আমি এবং হাসনাত সাইন্সল্যাবে পৌঁছাই। গোসল করে, একটু খেয়ে, কিছুটা স্বস্তি পাই। তারপর সিদ্ধান্ত হয় আমরা সবাই মিলে একটি অফিশিয়াল প্রেস রিলিজ দিব, কেউ ইন্ডিভিজুয়ালি কিছু বলবো না। তারপরও বিবেকের তাড়নায় আমি একটা পোস্ট দিই, যেখানে লিখি: ‘আমাদের লড়াই চলবে।’ মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে ওই পোস্টের রিয়েকশন চলে যায় কয়েক হাজারে। আমার আইডি হ্যাক হয়ে যায়, দুই দিন পর ফিরে পাই।
 
বাসস: ডিবি থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ৫ আগস্ট পর্যন্ত শহীদ মিনারের এক দফা থেকে শুরু করে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং ওই সময়ে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ, কর্মসূচির পরিকল্পনা, নিরাপত্তা ও পরিস্থিতির পরিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত বলুন।

সারজিস আলম: তিন তারিখ সকালে আমরা শহীদ মিনারে বিশাল গণজমায়েতে একত্রিত হয়েছিলাম। আমি আগে এসে সেখানে অবস্থান করছিলাম, পরে হাসনাত, নাহিদ, বাকের, আসিফসহ অন্যরা যোগ দিল। তখনই এক দফার ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর থেকে সরকারের কেউ আর যোগাযোগ করেনি। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল আমাদের ওপর শুটআউট চালানো। পুলিশের ভেতরে এমন কয়েকজন ছিল যারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত, কিন্তু তাদের ওপরও চাপ ছিল। তারা আমাদের বলত, মিছিলে ঢোকার সময় এমন পোশাক পরে আসতে যাতে ইন্টেলিজেন্স আমাদের চিহ্নিত করতে না পারে। সামনের লাইনে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকতে বলত, কারণ সামনের লাইনে গুলি চালানোর নির্দেশ ছিল। তারা কান্নাকাটি করত নিজের চাকরি বাঁচানোর জন্য, কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমরা বলেছিলাম, সামনের লাইনে না দাঁড়ালে আন্দোলনের কোনো মানেই থাকবে না, কারণ হাজারের বেশি মানুষ জীবন দিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছে, আমরা পিছিয়ে যাব না।

শহীদ মিনার থেকে আমরা সিএনজি করে তেজকুনি পাড়া, মহাখালী, নাখালপাড়া এলাকা দিয়ে আত্মগোপনে ছিলাম। ওই জায়গাগুলো আমাদের পরিচিত ছিল, আমাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় ছিল। আমাদের টার্গেট ছিল অল্প সময়ের জন্য রাস্তায় আসা, মুখ দেখানো এবং দ্রুত লুকিয়ে যাওয়া। কারণ তখন পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর ছিল। নির্বিচারে গুলি চালানো হচ্ছিল। চার থেকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত আমরা এলাকায় পর্যবেক্ষণ চালিয়েছি, কর্মসূচির পরিকল্পনা করতাম, এবং সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে আন্দোলনের গতি ধরে রাখার চেষ্টা করতাম।

চার তারিখে দেশে বড় বড় কর্মসূচি হয়। শিক্ষক ও সুধী সমাজের জন্য পাঁচ তারিখে শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জলন ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আমাদের চিন্তা ছিল, যদি বৃহত্তর জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত না করি, তাহলে আন্দোলনের সংখ্যা ও শক্তি কমে যাবে। চার তারিখ রাতে আমাদের গ্রুপ কলের মাধ্যমে আগামী দিনের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়। তখন জানা যায়, শহরে বিশেষভাবে অস্ত্র ও স্নাইপারসহ ডিপ্লয়মেন্ট হয়েছে, তাই আমরা সতর্ক থাকতে চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর পূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল, এবং তারা ধরা পড়লে আন্দোলনের মোমেন্টাম নষ্ট হতে পারে। তাই আমরা নিজেদের নিরাপত্তা ও আন্দোলনের শক্তি দুটোই ধরে রাখতে চাই।

পাঁচ তারিখ সকালে বৃষ্টি শুরু হলে হতাশা সৃষ্টি হয়। মনে হচ্ছিল, আ. লীগ ন্যাচারাল সুবিধা পাচ্ছে কারণ বৃষ্টিতে মানুষ রাস্তায় নামতে পারবে না। ইন্টারনেট শাটডাউন দেওয়া হয়, যদিও পরে তা তুলে নেয়া হয়। উত্তরা থেকে খবর আসছিল হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে, আর্মি সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনা বেড়েই চলছিল। উত্তরা বিএনএস সেন্টার থেকে ফ্লাইওভার পর্যন্ত মানুষ মিছিল করছে। যাত্রাবাড়ির গলিতেও জনসমাগম ছিল। সেখানে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ হচ্ছিল। আমি বিভিন্ন গলি পর্যবেক্ষণ করছিলাম, মিডিয়া ফলো করছিলাম, আমাদের যোগাযোগ ছিল। যখন সেনাপ্রধানের ভাষণ আসার খবর পাই, বুঝতে পারি বড় কিছু হতে যাচ্ছে। তখনই রাস্তায় নামি। হাজার হাজার মানুষ শাহবাগ থেকে গণভবনের দিকে মিছিল শুরু করে।

উত্তরা থেকে মিছিল মেইন রোডে গিয়ে একটি ব্যারিয়ার ভেঙে দেয়। যাত্রাবাড়ির গলিতে আরও মানুষ যোগ হয়। মিরপুর ডিএইচএস এলাকায় বাচ্চারা সামনের সারিতে ছিল, তাদের পেছনে বাবা-মা। সৈনিকরা তাদের ঠেলতে পারছিল না, পড়ে যায় তারা। বাচ্চারা তাদের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে, অফিসাররা সাইডে সরে যায়। এই দৃশ্য সেনাবাহিনীর ওপর প্রভাব ফেলে। ওই এলাকার অনেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা নিজে রাস্তায় নেমে আসেন। তখন মিছিলের গতি দ্রুত বেড়ে যায়। উত্তরা থেকে গণভবনের পথে প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট সময় নিয়ে হাজার হাজার মানুষ হাঁটে, যা ছিল আন্দোলনের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও বড় মিছিল।

এইসব পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও গতি ধরে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ থাকলেও আমরা পিছিয়ে যাইনি, কারণ জানতাম হাজারেরও বেশি মানুষ জীবন দিয়ে এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের চাপ, শুটআউটের হুমকি, সামাজিক মিডিয়ায় প্রপাগান্ডা, সব কিছু মোকাবেলা করেও আমরা সাহস হারাইনি। 

বাসস: কীভাবে  জানলেন আন্দোলনের ফলাফল, বিশেষ করে কখন শুনলেন শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেছেন? সেই মুহূর্তে আপনার অনুভূতি এবং আন্দোলনের শেষ পর্যায়ের স্মৃতি নিয়ে কিছু বলবেন? 

সারজিস আলম: আমার মনে আছে, তখন আমি তেজকুনি পাড়া থেকে বিজয়সরণীর একটু সামনে একটি গলি দিয়ে বের হচ্ছিলাম। তখন চারদিকে এমন একটা শব্দ আসছিল যে সেনাপ্রধান কিছু বলছেন, পরে মনে হলো দুইবার বলছেন, আর একটা খবর আসছিল যে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। হঠাৎ হেলিকপ্টারে পালানোর ছবি মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। আমরা তখন বাইরে, যোগাযোগ খুবই সীমিত, সোশ্যাল মিডিয়া একটু স্ক্রল করছিলাম, দেখতে পেলাম শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করছেন। ওই মুহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তখন আমাদের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল। মাস্ক পরা ছিল, মাথায় পতাকা বেঁধে ছিলাম, আশেপাশের মানুষ বুঝতে পারেনি। যখন মাস্ক খুললাম, তখন দেখি মানুষ আনন্দে হাত-পা ছুড়ে আনন্দ মিছিল করছে।

ওই সময় হাসনাতের সঙ্গে অল্পক্ষণ দেখা হয়েছিল, এরপর সবাইকে ভিন্ন ভিন্ন দিক নিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমাকে এক রিকশায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । রিকশাটা প্রায় ১০-১৫ মিনিট আগাতে পারেনি, কারণ মানুষজন এত চাপ দিয়েছিল যে রিকশার চাকা দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এরপর হেঁটে গিয়েছিলাম গণভবনের দিকে। মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে গিয়ে দেখি অনেকেই গণভবনে ঢুকছে, অনেকেই সামগ্রী বের করছে, যেন শ্রীলঙ্কার সেই দৃশ্য। গেটের সামনে মানুষের বুক ফাটা কান্না আর আনন্দ ছিল একসঙ্গে। গণভবনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দুই হাত উঁচু করে ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করছিলাম। মানুষ রিকশার হুড ধরে স্পর্শ করার চেষ্টা করছিল, তখন আরেকটি রিকশার হুডও খুলে পড়ে যায়। আমাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিলাম না। আশেপাশের মানুষরা নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করছিল, কিন্তু আমরা যেন নির্বাক, মন খালি হয়ে গিয়েছিল।

গণভবন থেকে তখন হাসনাত, নাহিদ, আসিফ, বাকেরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম। কল রিসিভ হচ্ছিল না, একবার আসিফের সঙ্গে কথা হয়েছিল বা বাকেরের সঙ্গে। তারা বলেছিল বঙ্গভবনের রাস্তার দিকে আসতে। মনে হচ্ছিল আমি শাহবাগে যাবো, কিন্তু মানুষ আমাকে ফার্মগেট থেকে টেনে নিয়ে অন্য দিকে নিয়ে গেল। আমি তখন আশেপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর যাচ্ছিল যে সবাই রাস্তায় নেমেছে। শাহবাগের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনেক সময় লেগে গেল।

ইন্টারকন্টিনেন্টালের মোড়ে তখন হাসনাতের ফোন কল আসছিল। সে বলছিল আসিফের সাথে কথা হয়েছে, তবে নেটওয়ার্ক সমস্যা থাকায় কথা বলা যাচ্ছিল না। কোটি মানুষের ঢল নামার কারণে যোগাযোগে বিঘ্ন হচ্ছিল। হাসনাত বলেছিল তারা বঙ্গভবনের দিকে যাচ্ছেন, আমাকে সেখানে আসতে বলছিল। আমি ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, ইন্টারকন্টিনেন্টাল দিয়ে যেতে যেতে হাসনাতের সাথে দেখা হলো। পরে যমুনা, মৎসভবন হয়ে ভাষা ইনস্টিটিউটের কাছে গেলাম, সেখান থেকে চ্যানেল ২৪ এর অফিসে গেলাম। সেখানে নাহিদ, আসিফ, বাকের আগে গিয়েছিল। আমি ওই সময় হাসনাতের সঙ্গেই ছিলাম।

বাসস: ৫ আগস্ট যদি অভ্যুত্থান না হতো কিংবা শেখ হাসিনা পালিয়ে না যেত, তখন সশস্ত্র আন্দোলনের পরিকল্পনা কেমন ছিল? সেই সময় আপনার প্রত্যাশা কী ছিল, আর পরিস্থিতি কেমন ছিল?

সারজিস: হাসিনা ৫ তারিখেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন আমরা এমনটা ভাবিনি। আমরা মনে করতাম, হয়তো আরও কিছুদিন সময় লাগবে, পাঁচ থেকে পনেরো দিন বা তারও বেশি। আমরা ভাবতাম, যখন রাজপথে ডাক দেওয়া হবে, তখন সাধারণ মানুষ, প্রশাসনের একাংশ, সিভিল সার্ভিস এবং রাজনৈতিক নেতারা সবাই ধীরে ধীরে রাস্তায় নামবেন। তখন রাজপথে দুই পক্ষ স্পষ্ট হয়ে যাবে, এক দিকে থাকবে ফ্যাসিস্ট এবং তাদের অনুগতরা, অন্য দিকে থাকবে ফ্যাসিস্ট পতনের পক্ষে থাকা সাধারণ জনগণ ও আন্দোলনকারীরা। আমরা তখন একটা ঘোষণা দিয়েছিলাম, সরকারি অফিস, আদালতসহ সব জায়গায় যারা ফ্যাসিস্টদের সহযোগী, তারা অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবে এবং শুধু রাজপথে নামবে যারা পরিবর্তন চায়। এই দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলবে, আর সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই ফ্যাসিস্ট বিরোধী পক্ষের বিজয় আসবে। লড়াইটা কেমন হবে, সেটা তখন নির্ভর করতো পরিস্থিতির ওপর, সশস্ত্র হবে কি হবে না, সেটা তখন ঠিক ছিল না।

বাসস: আপনি আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। এ কারণে আপনার এবং আপনার পরিবারের ওপর কি ধরনের চাপ বা হেনস্থা হয়েছে? সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কি কোনো রাজনৈতিক চাপ বা হুমকি ছিল?

সারজিস আলম:  ১৫ তারিখের পর থেকেই চাপ বেশি অনুভব করেছি, যদিও জুলাইয়ের প্রথমার্ধেও কিছু ঘটনা ঘটেছিল। আমার বাবা আওয়ামী লীগের স্থানীয় পদে ছিলেন, যদিও ওই সময় রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তার ওপর মানসিক চাপ ও হেনস্থা চলছিল। তাকে ছোট করে বলা হতো, তার ছেলে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তার কারণে বাবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বের হননি। তবে তিনি কখনো আমাকে বাধা দেননি। আমার ঝুঁকি বেশি ছিল কারণ আমার বিরুদ্ধে মামলা হলে আমার কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় ছিল না, আর বিএনপি কিংবা জামাত শিবিরের আশ্রয়ও আমি নিতে পারতাম না। আমার জন্য কোনো নিরাপদ জায়গা ছিল না। তবে আমার সহযোদ্ধারা যারা আগে সরকারের বিরোধী আন্দোলনে লড়াই করেছে, তাদের কমিউনিকেশন, প্রোটেকশন ও অভিজ্ঞতা ছিল, যা আমার ছিল না। তবু আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি এবং আল্লাহর সাহায্য পেয়েছি।

বাসস: অবশেষে এক দফা দাবি কীভাবে সৃষ্টি হলো? এটি আন্দোলনকারীদের থেকে এসেছে নাকি জনতার চাপ থেকেই এসেছে?

সারজিস আলম: ডিবি থেকে বের হওয়ার পর আমরা বুঝতে পারলাম যে, মানুষ আর অপেক্ষা করতে চায় না। তাদের জীবনে দেয়ালের মতো বাধা এসে ঠেকেছে। তারা এখন শুধু পথ দেখতে চায়। তখন মানুষের পক্ষ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মকে তারা তাদের পছন্দের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করেছে। সরকারি চাকরিজীবীরাও বিকালে অফিস শেষে আন্দোলনে যোগ দিত। এটি ছিল শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের ভুল নীতির ফল এবং মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। তিন তারিখে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এক দফা দাবি ঘোষণা করি, কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল মানুষের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার উচ্চারণ। সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘এক-১’ চিহ্ন দিয়ে মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে এক বিপ্লব সূচিত হয়েছিল। আমরা শুধু তাদের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরলাম, আর জনগণ তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করলো।

বাসস: অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে যাচ্ছে।  তখন মানুষের যে স্বপ্ন, আশা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল, আজ তা কতটুকু পূরণ হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? আজকের দিনে মানুষ কী ভাবছে, তাদের সেই প্রত্যাশা বাস্তবায়নে কতটা সফল হওয়া গেছে?

সারজিস আলম: ৫ আগস্ট মানুষ যে স্বপ্ন দেখেছিল তা বিশাল। এটি এক দিনে বা এক বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আমি মনে করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরো সাহসী হওয়া দরকার, বিশেষ করে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। 

তবে এ জন্যে সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও দায়িত্বশীল হতে হবে, অবৈধ উপায়গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে দশ বছর বা এক যুগে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, কিন্তু সেই লক্ষ্যে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

বাসস: যদি ফিরে যেতে পারতেন জুলাইয়ের শুরুতে, আপনার কোনো সিদ্ধান্ত বদলানোর বা পরিবর্তনের ইচ্ছা থাকত কি?

সারজিস আলম: ৫ আগস্ট পর্যন্ত যা হয়েছে, সেটাই সম্ভবত সেরা সিদ্ধান্ত ছিল এবং আমাদের সফলতা সেখানে নিহিত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন ও উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে আমি পরিবর্তন করতে চাইতাম। ছাত্র প্রতিনিধিদের আরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। জাতীয় সরকার বা বিপ্লবী সরকার গঠন করা যেত যদি রাজনৈতিক দলগুলো রাজি থাকত। 

বাসস: পুরো আন্দোলনের সময় বা পরে এমন কোনো মুহূর্ত ছিল যা আপনাকে সবচেয়ে বেশি হতাশ বা নিরাশ করেছে? এমন সময় যখন আপনি নিজের অসহায়ত্ব অনুভব করেছেন?

সারজিস আলম: জুলাই মাসে, যখন আমরা আন্দোলনের জন্য রাজপথে ছিলাম, কিছু মানুষ ব্যক্তিগত মনোভাব থেকে ছাত্রলীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অভিযোগ করেছিল, যা মন খারাপ করে দিয়েছিল। ডিবিতে বন্দি থাকার সময়, দীর্ঘ সময় আটক থাকলে কারা আমার পক্ষে লড়াই করবে, সেটা নিয়েও চিন্তা হয়েছিল। পরিবারের সদস্যরাও একেক পথে ছিল, তাই একাকিত্ব অনুভব করেছিলাম। ৩ ও ৫ আগস্ট পরিবারের কাছে বিদায় নেওয়ার সময়টা সবচেয়ে কষ্টকর মুহূর্ত ছিল, কারণ জানতাম হয়তো আর ফিরবো না। বাবার চোখে কান্না দেখে মন আরো ভারাক্রান্ত হয়েছিল। এতদিন লালন পালন করা সন্তানকে এমন বিদায় দেয়া খুব কঠিন।

তবু, আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, বিশ্বাসঘাতকতা করি নাই। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত অপপ্রচারের মধ্যেও হাল ছাড়িনি। সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখি যে আমি অভ্যুত্থানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। এই আত্মতৃপ্তি আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।

বাসস: অভ্যুত্থানের সময় এবং পরবর্তী সময়ে আপনার আন্দোলনের সহযোগীদের জন্য কোনো কথা থাকলে বলুন।

সারজিস আলম: আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং জনগণের তীব্র আকাঙ্ক্ষার ফলেই অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। যারা মাঠে লড়েছে, যারা পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছে, সবাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে থেকে দেশের উন্নতি ও সংস্কারের জন্য কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল হতে হবে। দেশের মানুষকেও দায়িত্বশীল হতে হবে, দেশের স্বার্থ সবার উপরে রাখতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে একসঙ্গে প্রতিবাদ করতে হবে, দলের প্রতি অনুগত থেকে নয়, বরং দেশের কল্যাণে কাজ করতে হবে। তাহলে দেশের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে।