
জুলাই বিপ্লবের পর দেশের রাজনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ দেখছেন বিশিষ্টজনরা। সে জন্য আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজর সবার। এবারের নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনে রয়েছে নানা সমীকরণ। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতাদের বহুমুখী দ্বন্দ্বে স্থানীয় রাজনীতিতে চলছে নানা মেরুকরণ। তবে বিএনপির এই অনৈক্যের মধ্যেও ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলো।
জেলার নির্বাচনি মাঠের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বড় সমস্যা দলের নেতাদের মধ্যে অনৈক্য, যা জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলোর জন্য একটি বড় সুযোগ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে প্রার্থীজটের কবলে পড়তে যাচ্ছে বিএনপি। তবে জামায়াতে ইসলামী ও খেলাফত মজলিসের একক প্রার্থী মাঠে সরব।
বহুমুখী লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁও) আসনে। নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে বিএনপিতে তীব্র কোন্দল থাকলেও মাঠের প্রচারে চাঙা জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এছাড়া হেভিওয়েট প্রার্থীদের ভিড়ে উত্তপ্ত নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসন। তবে ভোটের মাঠের শেষ হিসাব এখনই মেলানো কঠিন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ)
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর শিল্পাঞ্চল রূপগঞ্জের রাজনৈতিক আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। ক্ষমতার লড়াইয়ে বিএনপির দুই হেভিওয়েট নেতার রক্তক্ষয়ী কোন্দল এবং এর বিপরীতে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা খুঁজছেন বিকল্প কাউকে। এই ত্রিমুখী সংকটে দলটি যখন দিশেহারা, তখন মাঠে নেমেছে একাধিক সুসংগঠিত দল।
এর মধ্যে একক প্রার্থী নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে খেলাফত মজলিস এবং নতুন শক্তি হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদধ্বনিতে রূপগঞ্জের নির্বাচনি সমীকরণ এক জটিল ও বহুমুখী লড়াইয়ের দিকে এগোচ্ছে।
হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এই আসনে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার। ঐতিহাসিকভাবে আসনটি বিএনপিপ্রবণ হলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দল বারবার দলটিকে ভুগিয়েছে।
দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রূপগঞ্জে বিএনপির রাজনীতি এখন তিনটি ধারায় বিভক্ত। একদিকে দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু, অন্যদিকে আরেক নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনির। তাদের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব ৫ আগস্টের পর থেকে প্রায়ই সহিংস রূপ নিচ্ছে, যার সবশেষ উদাহরণ যুবদলকর্মী মামুন ভূঁইয়া হত্যাকাণ্ড।
এই দুই শিবিরের আধিপত্যের লড়াইয়ে তৃণমূল কর্মীরা বিভক্ত ও আতঙ্কিত। দুই শীর্ষ নেতার দ্বন্দ্বে বীতশ্রদ্ধ ত্যাগী নেতাকর্মীরা এখন ঝুঁকছেন রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান হুমায়ুনের দিকে, যা তাকে তৃণমূলের ‘বিকল্প নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এদিকে বিএনপির এই বিশৃঙ্খলার সুযোগে অন্য দলগুলো বেশ গোছানোভাবে মাঠে নেমেছে। জামায়াতে ইসলামী অনেক আগেই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসাইন মোল্লাকে একক প্রার্থী ঘোষণা করে সরবে গণসংযোগ ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করছে।
ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের ডাক দিয়ে খেলাফত মজলিসের রূপগঞ্জ থানা সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ এমদাদুল হককে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ঐক্যের স্বার্থে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে তারা কাজ করছেন, যা ইসলামী ভোটব্যাংকে প্রভাব ফেলবে।
জুলাই বিপ্লবের কারিগরদের সংগঠন হিসেবে পরিচিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) রূপগঞ্জে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছে। যদিও এখানে তাদের শক্তিশালী কোনো প্রার্থী এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে ছাত্র-জনতার একটি বড় অংশের সমর্থন থাকায় তাদের অবস্থান যে কোনো প্রার্থীর জয়-পরাজয়ে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, রূপগঞ্জে বিএনপির বিজয় নির্ভর করছে তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনের ওপর। দল যদি একজন সর্বজনীন প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হয়, তবে বিরোধীদের ভোট জামায়াত, খেলাফত মজলিস ও অন্যান্য দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে, যা বিএনপির জন্য আত্মঘাতী প্রমাণিত হতে পারে।
নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার)
আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার আসনে বিএনপি শিবিরে প্রার্থীজট তৈরি হয়েছে। দলের চারজন প্রভাবশালী নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ায় তৃণমূল কর্মীরা পড়েছেন বিভ্রান্তিতে। এই সুযোগে জামায়াতে ইসলামী ও খেলাফত মজলিস একক প্রার্থী নিয়ে বেশ গোছানোভাবে নির্বাচনি প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
এই আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী চার হেভিওয়েট প্রার্থী। দলের কেন্দ্রীয় সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ। দুঃসময়ে দলকে সংগঠিত রাখায় তৃণমূলের বড় একটি অংশ তার পক্ষে। বিএনপির অর্থবিষয়ক সহ-সম্পাদক ও প্রয়াত মন্ত্রী বদরুজ্জামান খসরুর ছেলে মাহমুদুর রহমান সুমন পারিবারিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। এ ছাড়া সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান আঙ্গুর পুরনো পরিচিতিকে পুঁজি করে মাঠে থাকলেও সংস্কারপন্থি হিসেবে তার একটি অতীত রয়েছে। জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নারী ভোটারদের একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম পারভীন আক্তার।
স্থানীয় এক বিএনপি কর্মী বলেন, ‘আমাদের চারজনই যোগ্য নেতা। কিন্তু দল যদি একজনকে প্রার্থী ঘোষণা না করে, তাহলে ভোটের মাঠে কর্মীরা চার ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। এতে আমাদেরই ক্ষতি।’
এদিকে জামায়াতে ইসলামী তাদের একক প্রার্থী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াস মোল্লাকে নিয়ে অনেক দিন ধরেই নির্বাচনি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইলিয়াস মোল্লা নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াচ্ছেন।
খেলাফত মজলিসও নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি হাফেজ মাওলানা আহমদ আলীকে একক প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে সক্রিয়। তাদের লক্ষ্য ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। সেটি হলে নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারবে।
নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁও)
ঐতিহাসিক সোনারগাঁওয়ের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন এক বহুমুখী লড়াইয়ের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। এখানে শুধু বিএনপি ও জামায়াতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, নতুন শক্তি হিসেবে মাঠে নেমেছে খেলাফত মজলিস, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। একাধিক দলের প্রার্থী ও জটিল সমীকরণে সোনারগাঁওয়ের নির্বাচনি হাওয়া এখন বেশ উত্তপ্ত।
এই আসনে বিএনপির মনোনয়নের লড়াই মূলত উপজেলা সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নান এবং সাবেক এমপি অধ্যাপক রেজাউল করিমের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে নতুন করে এই সমীকরণে যুক্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের নাম। নিজ আসনে কোণঠাসা হয়ে তিনি সোনারগাঁওকে ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে ভাবছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে, যা স্থানীয় বিএনপিতে নতুন করে বিভক্তি তৈরি করেছে।
এই আসনে শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য ড. ইকবাল হোসাইন ভূঁইয়ার। তাকে একক প্রার্থী করে জামায়াত একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।
খেলাফত মজলিস সোনারগাঁও থানা সভাপতি মুফতী সিরাজুল ইসলামকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ইসলামী ঐক্যের ডাক দিয়েছে।
অন্যদিকে জুলাই বিপ্লবের ধারক জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সোনারগাঁওয়ে তাদের সাংগঠনিক দায়িত্ব দিয়েছে তরুণ নেতা তুহিন মাহমুদকে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি এই আসনে এনসিপির প্রার্থী হতে পারেন। ছাত্র ও তরুণ ভোটারদের মাঝে এনসিপির একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সম্প্রতি তৃণমূলের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই কাউন্সিল সম্পন্ন করেছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছে, সাংগঠনিকভাবে তারা কতটা গোছানো।
স্থানীয় একজন শিক্ষক বলেন, ‘আগে শুধু নৌকা আর ধানের শীষের লড়াই দেখতাম। এখন তো অনেক দল, অনেক প্রার্থী। এটা ভালো, আমাদের পছন্দের সুযোগ বাড়ছে। যে সোনারগাঁওয়ের উন্নয়ন নিয়ে ভাববে, আমরা তাকেই ভোট দেব।’
সোনারগাঁওয়ের লড়াই এখন আর দ্বিমুখী নয়। এটি একটি বহু মেরুর প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে। বিএনপি যদি তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিশেষ করে ‘বহিরাগত’ নেতার ইস্যুটি সামাল দিতে না পারে, তবে ভোট বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে জামায়াত, খেলাফত মজলিস বা এনসিপির মতো সংগঠিত দলগুলো নির্বাচনে চমক দেখাতে পারে।
নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা)
জাতীয় রাজনীতির ব্যারোমিটার হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নজিরবিহীন তৎপরতা। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ভোটারের এই আসনটি নিয়ে প্রচলিত আছে, ‘এই আসন যারা পায়, সেই দল সরকার গঠন করে।’ এমন গুরুত্বপূর্ণ আসনে যখন প্রধান দলগুলোর শক্ত প্রস্তুতি নেওয়ার কথা, তখন বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। এই সুযোগে অত্যন্ত সুসংগঠিতভাবে মাঠে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী ও বিপ্লবের তরুণ শক্তি হিসেবে পরিচিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ফলে ভোটের লড়াই এক জটিল ও বহুধা বিভক্ত সমীকরণের দিকে এগোচ্ছে।
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপি নজিরবিহীন সংকটে পড়েছে। দলের মনোনয়ন ঘিরে তৈরি হয়েছে তীব্র কোন্দল, যা তৃণমূলকে বিভক্ত ও হতাশ করছে।
মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন। তিনি ওয়ার্ডভিত্তিক গণসংযোগ ও সভা-সমাবেশের মাধ্যমে নিজেকে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে একমাত্র লড়াকু শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। তবে তার বিরুদ্ধে অতীতে দলের মধ্যেই নিজস্ব বলয় তৈরি এবং একক আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে, যা দলের একটি বড় অংশকে তার থেকে দূরে রেখেছে।
অন্যদিকে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা দিয়েছেন শিল্পপতি ও সাবেক থানা সভাপতি মো. শাহ আলম। তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমি নির্বাচন করলে নমিনেশন পাওয়ার ক্ষমতা রাখি।’ তার আর্থিক সক্ষমতা ও কেন্দ্রের সঙ্গে পুরোনো যোগাযোগকে তিনি শক্তি হিসেবে দেখছেন। তবে দীর্ঘ সময় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকা এবং দলের দুঃসময়ে মাঠে না থাকার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে জোরালো।
এই প্রকাশ্য প্রতিযোগিতার ভিড়ে ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ। জেলার শীর্ষ নেতা হিসেবে তিনি সরাসরি নির্বাচনি প্রচারণায় না নামলেও, কৌশলগত অবস্থানের কারণে অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছেন। আন্দোলন-সংগ্রামে তার সক্রিয় ভূমিকা এবং তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি তাকে মনোনয়ন দৌড়ে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে।
এদিকে বিএনপির অগোছালো পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী অত্যন্ত গোছানো ও কৌশলগত প্রচার চালাচ্ছে। অনেক আগেই তারা এই আসনে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আব্দুল জব্বারকে প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছে। জামায়াতের নেতাকর্মীরা ইফতার, ঈদ পুনর্মিলনী ও সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে নীরবে প্রতিটি এলাকায় নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করছে। বিএনপির কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে তারা ইসলামী ভোটব্যাংকের একটি বড় অংশ নিজেদের দিকে টানতে পারে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে জুলাই বিপ্লবের ফসল হিসেবে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই আসনে একটি নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইছে। দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব ও শৃঙ্খলা কমিটির প্রধান অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আল-আমিন এই আসনে এনসিপির সম্ভাব্য প্রার্থী। তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জকে সন্ত্রাস ও দূষণের নগরী থেকে মুক্ত করে মানুষের সমস্যা সমাধানের রাজনীতিতে আমরা আসতে চাই।’
এবারের রাজনীতিতে ভিন্ন হাওয়া বইতে শুরু করায় তরুণ ও পরিবর্তনকামী ভোটারদের মধ্যে এনসিপি সাড়া ফেলতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই।
এছাড়া অন্য ইসলামি দলগুলোও নিজেদের শক্তি জানান দিচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জানিয়েছে, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার জন্য কর্মীরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করতে প্রস্তুত। পাশাপাশি খেলাফত মজলিসও মহানগর সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আহমদকে প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে মাঠে কাজ করছে। ইসলামি দলগুলোর এই সক্রিয়তা প্রমাণ করে, ইসলামপন্থি ভোট এবার কোনো একক দলের ঝুলিতে যাবে না, যা নির্বাচনের ফলাফলকে আরো অনিশ্চিত করে তুলেছে।
নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর)
নারায়ণগঞ্জের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র সদর-বন্দর আসন এখন হেভিওয়েট প্রার্থীদের ভিড়ে এক উত্তপ্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিএনপির ডজনখানেক মনোনয়নপ্রত্যাশীর ‘কথার যুদ্ধ’, জামায়াতের একক প্রার্থী এবং নতুন শক্তি হিসেবে এনসিপি, খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলনের শক্তিশালী উপস্থিতিতে এখানকার নির্বাচনি লড়াই এক জটিল এবং সম্ভবত জেলার সবচেয়ে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ আসনে রূপ নিয়েছে।
এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকা দীর্ঘ এবং তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ও সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু রাজপথের পরীক্ষিত নেতা হিসেবে নিজেদের দাবি করছেন।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ী নেতা মাসাদুজ্জামান মাসুদ আর্থিক ও সাংগঠনিক সক্ষমতা দিয়ে মাঠে নেমেছেন। এই লড়াইয়ে আছেন চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবুল কালাম, বিএনপি নেতা জাকির খানসহ আরো অনেকে। তাদের প্রকাশ্য কাদা ছোড়াছুড়িতে কর্মীরা হতাশ বলে দলের সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির এই বিশৃঙ্খলার বিপরীতে অন্য দলগুলো অনেক বেশি সংগঠিত। জুলাই বিপ্লবের চেতনার ধারক এনসিপি এই আসনে একটি বড় ‘ফ্যাক্টর’। জেলা কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী আহমেদুর রহমান তনুকে কেন্দ্র করে এখানে তাদের শক্তিশালী সাংগঠনিক বলয় তৈরি হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের অনেক প্রার্থীই এখন এনসিপির সমর্থন আদায়ের জন্য যোগাযোগ রাখছেন।
খেলাফত মজলিস কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব এবিএম সিরাজুল মামুনকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে, যা ভোটারদের নজর কেড়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কাউন্সিল করে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় এই আসনে আলোচনায় আছেন মহানগর সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ। তারা চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ‘আরেকটি জুলাই আন্দোলন’-এর ডাক দিয়ে এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির দাবি তুলে সাধারণ মানুষের কাছে একটি নীতিগত বার্তা দিচ্ছেন।
জামায়াতে ইসলামীতে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমেদকে একক প্রার্থী করে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, সদর-বন্দর আসনের লড়াই এখন আর কোনো একক দলের নিয়ন্ত্রণে নেই। এটি একটি বহুমুখী প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে, যেখানে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলনÑ প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ ‘খেলোয়াড’। যে দল বা জোট সবচেয়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে নিজেদের ঐক্য ধরে রাখতে পারবে এবং অন্য শক্তির সমর্থন আদায় করতে পারবে, জয় তাদের পক্ষেই যাবে। তবে সচেতন মহলের দাবি, এই আসনে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান খুব সামান্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।