
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র-জনতা যখন অধিকার আদায়ে রাজপথে, তখন তাদের দমাতে পুলিশের পাশাপাশি অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাসীরা।
গত বছরের জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে আওয়ামী লীগের পতনের আগ পর্যন্ত রাজশাহীতে আন্দোলনকারীদের দমনে নগরীর সাহেববাজার, সোনাদিঘির মোড়, মালোপাড়া, তালাইমারী, বিনোদপুর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও কাজলায় দেখা গেছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। তবে পতনের এক বছর হতে চললেও সেসব অস্ত্রের অধিকাংশই এখনো উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ছাড়া চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগ প্রতিবেশী দেশে অবস্থান করার কারণে তাদের ধরা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
আন্দোলনে সম্পৃক্ত এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, জুলাইয়ের শেষদিকে টানা কয়েকদিন রাজশাহীতে প্রায় পাঁচ শতাধিক আওয়ামী নেতাকর্মীকে ধারালো অস্ত্র হাতে দেখা গেছে। এর বাইরে আরো অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসীর হাতে ও পকেটে ছিল অবৈধ পিস্তল। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে তারা এসব অস্ত্র ব্যবহার করেছেন।
রাজশাহীতে গত ৫ আগস্টের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে নগরীর পিএন স্কুলের সামনে তৎকালীন মেয়র ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য খায়রুজ্জামান লিটনের গাড়ির পেছনে থাকা সিটি করপোরেশনের পিকআপ ভ্যান থেকে নামানো হয় শতাধিক ধারালো অস্ত্র। কিছুক্ষণ পর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার একটি প্রাইভেট কার থেকে নামান বেশ কয়েকটি পিস্তল। অস্ত্রগুলো সেখানে আগে থেকে অবস্থানকারী যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের দেওয়া হয়। এদিন সাকিব আঞ্জুমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পাশাপাশি গুলিতে আহত হন রায়হান নামে এক শিক্ষার্থী। পরবর্তী সময়ে ৮ আগস্ট চিকিৎসাধীন তার মৃত্যু হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, সেদিনের হামলায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত অন্তত অর্ধশত অবৈধ অস্ত্রের হদিস মেলানো যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের পতনের পর ৫ আগস্ট বিকালে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে চলে যায়। ফলে তাদের ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি। অবৈধ অস্ত্রগুলো উদ্ধারে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ও যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম রুবেলকে কয়েক দফা রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। তবে অস্ত্রগুলো সম্পর্কে তারা কোনো তথ্য পুলিশকে দেননি। যদিও গত ৫ আগস্ট আন্দোলনকারীদের ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালাতে দেখা যায় রুবেলকে। তবে রিমান্ডে রুবেল দাবি করেন, ওই অস্ত্র দুটি তাকে যুবলীগের এক নেতা দিয়েছিলেন। তাকে তিনি অস্ত্রগুলো ওই দিনই ফেরত দিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, রাজশাহীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে শুরু থেকেই মারমুখী ছিল আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। আন্দোলনের সমর্থনে বিএনপি বা জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা মাঠে নামলে তাদেরও প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়। আন্দোলন দমাতে ওই সময় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা যায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের। বিশেষ করে গত ৪ ও ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে পিস্তল, শটগান ও ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৫ আগস্ট ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী সিটির তৎকালীন মেয়র ও আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য লিটন, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইশতিয়াক আহমেদ লিমন, মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রমজান আলীসহ হাজার চারেক নেতাকর্মী। তবে প্রথম সারির নেতাদের হাতে অস্ত্র দেখা না গেলেও তাদের অনুসারী অন্তত অর্ধশত নেতাকর্মীর হাতে অস্ত্র দেখা গেছে।
পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওই দিন রায়হানের শরীরে যে গুলি লাগে, সেটি ছিল অবৈধ অস্ত্রের। ওই ঘটনার দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যায়। আত্মগোপনে যাওয়া ব্যক্তিরা অস্ত্র সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেনি। নিশ্চয়ই অস্ত্রগুলো রাজশাহীতেই আছে। তবে এখনো এসব অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি।
এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মাদ আবু সুফিয়ান আমার দেশকে বলেন, বেশ কিছু অস্ত্র আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ব্যবহার করেছেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। কিন্তু সেগুলোর হদিস এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা অস্ত্র উদ্ধারে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, রিমান্ডে তারা অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। যাদের ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে, তারা দেশের বাইরে পলাতক আছেন বলে জানা যাচ্ছে। তবে অস্ত্রগুলো নিশ্চয়ই রাজশাহীতেই আছে। এ নিয়ে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগগুলো কাজ করছে।