
বর্ধিত সভায় দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের দাবি তুলেছেন বিএনপি’র তৃণমূল নেতাকর্মীরা। সভায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। সাত বছর পর গতকাল জাতীয় সংসদের এলডি হল প্রাঙ্গণে এই সভা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য দেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ভার্চ্যুয়ালি সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সকালে শুরু হওয়া সভা মধ্যাহ্ন বিরতি দিয়ে রাত পর্যন্ত চলে। সমাপনী বক্তব্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন।
সকাল ১১টায় ‘সুদৃঢ় ঐক্য রুখে দিতে পারে সকল ষড়যন্ত্র’ স্লোগান নিয়ে এই বর্ধিত সভা উদ্বোধন করা হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সূচনা বক্তব্য রাখেন।
উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তৃণমূলের নেতাদের বক্তব্য শোনেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা তাদের বক্তব্যে হাইব্রিডদের বাদ দিয়ে ত্যাগীদের পদ-পদবি দেয়ার জন্য হাইকমান্ডকে পরামর্শ দেন। ৫ই আগস্টের পর নব্য নেতাকর্মীদের কারণে বিএনপি’র ত্যাগীরা ভুগছেন বলেও অভিযোগ করেন কেউ কেউ। তারা বলেন, এদের কারণে বিএনপি’র ভেতরে এখন বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। কিছু সুবিধাবাদীদের দেখা যাচ্ছে। এই সুবিধাবাদীরা ত্যাগীদের বিতাড়িত করতে চাইছে। প্রত্যেক জায়গায় হাইব্রিড ও গ্রুপিং রয়েছে। এ ছাড়া মনোনয়নপত্র নিয়ে কোনো কোনো জায়গায় বিভক্তি দেখা যাচ্ছে। জামায়াত নিয়েও কথা বলেন কয়েকজন নেতা। আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায়ে দলকে শক্ত অবস্থান নেয়ার পরামর্শ দেন কেউ কেউ। এজন্য বিভাগীয় সম্মেলন করার জন্য দলীয় হাইকমান্ডকে পরামর্শ দেন তারা।
সভায় নেতারা বলেন, মনোনয়নপত্র নিয়ে কোনো কোনো জায়গায় বিভক্তি আছে। যারা সুবিধাবাদী তারা যেন মনোনয়ন না পান সে বিষয়ে হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা। বলেন, ১৭ বছর যারা ছিলেন না তাদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। একইসঙ্গে নেতারা যোগ্য ও ত্যাগীদের নেতৃত্বে আনার জন্য পরামর্শ দেন। তাদের নিয়ে কমিটি করার জন্য হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অন্যথায় দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে বলেও সতর্ক করেন তৃণমূলের নেতারা। পাশাপাশি বর্ধিত সভার মতো করে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়েও সভা করার পরামর্শ দেন তারা।
হবিগঞ্জের এক নেতা বলেন, বিগত দিনে যারা গর্তে লুকিয়ে ছিল, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করেছিল তাদের এখন আস্ফালন দেখা যাচ্ছে। এই সুবিধাভোগীদের কাছে ত্যাগীরা হারিয়ে গেলে পুরো বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দলের দুর্দিনে তৃণমূল বেঈমানি করেনি। যেকোনো সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। অথচ একশ্রেণির মৌসুমি নেতা সুবিধা নিয়ে মোটাতাজা হয়েছে। আর ত্যাগীরা হয়েছেন স্বাস্থ্যহীন। এই ত্যাগীরা দলের হাইকমান্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।
সৈয়দপুরের আলমগীর মাতুব্বর বলেন, যারা আমাদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছে। তারাই আজ বিএনপি’র প্রথম কাতারে। এই হাইব্রিড যেন বিএনপিতে না ঢুকে। তাহলে সৈয়দপুরের তিনটি আসনই বিএনপিকে আমরা উপহার দেবো।
যশোরের আসাদুজ্জামান মিন্টু বলেন, প্রত্যেক জায়গায় হাইব্রিড ও গ্রুপিং রয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে গ্রুপিং দূর করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিতে হবে।
দিনাজপুরের আব্দুস সালাম মিলন বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলকে শক্তিশালী করতে হবে। ৫ই আগস্টের পরে বিএনপি’র ভেতরে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। ত্যাগীদের কোণঠাসা ও বহিষ্কার করা হচ্ছে। পদ স্থগিত করা হচ্ছে। তাদের পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। তৃণমূলকে জাগাতে হবে, হাইব্রিডদের ঠেকাতে হবে।
নওগাঁর মহাদেবপুর এলাকার রবিউল আলম বলেন, আমরা আন্দোলন করে দলকে সংগঠিত করেছি। এখন সেটা এককভাবে দাবি করা হচ্ছে! সেটা আমরা মেনে নিতে চাই না। আর আমরা সেই নেতৃত্ব দেখতে চাই না, যারা আন্দোলন দেখলেই পালিয়ে যেতে চায়।
টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকার জাকির হোসেন সরকার বলেন, যারা গত ১৫ বছর ছিল না তারা এখন আমাদের ঘরে ঢুকে ঐক্য বিনষ্ট করতে চাচ্ছে। তদন্তসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বিএনপি আরও শক্তিশালী হবে।
পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক খায়রুন নাহার খানম বলেন, গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি টিকে থাকতে পারবে কিনা, আমাদের প্রতিপক্ষ যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, সেটা রোধ করার ওপর নির্ভর করছে। প্রতিপক্ষ মসজিদে বসে রাজনীতি করবে, আর আমরা অফিস ভাড়া করে রাজনীতি করবো। সুতরাং মসজিদে বসে রাজনীতি চলবে কি চলবে না- তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার হুমায়ুন কবির বলেন, জামায়াতকে মোকাবিলায় সকালে মসজিদে নামাজ পড়তে হবে। দলকে এগিয়ে নিতে হলে ত্যাগীরা পিছিয়ে থাকবে না, মৌসুমি নেতারা এগিয়ে যাবে না- এমন কৌশলে এগোতে হবে।
ভোলার মো. মফিজুর রহমান মিলন বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসীর জায়গা হবে না। বিএনপি যাতে আওয়ামী লীগের দোসরদের জায়গা না হয়।
জামালপুরের আতিকুর রহমান সাজু বলেন, জুলাই-আগস্টে যারা আন্দোলন করেছেন তারা আমাদেরই সন্তান। তারা আওয়ামী লীগের দোসরদের কেউ নয়। তাই ছাত্রদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে যাওয়া উচিত। আর দেশে এখন ষড়যন্ত্র চলছে। এজন্য বিএনপি’র কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগঠনকে চাঙ্গা করতে হবে। যেসব জায়গায় অঙ্গ-সংগঠনের কমিটি নেই, সেসব জায়গায় কমিটি দিতে হবে। যেসব জায়গায় বিএনপি’র কমিটি নেই, সেসব জায়গায় বিএনপির কমিটি দিতে হবে।
জামালপুরের জহিরুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ৫ই আগস্টের পর নব্য বিএনপি হয়েছে। তাদের জন্যই বিএনপি’র এই বেহাল দশা। আর মসজিদ ও মাদ্রাসার কমিটি নিয়ে ঝগড়া হয়, এগুলো থেকে সরে আসতে হবে।
ঠাকুরগাঁওয়ের জিয়াউল ইসলাম জিয়া বলেন, দেশে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে। সুতরাং আপনি (বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান) নিজস্ব সেল ও জরিপের মাধ্যমে মনোনয়ন দেবেন। তাকেই মনোনয়ন দেবেন যার অবস্থান সবচেয়ে ভালো হবে। আর যারা দলের ক্ষতি করবে গোপন সেল করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থ নিন।
নোয়াখালীর দেওয়ান শামসুল আরেফিন শামীম বলেন, বিগত ১৭ বছরে আন্দোলন-সংগ্রামে যাদের ডেকে পাইনি, তাদেরকে দলে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তাদেরকে দায়িত্ব দিলে তারা দলের সঙ্গে বেঈমানি করবেন।
কুষ্টিয়ার জাহিদুল ইসলাম বিপ্লব বলেন, আমরা অনেক মামলা-হামলার স্বীকার হয়েছি। দলের দুঃসময়ে যারা ছিলেন না, সেসব সুবিধাবাদীরা এখন বিএনপিতে ভালো জায়গায় আছেন।
নীলফামারীর মাসুদ চৌধুরী বলেন, দলের ভেতরে এখন বিশৃঙ্খলা দেখতে পাচ্ছি। কিছু সুবিধাবাদী দেখতে পাচ্ছি। এসব সুবিধাবাদীরা ত্যাগীদের বিতাড়িত করতে চায়। দলের অনেক নেতা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এই ত্যাগীদের কথা যাতে আমরা ভুলে না যাই।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৪ঠা ফেব্রয়ারি রাজধানীর ‘লা মেরিডিয়ানে’ বিএনপি’র বর্ধিত সভা হয়। যেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বক্তব্য দেন। এর ৪ দিন পর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ৮ই ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠায় আওয়ামী লীগ সরকার।