হঠাৎ করে আলোকদ্যুতি বিচ্ছুরণকারী এইচ টি ইমাম অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন কেন? তিনি সেই মানুষ যিনি অসামান্য মেধা দিয়ে শুধু মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রশাসন সাজানোর ব্যাপারেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেননি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত নিরসলভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে সংগঠিত করেছেন, প্রশাসন কাঠামো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন। তিনি সেই মানুষ যিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস ও শক্তি জুগিয়েছেন।
ছাত্রলীগের সমাবেশে তিনি যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে ভুল ব্যাখ্যা করার সুযোগ হয়তো রয়েছে, কিন্তু তার অর্থ তো এই নয় যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করেছেন কিংবা স্যাবোটাজ করার চেষ্টা করেছেন। তার অর্থ এটাও নয় যে, তাঁর সারাজীবনের অবদান এবং ভূমিকা মিথ্যা হয়ে যাবে, আর এইচ টি ইমাম ‘জাতীয় ভিলেনে’ পরিণত হবেন। ছাত্রলীগের একাংশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন, আওয়ামী লীগের কিংবা সরকারের একাংশও এতে অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়েছেন। কারও কারও প্রতিক্রিয়া এই পর্যায়ে যে, এখুনি এইচ টি ইমামকে দল থেকে বের করে দেওয়া উচিত, তাঁর বিরুদ্ধে দলদ্রোহিতার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, ইত্যাদি।
এরই মধ্যে বিএনপি একটা নির্মম রসিকতা করে বসল। তাদের বক্তব্য– এইচ টি ইমাম ‘আমাদের লোক’, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এর ফল ভালো হবে না।
রাজনীতিতে অবশ্য এ ধরনের রসিকতা চলেই। প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া বড় কোনো উদ্বেগের বিষয় নয়। উদ্বেগের কথা হল– আওয়ামী লীগের নেতৃপর্যায়ের একাংশের অদূরদর্শী প্রতিক্রিয়া। এর মধ্যে দেখলাম, একমাত্র দলনেত্রী শেখ হাসিনাই ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কার ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটা আমি বুঝব।’ তাঁর এই বার্তায় রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ছাপ লক্ষ্য করে যেমন আশ্বস্ত বোধ করা যায়, তেমনি মনে শঙ্কারও জন্ম হয় এই ভেবে যে, এত বিশাল, এত ঐতিহ্যমণ্ডিত, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের অনেকের মধ্যে কি কেবল বোধবিবেচনাহীন আবেগই থাকবে?
একমাত্র দলনেত্রী শেখ হাসিনাই ঠাণ্ডা মাথায় বলেছেন, ‘কার ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটা আমি বুঝব’
একমাত্র দলনেত্রী শেখ হাসিনাই ঠাণ্ডা মাথায় বলেছেন, ‘কার ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সেটা আমি বুঝব’
আমার পেশাগত জীবনের ব্যাপ্তি তো কম হল না। এই নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সাংবাদিকতা পেশায় পেরিয়ে গেলাম বায়ান্নটি বছর। এই সময়ের মধ্যে রাজনীতিক, আমলা, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, সেনাপতি অনেককেই দেখলাম। এ থেকে আমার ধারণা– রাজনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন, মেধা, প্রজ্ঞা, সততা, নিষ্ঠা– সব কিছুরই যেন ক্রমাবনতি ঘটেছে। এই ধারার গতিরোধ যদি করা না যায়, তাহলে যে কোনো গণতান্ত্রিক দল গহীন অন্ধকার আবর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুখে পড়তে পারে।
একদিকে হিসেব করলে শেখ হাসিনার চেয়ে বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি ভাগ্যবান ছিলেন। যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু আলোচনা করে নিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান-সমেত আরও অনেক পোড়খাওয়া রাজনীতিক সাথী পেয়েছেন। সে হিসেবে শেখ হাসিনা অনেকটা নিঃসঙ্গ। অবক্ষয়মান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাঁর নির্ভরশীলতার জায়গাগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর জীবদ্দশায় এত নানাবিধ ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়তে হয়নি, যা প্রতিনিয়ম মোকাবিলা করতে হচ্ছে শেখ হাসিনাকে।
স্বল্পকালীন ক্ষমতায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধু খুব একটা বৈরী আমলাবাহিনী পাননি। যারা বিরোধী ছিল, তারা চতুর-ধূর্ত ছিল বটে এবং সুকৌশলে গভীর চক্রান্তের জাল বুনতেও হয়তো সিদ্ধহস্ত ছিল, কিন্তু তারা শাসনব্যবস্থার ভেতরে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। আর যখনই কোনো শৈথিল্যের সামান্যতম সুযোগ পেয়েছে তারা, তখনই তা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে প্রথম সুযোগেই এক ধাক্কায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা তো করেছেই, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ধ্বংস করতে মেতে উঠেছে, হত্যা করেছে মুক্তিযুদ্ধের চার কেন্দ্রীয় স্থপতিকে।
শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হচ্ছে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে। একের পর এক ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, হত্যাপ্রচেষ্টা, অপবাদ– কোনটি বাদ থেকেছে তাঁর বেলায়? একুশে আগস্টের হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে শেখ হাসিনা-সমেত গোটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার আয়োজন করা হয়েছিল। ছিয়ানব্বইয়ের সরকারের সফল অর্থমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার মেধাবী সংগঠক শাহ এম এস কিবরিয়াকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের অনেককে ঘাতকের হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে। গোটা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা, প্রগতিশীল স্বচ্ছ চেতনার মানুষ নিধনের নিরব বহ্নুৎসব চলেছে।
এই পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই যেতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্ত তীব্রতর হয়েছে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠানের পর। এর সূচনা হয়েছিল বিডিআর বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। সেই সময়ের বিরোধী নেতার নিবাস ক্যান্টনমেন্টে হওয়ার কারণে রকেট গতিতে চক্রান্ত চলতে পেরেছে। আর এই চক্রান্তের পরিণতিতে প্রাণ দিতে হয়েছে সেনাবাহিনীর দক্ষ ও একনিষ্ঠ ৫৭ সেনা অফিসারকে। এর পর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তির মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে নানাবিধ অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে সরকারের পথচলা কণ্টকাকীর্ণ করার চেষ্টা হয়েছে।
শেখ হাসিনার এই জটিল দিনগুলোতে তাঁর চারপাশে সপ্তরথীর ব্যূহ তৈরি করা হয়েছিল উপদেষ্টাদের দিয়ে। এঁরা নানা সময় প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন, কার্যক্রম পরিচলনায় সহযোগিতা করেছেন। শেখ হাসিনাকে নিঃসঙ্গ করার জন্য অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে প্রত্যেক উপদেষ্টাকে নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ড. মশিউর রহমানের মতো স্বচ্ছ ও মেধাবী ব্যক্তিকে সুকৌশকলে জড়ানো হয়েছিল তথাকথিত পদ্মা সেতুর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে। সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। ড. তৌফিক এলাহীকে বিদ্যুৎ-বিষয়ক কেলেঙ্কারির ধুয়া তুলে বিতর্কিত করার চেষ্টা হয়েছিল। সেটা তিনি কাটিয়ে উঠেছেনে বলে মনে হয়। প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকীকে ঘিরে গুজব আর ধূম্রজালের তো অন্ত ছিল না। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, এই মেধাবী স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন সেনা কর্মকর্তা যদি ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপটি নিতে ভুল করতেন, তাহলে শুধু সামরিক বাহিনীই নয়, গোটা রাজনৈতিক পরিমণ্ডল অশান্ত হতে পারত হয়তো-বা। অতীতের কালো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কাও ছিল। কারণ কোনো পর্যায়েই ষড়যন্ত্রকারীরা চুপচাপ বসে থাকেনি কখনও।
শেখ হাসিনাকে নিঃসঙ্গ করার জন্য অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে প্রত্যেক উপদেষ্টাকে নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে
শেখ হাসিনাকে নিঃসঙ্গ করার জন্য অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে প্রত্যেক উপদেষ্টাকে নানাভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে
ড. গওহর রিজভীর মতো একজন পণ্ডিত সজ্জন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টার পদে থাকার কারণে বাংলাদেশ আজ নানাবিধ আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সফল মোকাবিলা করতে পারছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বহির্বিশ্বের কোনো কোনো শক্তির বিরূপ ভূমিকার বিরুদ্ধেও অনড়ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে। এই গওহর রিজভীকেও তো কম অপবাদ সইতে হয়নি।
এই বহুমুখী চক্রান্তের সর্বশেষ শিকার এইচ টি ইমাম। আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি না যে, এইচ টি ইমামের মতো নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি কখনও এমন কাজ করতে পারেন যা আওয়ামী লীগ কিংবা সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রীরও অকল্যাণ সাধন হতে পারে।
একটা কথা সত্য যে, দূর থেকে অবলোকন করলে পুরো ক্যানভাসটা দেখা যায়। কে কোথায় কী করছে, কার গতিবিধি কেমন– তার একটা মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। সেই ধারণা ও ভাবনা থেকে মনে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ষড়যন্ত্রকারীরা দক্ষ ছিল বলে তারা ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুকে বন্ধুহীন করার চেষ্টা করেছিল নাটের গুরু খন্দকার মোশতাককে ব্যবহার করে। আর তখন সরল বিশ্বাসের কারণে বঙ্গবন্ধু নিঃসঙ্গ হচ্ছিলেন। এই এত বছর পরে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকেও নিঃসঙ্গ করার চেষ্টা চলছে তাঁকে বেষ্টন করা সপ্তরথীর ব্যূহে ফাটল ধরিয়ে। এইচ টি ইমামকে বিতর্কিত করার পর পরই উত্তরা ষড়যন্ত্রের আদলে ‘গুলশান ষড়যন্ত্র’ তারই ইঙ্গিত বহন করে বলে আমার মনে হয়।
বঙ্গবন্ধুর কিচেন কেবিনেটে সাপ ঢুকেছিল। সেই সাপ একসময় নীলদংশন করেছিল রাজনীতিকে। শেখ হাসিনার সপ্তরথীর ব্যূহে লখিন্দর-হন্তারক কোনো সাপ প্রবেশ না করুক এবং সেই ব্যূহ সুরক্ষিত থাকুক– এই কামনা করি।
আবেদ খান: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক জাগরণ।
Source: বিডিনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন