ঢাকা কলেজে শফিক নামে আমার এক বন্ধুস্থানীয় সতীর্থ ছিল। তার বাবা ছিলেন একজন বড় সরকারি কর্মকর্তা। শফিক ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ভালো ফল করে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়েছিল। তার আচার-ব্যবহার ছিল ভদ্র, মার্জিত। আমরা সাউথ হোস্টেলে থাকতাম। হোস্টেলের সবাই তাকে পছন্দ করত। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকত শফিক। আমার সঙ্গে শফিকের সম্পর্কটা একটু বেশি গাঢ় ছিল। কারণ শফিকের বাবা সে সময় নোয়াখালীতে চাকরি করতেন, সুতরাং কলেজ বন্ধ হলেও নোয়াখালী শহরে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো।
সেই শফিকের পরীক্ষার ফল কি না খারাপ হতে লাগল। তার মা-বাবা নিশ্চয়ই ভাবলেন, ঢাকায় গিয়ে শফিক বখে গেছে! পড়াশোনা ছেড়ে সে ছাত্ররাজনীতি করছে অথবা সিনেমা দেখে সময় নষ্ট করছে। আত্মীয়স্বজন ও আশপাশের লোকেরাও হয়তো সে রকম চিন্তা করেছে। আসলে ব্যাপারটি মোটেই তেমন ছিল না। শফিক যা করেছে, হোস্টেলের আরো কয়েকজন ছাত্রও সে কাজটি মনের সুখে আনন্দ-আয়েশে করেছে। সেটি হচ্ছে আলসেমি-আশ্রিত ঘুমে বিভোর থাকা অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় নির্জীব-নিষ্কর্ম হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা। সত্যি বলতে কি, ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসে আমিও এ আনন্দ চরমভাবে উপভোগ করেছি। যদি আমাকে এখনো কেউ জিজ্ঞেস করে যে কলেজজীবনে আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ কি ছিল, তাহলে আমি কোনো ভাবনাচিন্তা ছাড়া মুহূর্তেই উত্তর দেব, এটি হচ্ছে সকালে নিশ্চিন্ত ঘুমানো ও দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা।
এর পেছনের কারণটি ছিল স্কুলজীবনে বাবা বা জায়গির মাস্টারের তাড়নায় অতিভোরে ঘুম থেকে ওঠার বিড়ম্বনা। বাবা পাশের মসজিদে ফজর নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে হাঁকডাক করে আমাদের সব ভাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিতেন। বাসার সামনে বিরাট পুকুর। গাছের গুঁড়ি বাঁধানো পুকুরঘাটে আমরা মুখ-হাত ধুতে যেতাম। মুরব্বিদের বলা হতো আমরা নামাজ পড়া বা কোরআন তেলাওয়াতের লক্ষ্যে অজু করতে গেছি। আসলে পুকুরঘাটে বসে আমরা আরো কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে অথবা ঝিমিয়ে নিতাম। আধা ঘণ্টা, পৌনে এক ঘণ্টা পরে বাবা ফিরে এসে আবার হাঁকডাক করে আমাদের ঘুম বা ঝিমানি ভাঙিয়ে দিতেন। এবার আমরা সত্যি সত্যি মুখ-হাত ধুয়ে, অজু করে ঘরে ফিরতাম। এ সময় আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতাম সেদিন যেন তাড়াতাড়ি আসে, যেদিন আমি যখন সকালে ইচ্ছামতো ঘুমাতে পারব; অন্য কেউ আমাদের জোর করে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেবে না।
হোস্টেলজীবনের প্রথম সকালেই সে মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেল। আমি এখন মনের সুখে ঘুমাচ্ছি। ক্লাস শুরু হতে বেশ দেরি আছে। কেউ আমাকে বিছানা ছাড়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে না। আহা কী আনন্দ! বিছানায় তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় এপাশ-ওপাশ করা। এর চেযে আনন্দ আর কী হতে পারে! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পুরো সময়টা এভাবে কেটেছে। পরবর্তী জীবনেও সুযোগ পেলেই এ আনন্দ উপভোগ করেছি। অথবা বলা যায়, সুযোগ পেলে কখনো এ আনন্দ হাতছাড়া করিনি। তবে এ কথা ঠিক যে সময়ের বিবেচনা করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় বড়জোর পৌনে এক ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা। রাতে একটু বেশি সময় জেগে পড়াশোনা করলে আলসেমিজনিত এ ক্ষতি সহজেই পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমরা তাই করেছি বিধায় আমাদের মতো আলসেদের পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। পরীক্ষার ফলও ঠিক থেকেছে।
শফিকের সমস্যা ছিল সে সকালে-বিকেলে, দুপুরে-রাতে মোট চারবার ঘুম দিত। তার পড়ার সময় ছিল না বললেই চলে। যে সময় সে জেগে থাকত, তা প্রাত্যহিক কাজে ব্যয়িত হতো। এ অবস্থায় ক্লাস বা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। পরীক্ষার ফল এমন অবস্থায় খারাপ হওয়া স্বাভাবিক, যদিও শফিকের মতো ভালো ছেলে খুব কমই ছিল। আমার ধারণা, এত ভালো ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। একটি বছর নষ্ট হওয়ার পর আলসেমি কমিয়ে শফিক পড়াশোনায় গ্রহণযোগ্য ভালো ফল করেছে। অনেকদিন শফিকের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। শুনেছি বাস্তব জীবনে সে শেষ পর্যন্ত খুব একটা খারাপ করেনি।
আলসেমির রূপ-রস : কদাচ জয়গান
ঘুমিয়ে কাটানো আলসেমির একমাত্র রূপ নয়। আলসেমি মানে কর্মহীন সময় কাটানো হলেও সব আলসেমির ফলাফলও এক রকম হয় না। সক্রিয় বিনোদনকে আলসেমি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না; এ ধরনের বিনোদনকে ভবিষ্যৎ কর্মযজ্ঞের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কিছু কিছু আলসেমি আছে, যেখানে কোনো প্রকার অঙ্গ সঞ্চালন হয় না, তবে মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে। আলসে ব্যক্তি হয়তো বা পা এলিয়ে সটান শুয়ে থাকে, কিন্তু খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন বা বই পড়ে, টিভি দেখে, গান শুনে, টেলিফোনে (মোবাইলে) কথা বলে, ইন্টারনেটে সংযুক্ত থেকে সে নিজেকে জ্ঞান বা প্রদীপ্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করে। আমার বন্ধু নুরুন নবী সোফা সেটে ডুব মেরে গাদা গাদা বই শেষ করেছে। এ আলসেমি সে প্রাণ ভরে উপভোগ করেছে, এ সময় মনের সুখে পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো কাজ সে করেনি। বইয়ের পাতা ওল্টানো ছাড়া আর কোনো কাজ করেনি। অনেকটা নিষ্ক্রিয়-নির্জীব থেকেছে। কিন্তু এ সময়ে সে প্রচুর জ্ঞানার্জন করেছে। নিজেকে সত্যিকার অর্থে প্রদীপ্ত ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করেছে। বন্ধু সাইফুল হক অবশ্য চোখ বন্ধ করে খাটের বালিশে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় 'থিঙ্ক' করার নামে সটান শুয়ে থাকত। বোস্টনে আমরা দুই সতীর্থ বন্ধু এক রুমে থাকতাম। আমি তখন অর্থনীতির গ্রাজুয়েট কোর্সে সূচনামূলক অধ্যায়সমূহের গাণিতিক পদ্ধতি ও তত্ত্বকথা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাভ্যাসকে গুরুত্ব না দেওয়ার খেসারত হিসেবে জেগে থাকা সময়ের এক বিরাট অংশ পড়ার টেবিলে কাটিয়ে দিচ্ছি। সাইফুলের সে সমস্যা ছিল না। অর্থনীতিসহ পড়াশোনার প্রায় প্রতিটি বিষয়ে সে ছিল বিশাল ব্যবধানে অগ্রগামী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা তার অনেক বক্তব্য না বুঝে হেসে উড়িয়ে দিতাম, পরে বুঝতে পেরেছি, আসলে তার জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা ছিল অন্তত আমার তুলনায় অনেক বেশি। গ্রাজুয়েট কোর্সের সূচনামূলক অধ্যায়সমূহ তার কাছে সহজবোধ্য ছিল বিধায় সে 'থিঙ্ক' করা নামক আলসেমিতে গা ডুবিয়ে দিতে পারত। এ 'থিঙ্ক' করা তার জ্ঞানার্জন ও অধিকতর প্রদীপ্তি আহরণে কত দূর সহায়ক হয়েছিল, তা সে নিজে ভালো বলতে পারবে। গ্রাজুয়েট কোর্সের শেষভাগে ও পিএইচডি কর্মসূচিতে সে তার পাণ্ডিত্য ও প্রদীপ্তির স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হলেও সূচনামূলক কোর্সসমূহে 'থিঙ্ক' করা আলসেমি বড় একটা কাজে আসেনি। তবে আজও চিন্তা-চৈতন্যের দিক থেকে সাইফুলের উচ্চতায় ওঠা আমাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।
আমার বন্ধু মোশাররফের আলসেমির রূপ হচ্ছে সোফায় বসে টিভি দেখা ও মাঝেমধ্যে অকারণে বিছানায় গিয়ে শুয়ে থাকা। এ সময় কোনো অর্থবহ কাজ হয় না, নিশ্চুপ-নিষ্কর্ম সময় গড়িয়ে যায়। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে কোনো কাজ করতে ইচ্ছে হয় না, অথচ করার অনেক কিছুই আছে। আলসেমির আনন্দ যে উপভোগ্য, সন্দেহ নেই। যদি দরকারি কাজগুলো অন্য কেউ করে দেয়, তবে ষোলোকলা পূর্ণ হয়। তা যে হওয়ার নয়, এটিই হচ্ছে অসুবিধার ব্যাপার। আমার আলসেমির কেন্দ্রস্থান হচ্ছে শোবার ঘরের সাজানো খাট, যার মাথার কাঠের বোর্ডে এক জোড়া বালিশে হেলান দিয়ে আমি শুয়ে থাকি। কখনো কখনো দিনের খবরের কাগজ নিয়ে হালকা দৃষ্টিতে পড়ে থাকি। রাত ১২টার পর পছন্দের টিভি চ্যানেলে একটার পর একটা অনুষ্ঠান দেখি। কতবার ভেবেছি, আজ পড়ার ঘরে অন্তত দু-এক ঘণ্টা সময় কাটাব, কিছু সিরিয়াস পড়াশোনা বা লেখার কাজ করব। কিন্তু শোবার ঘরের কাছে যাওয়ামাত্র ওই খাট বা বালিশ আমাকে প্রচণ্ড শক্তিতে কাছে টেনে নিয়েছে। মনে মনে অদ্ভুত সব যুক্তির অবতারণা করে খাটের মাথায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়েছি। সাতসতেরো চিন্তা করে সময় কাটিয়ে দিয়েছি। কখনোবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছি, ঘুমিয়ে পড়েছি। যে অর্থবহ কাজ করব বলে পরিকল্পনা করেছিলাম, তা ভেস্তে গেছে। খাট-বালিশের টান অপ্রতিরোধ্য। একে কোনো দিন পরাস্ত করতে পারব বলে মনে হয় না।
কর্মহীন শারীরিক ও মানসিক নিষ্ক্রিয়তা একজন ব্যক্তিকে অপদার্থ সত্তায় পর্যবসিত করে। আয় ও সম্পদ সৃষ্টিতে তার কোনো অবদান থাকে না। মানবকল্যাণে সে কোনো ভূমিকা রাখে না। যদি সমাজ বা দেশের বিপুলসংখ্যক লোক এ ধরনের নিষ্ক্রিয় আলসে জীবন যাপন করে, তবে সে দেশ স্থবির হয়ে পড়বে এবং তার বাসিন্দারা ধীরে ধীরে দারিদ্র্যপীড়িত মানবেতর জীবনে ধুঁকে ধুঁকে মরবে। ফ্রানৎস কাফকার মতে, 'দুই ধরনের পাপ থেকে সব পাপের সৃষ্টি : ধৈর্যহীনতা আর আলস্য'। হিপোক্রেটস মনে করেন, 'অলসতা ও বেকারত্ব শয়তানির জন্ম দেয়।' মহাত্মা গান্ধী সুন্দরভাবে বলেছেন, 'অলসতা আনন্দের, কিন্তু সুখী হতে গেলে আমাদের কিছু না কিছু করতেই হয়।' অলসতাকে প্রশ্রয় দিলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, দারিদ্র্য বাড়বে এবং সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে দারিদ্র্যপ্রসূত নানা ধরনের অসন্তোষ ও সমস্যা, যা কোনো সমাজের কাম্য হতে পারে না। বিভিন্ন সমাজে ও ধর্মে আচার-অনুষ্ঠান এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে একজন ব্যক্তি মানসিক ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা পরিহার করতে বাধ্য হয়। বস্তুতপক্ষে বেঁচে থাকার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে অলসতা।
তবে সময়বিশেষে অলসতার পক্ষেও বক্তব্য এসেছে। যেমন আমরা শুনতে পাই, 'France was saved by her idlers' (অলসরাই ফ্রান্সকে বাঁচিয়েছে)। আবার হেনরি ডেভিসের মুখে শুনেছি, 'What is this life full of care, we have no time to stand and star.' আমি মনে করি এসব বক্তব্য গতানুগতিক অলসতার জয়গান নয়। এগুলো হচ্ছে যান্ত্রিক জীবন থেকে কিছুটা সময় অব্যাহতি (মুক্তি) নিয়ে নৈসর্গিক অবকাশে জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা, যাকে কোনো রকমেই অলসতা বলা যায় না; বরং একে যান্ত্রিক কর্মব্যস্ততার একঘেয়েমি কাটিয়ে সৃষ্টিধর্মী কর্মের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার পর্ব বলা যেতে পারে। এ ধরনের সাময়িক কর্মবিরতি আমাদের সবার কাম্য এবং এটি মানবসমাজের জন্য নিঃসন্দেহে কল্যাণকর।
যদি বৈষয়িক কর্মহীনতার এক আলোকোজ্জ্বল সময়ে কোনো ক্ষণজন্মা ব্যক্তি ধীর-শান্ত মনে জীবন-জগতের গূঢ়তম ও সুন্দরতম সম্পর্ক অনুধাবন করে সুকুমার শিল্পমাধ্যমে তা প্রকাশ করতে পারে, তবে সৃষ্টিশীল দ্রষ্টা হিসেবে তাঁর অধিষ্ঠান হয় দ্যুতিময় জগতের উচ্চতর মার্গে। সাধারণ মানুষ হয়তো বা প্রকাশ মুহূর্তের আগের সময়টাকে অলস মধ্যাহ্ন হিসেবে ভুল করে। আসলে এ মুহূর্তগুলো আলোকের পথ তৈরি করে। আমরা যেন সৃষ্টিগর্ভা নিস্তরঙ্গ দিনকালকে অলস সময় রূপে ভুল না করি, আবার একইভাবে শূন্যগর্ভ আলসেমিকে কোনো ধরনের রং লাগিয়ে মহিমান্বিত না করি, সেদিকে সবার সজাগ দৃষ্টি রাখা সমীচীন হবে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন