সংবাদপত্র পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে একটি বলিষ্ঠ শিল্প উদ্যোগ হিসেবে গড়ে উঠেছিল। তখনতো হাতে গোনা কয়েকটি দৈনিক ছিল। সর্বত্রই সাংবাদিক, প্রেস শ্রমিক ইউনিয়ন ও সাধারণ কর্মচারী ফেডারেশন ছিল। মালিকরা পত্রিকার সব দায়িত্ব সম্পাদকের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন। এমনকি প্রশাসন, বিজ্ঞাপন, সার্কুলেশন, হিসাব সংরক্ষণ ও সংবাদপত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গই কাজ করতেন। সংবাদপত্র এমন একটি শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার হিসাব ব্যবস্থা কিন্তু সাধারণ কোম্পানি বা বেনেতী দোকানের খাতা লেখার মতোন ছিল না। একটা পত্রিকা প্রকাশের আগে সংবাদপত্রকে হিসাব বিশ্লেষকের শরণাপন্ন হতে হতো। তারা যে হিসাব কষে দিতেন, তাতে করে মালিক তথা প্রশাসন সেই মতনই চলত, ফলে যে পত্রিকা দাঁড়াবার মতোন করে আত্মপ্রকাশ করত, তা এক-দু বছরে দাঁড়িয়ে গিয়ে লভ্যাংশের দিকে এগুতো। প্রচুর লাভের মুখ দেখেছে অনেক পত্রিকা। কিন্তু যখনই রীতি ভঙ্গ করেছে, তখনই সংশ্লিষ্ট পত্রিকা বসে পড়েছে।
ওপরের এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে মালিককে ‘পুঁজির’ কাছে ধরনা দিতে হতো। সংবাদপত্রে কিন্তু পুঁজি খুবই বড় ব্যাপার, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টাকা ঢেলে যথাযোগ্যভাবে সাজিয়ে যখনই বের হয়েছে কোনো পত্রিকা, তাৎক্ষণিক চোখে পড়েছে জনগণের। তখনই সেই সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তা বা পাঠক-গ্রাহক বেড়ে গেছে। সার্কুলেশন বেড়েছে। বেড়েছে বলেই বিজ্ঞাপনদাতারা তার পণ্যের প্রচারে ওই কাগজের অফিসে গেছেন। কিংবা জনপ্রিয় কোনো দৈনিকের বিজ্ঞাপন ম্যানেজার, সংগ্রাহক হয়তো প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা, অফিস আদালতের কাছে গেছেন। তারাও সোৎসাহে সেই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, সংবাদপত্র-কর্মীকে হতাশ করেননি। আবার এমনও হয়েছে, কোনো পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ তার ব্যক্তিগত প্রভাবেও অন্য পত্রিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কোনো আকর্ষণীয় অর্থকরী বিজ্ঞাপনটি আদায় করে নিয়েছেন। তা ছাড়া সার্কুলেশন ও জনপ্রিয়তা যে পত্রিকার ছিল তাদেরকে সেধে এসে বিজ্ঞাপন দিয়ে গেছে বিজ্ঞাপনদাতা অথবা বিজ্ঞাপনী সংস্থা।
সুতরাং বিনিয়োগকৃত পুঁজি হলো মূলভিত্তি পত্রিকা দাঁড়াবার জন্য। সে জন্য ওই বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিকেরা যে পদ্ধতি মেপে হিসাব করতেন, সেটার মূল বিষয় ছিল কাগজের কস্টিং। এটা বুঝতে পারলে পত্রিকার পৃষ্ঠানুযায়ী এবং পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা অনুযায়ী কস্টিং ঠিক করে যদি সংবাদের দিকে যথার্থ নজর দেয়া হয় এবং সম্পাদকীয় নন্দিত পাঠকগ্রাহ্য হয়, তাহলে অঙ্কে মিলে যায় এবং পুঁজি বিনিয়োগকারী আর পেছনে তাকান না। এটাতো ঠিক, যিনি সংবাদপত্রের মালিক কিংবা পুঁজি বিনিয়োগকারী তিনি তো আর দেশ সেবার জন্য পত্রিকা বের করেন না। অবশ্যই তিনি একটা সময় পুঁজি ফেরত চান এবং তার পরও বাড়তি অর্থ লাভের আশা করেন। অবশ্যই করবেন। কারণ তিনিতো টাকা ঢালেননি বিনোদনের জন্য কিংবা সেবা করার জন্য। তবে আমাদের সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে দেখেছি, পত্রিকা মালিক লভ্যাংশ আশা করেছেন কিন্তু সঙ্গে দেশের সেবা ও জনগণের কল্যাণের কথাও ভাবতেন। পত্রিকা পুরোপুরি পণ্য ছিল না। আমরা বলতাম, সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। সেটা যথার্থ ছিল। কিন্তু কোনো মালিক ক্বচিৎ-কদাচিৎ সামনে আসছেন, তাদের যা কিছু বলার বা করার, তা তারা সম্পাদক মহোদয়কে বলতেন। সম্পাদক যে পরামর্শ দিতেন, সেটাই গ্রহণ করতেন। নীতি সম্পাদকই নির্ধারণ করতেন। কোনো মালিক আবার তার একজন প্রতিনিধির মাধ্যমে খবরদারি করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সম্পাদককে অমান্য করার ক্ষমতা তাদেরও ছিল না। পত্রিকা সম্পাদক সংবাদ বিভাগের প্রধান বার্তা সম্পাদক, সম্পাদকীয় বিভাগের সহকারী সম্পাদকদের এবং তখনকার দিনের তিনটি পালার তিন শিফট ইনচার্জ, চিফ রিপোর্টার, সংশোধনী বিভাগের প্রধানদের নিয়ে প্রতিদিনই বৈঠক করতেন। দৈনন্দিন ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে আলোচনা করতেন। কোনো কিছু ভালো হলে সেজন্য প্রশংসা করতেন। মৌখিক প্রশংসাই ছিল তাদের জন্য মহামূল্যবান প্রাপ্তি। যা হোক, ওই বৈঠকেই নীতি আলোচনা হতো, সংবাদ বিষয়ে মতবিনিময় করতেন। ছবির খুব একটা বালাই ছিল না, কারণ তখনকার দিনে ফটোগ্রাফারই থাকত না কোনো কাগজে। তখন স্টুডিও ফটোগ্রাফারদের কাছ থেকে দরকার হলে অর্ডার দিয়ে ছবি তুলিয়ে নেয়া হতো। তা-ও খুব জোর একটি কি দুটি কাগজে। ছবির ব্যবহার হতো আমেরিকা ও ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে যে ব্লক পাঠানো হতো, তা দিয়েই ছবির সাধ পূরণ করা হতো। ফলে স্থানীয় কোনো ছবি সহসা পাওয়া যেত না। আর্টিস্টের তো কোনো বালাই ছিল না। দস্তার তৈরি টাইপে সব ছাপা হতো। পয়েন্টের মাপ ছিল, সেই হিসাবে হেডিং টাইপ তৈরি হতো আর সংবাদ কম্পোজ হতো হাতে। কাঠের খাপ খাপ ডালায় নির্দিষ্ট খাপে অক্ষরগুলো সাজানো থাকতো। একেকজন চারটে ডালা ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে ও ওপরে রাখা ডালায় বসে কম্পোজ করতেন, তখন খবরের কাগজের সাইজ এখনকার চেয়ে খানিকটা বড় ছিল। কলাম ছিল বড়। সাত কলামে এক পাতা হতো।
আমি যখন ১৯৫৫ সালে সংবাদপত্রে যোগ দিয়েছিলাম একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে, তখন সকাল, দুপুর আর রাত তিন পালায় কাজ হতো। তিনজন শিফট ইনচার্জের দায়িত্বে থাকতেন। সহ-সম্পাদক থাকতেন কয়েকজন করে, তারা নির্দিষ্ট পাতা ভরার দায়িত্বে থাকতেন। রিপোর্টার রিপোর্ট লিখতেন। চিফ রিপোর্টার দেখে নিউজ টেবিলে শিফট ইনচার্জ বা পালাধ্যক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। সর্বশেষ তিনি রিপোর্টটির শিরোনাম করে খাতায় এন্ট্রি করে পিয়নের হাতে প্রেসে পাঠাতেন। তারপর ওই পদ্ধতিতে কম্পোজ হতো লাইনকে লাইন। পরপর বসানো লাইনগুলো একত্র করে এক কলাম হতো। এমনি সব সংবাদ আট কলামে বসত এবং একেকটি সংবাদের নানা মাপের শিরোনাম হতো। তখন ফার্স্ট লিড, সেকেন্ড লিড, থার্ড লিড, সিঙ্গেল কলাম, ডবল কলাম, তিন, চার, পাঁচ কলাম এমনকি ব্যানার হেড লাইনও হতো। আবার লিড নিউজগুলোর হেডিং বক্সের ছিল। ধরুন, প্রথম লিড ৫ কলাম হলো। তার প্রথমে ৫ কলাম হেডিং মূল সংবাদের বিষয়ের ওপর, দ্বিতীয়টি হয়তো ৩ কলামে হলো তাতে থাকলে কোথায় কে বলেছেন, তৃতীয় একটা হেডিং হলো ২ কলামে তাতে সংবাদের আরেকটি বিষয় থাকতো। তারপর ২ কলামে রাইট আপ থাকত বড় পয়েন্টে, ১২ কি ১৪ পয়েন্টে। এমনও হতো, নিউজ চলে গেছে হেডিং পরে গেল, প্রথম হেডিং, দ্বিতীয়, তৃতীয় হেডিং হিসেবে। প্রেসের যিনি ফোরম্যান, তিনি সমন্বয় করতেন। মেকআপম্যান নিউজ থেকে দেয়া হেডিং অনুযায়ী সংবাদগুলো বসিয়ে পুরো পাতা সাজাতেন। অবশ্য এইসব কম্পোজ করা নিউজ, এডিটোরিয়াল, চিঠিপত্র, রিপোর্ট, বিজ্ঞাপন সবকিছুরই প্রুফ দেখতেন প্রুফ রিডাররা। তারা বাক্য, বানান ঠিক আছে কি না, দেখতেন, দরকারে শুধরে দিতেন। তারপর চলে যেত ফোরম্যানের কাছে। তিনি পেজ বাঁধতেন কাঠের ফর্মায়। তারপর দক্ষতার সঙ্গে এমনভাবে এঁটে দিতেন, যেন একটি অক্ষরও খুলে না পড়ে। টাইট করে বেঁধে তার পর দুটো পেজ একসঙ্গে ছাপার জন্য মেশিনে তোলা হতো। প্রথমদিকে দপ্তরীদের মাধ্যমে কাগজ ভাঁজ করে সার্কুলেশনের কোনো প্রতিনিধি সরাসরি হকারদের হাতে বিক্রি ও সৌজন্য কপি বিলির জন্য দিতেন। এভাবেই কাগজ প্রকাশনা ও বিলি হতো। পৃষ্ঠা ছিল ৬। বড়জোর ৮ পাতা।
নিউজ সেকশনের কাজ শেষ হতো রাত দুটো থেকে তিনটা সাড়ে তিনটায়। ছেপে বের হতে ভোর হয়ে যেত। ট্রেন, লঞ্চ ও বিমান মেল ধরার তাড়া তেমন ছিল না। রাতে কাজ শেষে বাড়ি যেতে হতো হেঁটে। রাস্তায় কেবল পুলিশ আর কুকুরদের সঙ্গে দেখা হতো। চোর কদাচিৎ। ছিনতাই ছিল না বললেই চলে।
আমার সুদীর্ঘ ৬০ বছরের সাংবাদিক জীবনে যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তার পেছনে আমার নিজের পায়ে দাঁড়াবার সাধ এবং প্রয়োজন ছিল। রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা এবং ছাত্রজীবন থেকে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকাই সাংবাদপত্রে প্রবেশ এবং সাংবাদিকতায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তবে পারিবারিক ধারাবাহিকতাও ছিল আমাদের। সংবাদপত্রে এসে ঢাকার রাজনীতি ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ক্রমশ জড়িয়ে যাই। তার জন্যে সাংবাদিকতা পেশায় এসে ইউনিয়ন করার তাগিদ বোধ করি। এছাড়া তখনকার সংবাদপত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতি সচেতনরা এবং উঠতি কবি-সাহিত্যিকরাই বেশি ছিলেন সংখ্যায়। তখন একটা দৈনিক বের করতে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা হলেই হয়ে যেত। তবে একটু যতœসহকারে যারা কাগজ বের করতে চাইতেন তাদের ব্যয় খানিকটা বেশি ছিল। কিন্তু বেতন একই ছিল। কোনো কাঠামো ছিল না। শুরুটা হতো মাসিক ৭৫ টাকায়। তখনকার বাজার দর, বাড়ি ভাড়া, থাকা খাওয়া, যাতায়াত সবমিলে অর্থনৈতিক জীবনটায় ঐ টাকায় চলে যেত। আর যারা ছাত্র, একা জীবন কাটাতেন, তাদের জন্যতো কথাই নেই।
তখনকার দিনে মওলানা আকরাম খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আব্দুস সালাম, মোহাম্মদ মোদাচ্ছের, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খায়রুল কবির, জহুর হোসেন চৌধুরী, মহিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ ছিলেন পত্রিকা সম্পাদক এবং কেউ কেউ মালিকও। তখনকার দিনে এত বাইরের কলাম লেখক বা উপসম্পাদকীয় লেখক কেউ ছিলেন না। সব কাজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদকরাই করতেন। এমনকি কোথাও চিঠিপত্রও নিজেরা লিখতেন। বাইরের কোনো লেখা আজকের মতো ছাপার রীতি ছিল না। কারণ কাগজের নীতিমালা না জানলে এ লেখা সম্ভব ছিল না। তবে বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের লেখা ছাপা হতো বিশেষ সংখ্যায়। বিশেষ বিশেষ দিনে যে বর্ধিত কলেবরে কাগজ প্রকাশ করা হতো, তখন তাদের লেখা নেয়া হতো। উপযুক্ত সম্মানী দেয়ার ব্যবস্থাও ছিল। কবিতা ১৫ থেকে ২৫ টাকা আর প্রবন্ধ ৫০ থেকে খুব জোর ১০০ টাকা সম্মানী ছিল।
সত্যি কথা বলতে কি, তখন রাজনীতি সংবাদ হিসেবে বা সরকারের কোনো খবর, মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা হলেই গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতো না। লিড হতো বিশেষ বিশেষ অনুসন্ধানী রিপোর্ট এবং তাতে অবশ্যই রাজনীতিও থাকত। প্রকাশিত দৈনিকগুলোর প্রথম সংবাদ বা ফার্স্ট লিড কখনোই এক হতো না। ষাটের দশক পর্যন্ত ফার্স্ট লিড করতে রিপোর্টারদের আইটেমের ওপর নির্ভর করতে হতো। এক্সক্লুসিভ সংবাদ বা রিপোর্ট থাকত প্রতিটি কাগজেই। সরকার বা মন্ত্রী-শান্ত্রির সংবাদ কি ছাপা হতো না, হতো কিন্তু প্রতিদিনই গুরুত্ব দিয়ে নয়। গুরুত্ববহ, জাতীয় পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সংবাদ হলে তা প্রাধান্য পেত। কিন্তু খুব একটা লিড হয়েছে বলে মনে পড়ে না। তখন ব্যানার হেড লাইনে প্রায়শই ছাপা হতো গুরুত্বপূর্ণ নিউজ। ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ, পাঠক-আগ্রহী আকর্ষণীয় সংবাদ ‘বক্স’ আইটেম হিসেবে ছাপা হতো।
সে সময় বিজ্ঞাপন ছাপারও নীতিমালা ছিল। যত যাই হোক, সংবাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রাধান্য পাবে না, এমনটাই ছিল। সংবাদ অবশ্যই ৫০ ভাগ হতে হবে। বিজ্ঞাপন ৫০ ভাগের বেশি হতে পারবে না। প্রথম পৃষ্ঠায় র্৬র্ ঢ ২ কলাম, র্৮র্ ঢ ৩ কলাম বড় জোর ১র্০র্ ঢ ৪ কলাম আকারে দুটো বিজ্ঞাপন ছাপা যেত কিন্তু সেটা কাগজের নিচের অংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তবে দৈনিকের দুটো কাজ ছিল, যাকে ‘এয়ার প্যানেল’ বলা হতো। সেটি ছিল ছোট্ট বিজ্ঞাপন। যা ছিল চুক্তিবদ্ধ, সারা বছরের জন্যও হতে পারতো। আজ আর সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন ছাপার কোনো নীতি-রীতি মানা হয় না।
বিজ্ঞাপনদাতারা যেভাবে চাইবে সেভাবেই ছাপাতে হবে, কারণ টাকা দিচ্ছে তারা। এখনও তো সেই পত্রিকাই আছে, কলেবরে বেড়েছে, প্রকাশনার সংখ্যা বেড়েছে, লোকবল বেড়েছে, বেড়েছে বেতনও। কিন্তু পত্রিকার নৈতিকতা বিসর্জন দেয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয়। যেভাবে খুশি তেমনি ছাপা হচ্ছে বিজ্ঞাপন। পাতার মাঝখানে বসানো হচ্ছে, না হলে পেটে আড়াআড়ি করে বিজ্ঞাপন ছাপানো হচ্ছে। এমনকি প্রথম পাতার সপ্তম কলামজুড়ে লম্বায়, এক কলাম বিজ্ঞাপনও কালারে ছাপা হচ্ছে। এই যে বিজ্ঞাপন প্রকাশের যথেচ্ছতা, পত্রিকার নীতি-নৈতিকতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। সংবাদপত্র যে বিজ্ঞাপন-নির্ভর এমনই ধারণা দিচ্ছে। সংবাদপত্র তো এমন ছিল না। হ্যাঁ, কেউ হয়তো বলতে পারেন প্রাচীনকালে তো পত্রিকার প্রথম পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হতো তা-ও ডিসপ্লে বিজ্ঞাপন নয়, ক্লাসিফাইড। হ্যাঁ, তা মানছি কিন্তু তা খুবই সীমিত ছিল। পরে সংবাদই ছিল সংবাদপত্রের প্রধান উপাদান। সার্কুলেশন-নির্ভর ছিল অনেকটা। কিন্তু বিজ্ঞাপন যখন ডিসপ্লে আকারে আসতে থাকল, তখন সংবাদপত্রের সৌন্দর্য ও বৃদ্ধি পেয়েছে এ অনস্বীকার্য। তাছাড়া বিজ্ঞাপনওতো চাই, না হলে মালিক কেবলই পুঁজি ঢেলে যাবেন, রিটার্ন পেতেও তো চাইবেন। এটা ঠিক, তবে রুচিবোধের বাইরে যেন না যায়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে, কারণ এটাতো সংবাদপত্র, পাঠকের জন্য, খবরের জন্য। বিজ্ঞাপন পণ্যের বাহারিয়া গুণাবলি কিংবা প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে প্রচারিত হয় জনগণের জন্য। এটা কিন্তু সীমিত সংখ্যক অর্থলগ্নীকারীদের জন্য।
মুদ্রণের দিক থেকে আমরা পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত গুহাযুগেই বাস করেছিলাম। হাতে এবং টাইপ খুঁজে খুঁজে কম্পোজ করতে হতো। সময় লাগত প্রচুর। পরে অবশ্য ষাটের দশকে এলো মনো, লাইনো টাইপÑসময় বাঁচল মেশিনে কম্পোজ করায়, পরিচ্ছন্নও হলো কম্পোজ করা ম্যাটার। প্রযুক্তির ক্রমোন্নতির ফলে ট্রেডল মেশিনে হাতে ছাপানোর কপি কেটে গেল, দু-একটি পত্রিকায় রোটারি মেশিন এসে ছাপার দ্রুতগতি আরও বাড়িয়ে দিল। এলো রোটারি অফসেট। অফসেট আসায় সংবাদপত্রের চেহারায়ও প্রসাধনীর ছাপ পড়ল। রঙিন হলো কাগজের অঙ্গ। পাতা ছয় থেকে বাড়তে বাড়তে ১২-১৬ পৃষ্ঠায় উঠল। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন সাধনের সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্র জগতে যে সমৃদ্ধি এলো, তার প্রভাব সংবাদ পরিবেশন, পত্রিকার মেকআপ, গেটআপ, রং-চংয়ের বিজ্ঞাপন ছাপা, হেডিং রঙিন হতে থাকল। কাগজের গতিও দ্রুত হতে থাকল। এখন তো রাত ১১-১২টায় লাস্ট নিউজ দিয়ে ছাপা শুরু হয়ে যায়। সংস্করণের পর সংস্করণ প্রকাশ পায়। অনলাইনে চলেও যায়। ঘরে বসে, বিদেশেও বাংলা পত্রিকা কিংবা দেশের কাগজ দেখতে পান ইচ্ছুক বাংলা ভাষাভাষী পাঠক। যান্ত্রিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। খবরে সম্পাদকীয় কি উপ-সম্পাদকীয়তে ফিচারে, ছবিতে, রিপোর্টের ভাষা, রচনাশৈলী ও কৌশলে এগুলো লক্ষণীয়। তবে তখনকার দিনে রিপোর্টার যারা, তারা বাই লাইন পেতেন না। স্টাফ রিপোর্টার, বিশেষ সংবাদদাতা ইত্যাদি পরিচয়ে লিখতে হতো। কোনো রিপোর্টার সে যত বড়ই হোন না কেন, যত বড় ঝুঁকিপূর্ণ রিপোর্টই করুন না কেন, সহজে তার নাম ব্যবহার করা হতো না। আজকাল তিন-চার দশক ধরে বাই লাইন দেয়াটাই রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গেছে।
সংবাদপত্রের সেকালের কথা বিস্তারিত লিখতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে, তাই নিজকে সংবরণ করে সংক্ষিপ্ত আকারে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরলাম। বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিক বন্ধুরা, মালিক, সম্পাদক ও ইউনিয়ন নেতারা জানতে পারবেন কেমন ছিল সেকাল। তবে শেষ করবো সাংবাদিক ইউনিয়নের ভূমিকার কথা বলে। জানলে খুশি হবেন, ওয়েজ বোর্ড নয়, সাংবাদিকদের সার্বিক পেশাগত উন্নয়ন সাধন, বেতনের সুনির্দিষ্ট কাঠামোর দাবিতে সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রবল আন্দোলন এবং সিদ্ধান্তনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের করাচির এক সিনিয়র সাংবাদিক নেতাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। তা-ও তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার এবং পত্রিকার মালিকেরা নত হননি এবং দমনপীড়ন এবং শোষণ চালিয়ে গেছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন এরই মধ্যে স্মারকলিপি দেয়া, সভা-সমাবেশে প্রতিবাদ করা, মতবিনিময় অব্যাহত রাখে। তখনকার সময়ে পত্রিকা ধর্মঘট করাটা বেশ কঠিন ছিল। কারণ মালিকরা নিয়োগপত্র সর্বত্র দিতেন না। বেতন কম দিয়ে কাজ করাতেন, প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। যেকোনো সময় বরখাস্তের হুমকি দিত, এমনকি চাকরিচ্যুতও করত। তার পরও পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে সাংবাদিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও সংবাদপত্রের সুযোগ-সুবিধার কথাও বলত। তাই সংঘবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল শক্ত ভিতের ওপর। আর পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং প্রতিটি পত্রিকা অফিসে ইউনিয়নের সক্রিয় ইউনিট ছিল। ফলে ফেডারেল ইউনিয়ন আমাদের ওপর নির্ভর করত আন্দোলন করতে গিয়ে।
সেই সঙ্গে সংবাদপত্র সম্পাদক, যারা ইউনিয়নের অভিভাবক এবং সম্মানিত সদস্য ছিলেন, তাদের বলিষ্ঠ সরকারবিরোধী ভূমিকা ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকেও দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করত। এখন যার অভাব প্রকট।
সংঘবদ্ধ ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিকরা একটি ব্যানারের তলায় ছিলেন। পাকিস্তানে যখন আইয়ুবী শাসন নেমে এলো, নিপীড়ন শোষণের মূর্তিমান প্রতীক হয়ে সাংবাদিক সমাজ কখনও কোনোভাবেই মাথা নত করেনি। অবশেষে সামরিক সরকার বাধ্য হলো ওয়েজ বোর্ড দিতে। স্বীকার করতেই হবে, আজও সে ওয়েজ বোর্ডের ধারাবাহিকতা চলছে, তা কিন্তু আইয়ুব খানের মতোন দুর্র্ধর্ষ স্বৈরাচারী সামরিক শাসকও দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এই বেতন-ভাতা রোয়েদাদ ঘোষণা গ্রহণ করলেও ইউনিয়ন বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার প্রতিবাদ করে। প্রিন্টিং প্রসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করলে গণবিরোধী এই আইনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক ইউনিয়ন সাংবাদিকতার স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হলেন সারা পাকিস্তানে। আন্দোলন কাকে বলে পূর্ববঙ্গ সেদিন সেই সামরিক রক্তচক্ষুর মধ্যেও দেখিয়ে দিয়েছিল। ১৭ দিন কোনো খবরের কাগজ বের হয়নি পাকিস্তানের কোনো অঞ্চল থেকে। কেঁপে উঠেছিল সামরিক সরকারও। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চেয়ে সাংবাদিকের কণ্ঠরোধের প্রতিবাদে সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের বেতার ব্যক্তিত্ব এবং লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরাও সংহতি প্রকাশ করতে সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন। সে এক অনন্য ঘটনাই ছিল সাংবাদিকতার ইতিহাসে। অবশেষে কিন্তু সরকারকে মাথানত করতে হয়েছিল। তবে সেটা ছিল কৌশল। তারা তাদের দমন আইনকে ঠিকই জারি করেছিল।
কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে এত পত্রিকা বেরিয়েছে এবং এখনও বেরুচ্ছে। মনে হয়, গিনিজ বুক রেকর্ডস’-এ আমরা স্থান পেয়ে গেছি। এত কাগজ কোনো একটি শহর থেকে বের হয় বলে আমার ধারণা নেই। কটা প্রত্যহ বেরোয়? কটা হাতে নেয়া যায়? যেগুলো পাঠক গ্রাহ্য করেন, সেই সব কাগজে কি ইউনিয়ন আছে? ইউনিয়নের শক্তিটা কোথায়? কেবল বক্তৃতাবাজিতে ইউনিয়ন হয় না। কোনো আন্দোলন সেভাবে দাগ কাটতেও পারে না। কত যে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে কাগজে কাগজে তার কোনো খবর কি সরকার রাখে? অন্যদিকে ম্যাডাম জিয়ার জাদুস্পর্শে ইউনিয়ন এখন বিভক্ত। সাংবাদিক ঐক্য নেই। মালিকদের সুবিধা হয়ে গেছে। তাই ইউনিয়ন করতে দেন না। পাকিস্তান আমলেতো পাকিস্তান ফেডারেশন সাংবাদিক ইউনিয়ন একটি ঐক্যবদ্ধ সংগঠন ছিল। ফলে সবাই ভয় পেত সাংবাদিক সংঘবদ্ধতাকে, মালিক এবং সরকার দুজনই। এখন ভয় নেই সাংবাদিক খুন হয়ে যাচ্ছে, আসলে কিন্তু কোনো সরকারই তার বিহিত করছে না। এই ইউনিয়নই কিন্তু দেশের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের শক্ত-খুঁটি ছিল। ইউনিয়নে বহুমত সত্ত্বেও পাকিস্তানি দুঃশাসনবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয় এবং অগ্রণী ভূমিকা ও পালন করেছে? ভাষা আন্দোলন শেষে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশেও সাংবাদিকদের সচেতন ও সাহসী চরিত্র বজায় ছিল। কিন্তু দলীয় করণের নিষ্ঠুরতায় সাংবাদিকতার মতোন পবিত্র ও জনসেবামূলক পেশাকে আজ কোথায় নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। পাকিস্তানে যে সাহস মালিকেরা পেতেন না, এখন দেখছি যখন খুশি চাকরি দিচ্ছে, খাচ্ছে। ওয়েজ বোর্ড দিচ্ছে না অথচ সরকারকে খাতা কলমে দেখাচ্ছে দিচ্ছে বলে। শুধু কি তা-ই, এমনও কাগজ আছে যারা কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়ে বেমক্কা ছাঁটাই করে সাংবাদিকদের। ইদানীং এমনি ঘটনা রাজধানীতে ঘটেছে পুরনো একটি প্রগতিশীল কাগজে। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় জানে বিষয়টি, কিন্তু মালিককে কিছু বলেছে বলে শুনিনি। এমন দুর্দিনে সিনিয়রসহ এতগুলো সাংবাদিক হঠাৎ ছাঁটাই হলে কি সরকার আইন অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা ওই পত্রিকা মালিক বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিতে পারেন না?
অভিযোগটা খালেদা জিয়াকেই করব, কারণ তার আমলে বশংবদ সাংবাদিকদের দাপট বজায় রাখা এবং তাদের সুযোগ-সবিধা দেয়ার জন্য ইউনিয়নটাকে দু’ভাগে ভেঙে দিলেন। নির্দিষ্ট করে একাংশকে তিনি তাঁর পক্ষে পেয়ে গেলেন। কেবল রাজনীতি নয়, এর ফলে সাংবাদিক সমাজ নিপীড়ন নির্যাতন, হত্যা, অপহরণ কত কিছুর শিকার হচ্ছেন, তার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আর খালেদা জিয়ার সমর্থক সাংবাদিক ক’জন নেতা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে বিষোদগার করেই যাচ্ছে, গলাবাজিতে, তাতে হচ্ছে না কিছুই। রাজনৈতিক ফায়দাও পাচ্ছে না। তাই ভাবছি, এত ফারাক সেকাল আর একালে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন