সৌদি আরবে বসবাসরত প্রবাসীদের ভাবনা
26 Sep, 2014
হজরত মুহাম্মদ সা:-এর স্মৃতিবিজড়িত মক্কা ও মদিনা নগরী মুসলমানদের অন্যতম তীর্থস্থান। প্রতি বছর হজ ও ওমরাহ পালনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু লোক দু’টি শহরে যান।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে একটি গ্রামে দু-একজন হাজী পাওয়া কঠিন ছিল। এমনও গ্রাম ছিল যেখান থেকে কারো হজে যাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু আজ দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। প্রতি বছর আমাদের দেশের লক্ষাধিক লোক হজ ও ওমরাহ পালন করে থাকেন। এর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এখন এমন কোনো গ্রাম নেই, যে গ্রামে দু-চার-দশজন হাজী নেই।
হজ বা ওমরাহ পালনের উদ্দেশে হাজীদের কেউ কেউ উড়োজাহাজে জেদ্দায় অবতরণের পর সেখান থেকে প্রথমে মক্কায় ওমরাহ বা হজ পালন শেষে মদিনায় যান। আবার এমন অনেক আছেন যারা জেদ্দা থেকে প্রথমে মদিনায় গিয়ে সেখানে সর্বোচ্চ আট দিন থেকে মক্কা যান। উড়োজাহাজে করে সরাসরি মদিনায় যাওয়ারও ব্যবস্থা আছে এবং এভাবে যারা যান তারা প্রথমে মদিনায় হজরত মুহাম্মদ সা:-এর রওজা মোবারক জিয়ারত ও মসজিদে নববীতে নিজের মনোবাসনা অনুযায়ী নির্ধারিত ওয়াক্তের নামাজ আদায় শেষে মক্কা যান। ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে অমুসলিমদের সাথে যে তিনটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ হয়েছিল এর দু’টির প্রান্তর যথা ওহুদ ও খন্দক মদিনার কাছেই। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরের প্রান্তর মদিনা থেকে ১৭০ কিলোমিটার দূরে। হজরত মুহাম্মদ সা: তার বাহিনী নিয়ে বদরের প্রান্তরে যাওয়ার সময় মাঝপথে বিশ্রামের জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন এবং সেখানে যে কূপটি থেকে তিনি ও তাঁর সাহাবিরা পানি পান করেছিলেন, এর নাম ‘বিরে রুহা’। এই কূপে এখনো পানির প্রবাহ বিদ্যমান আছে এবং এ কূপের পানিকেও জমজমের অনুরূপ উপকারী বিবেচনা করা হয়। হাজীদের অনেকে হজ পালনের সময় জিয়ারতের উদ্দেশে ওহুদ ও খন্দকের প্রান্তর সফর করলেও বদরের প্রান্তর সফর করার সৌভাগ্য খুব কমসংখ্যক হাজীর হয়। এর পেছনে দু’টি কারণ রয়েছে। এর একটি হলো এ সফরটি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ এবং অপরটি হাজীদের মক্কা, মদিনা ও জেদ্দা নগরীর বাইরের অন্য কোনো স্থানে যেতে হলে বিশেষ অনুমোদন গ্রহণের প্রয়োজন হয়। বদরের প্রান্তর সফরের ক্ষেত্রেও বিশেষ অনুমোদন প্রযোজ্য।
মক্কা ও মদিনা ছাড়া হজরত মুহাম্মদ সা:-এর স্মৃতিবিজড়িত অপর একটি শহর তায়েফ। হজরত মুহাম্মদ সা: তার দুধমা হালিমার ঘরে অবস্থান করে তায়েফে অতিবাহিত করেন। আবার এ তায়েফ শহরে ইসলাম প্রচারে গিয়ে তিনি বিধর্মীদের হাতে চরমভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন। সৌদি আরবের অন্যান্য অঞ্চলের মতো তায়েফের আবহাওয়া রুক্ষ নয়। এখানে প্রায়ই বৃষ্টি হয়। তায়েফ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আট হাজার ফুট উচ্চতায় স্থিত। এ শহরটি চতুর্দিক থেকে পাহাড় বেষ্টিত হলেও এর উপরিভাগ সমতল। তায়েফের চতুর্পাশ সবুজের শ্যামলিমা আচ্ছন্ন। তায়েফের বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে যেসব ফলের বাগান রয়েছে, এগুলোর ভেতরে ঢুকলে ভাবতে অবাক লাগে কিভাবে পাহাড়ের মধ্যে আমাদের দেশীয় ফল আম ও তরমুজসহ বিভিন্ন জাতের ফলের উৎপাদন সম্ভব!
আমার ইতঃপূর্বে ওমরাহ ও হজ পালনের উদ্দেশে দুই বার সৌদি আরব যাওয়ার সুযোগ ঘটলেও এবারই প্রথম তায়েফ যাওয়ার সুযোগ হয়। সৌদি আরবের প্রতিটি শহরেই বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক ও ব্যবসায়ী রয়েছেন। তা ছাড়া বেশ কিছু পেশাজীবীও রয়েছেন। এদের কেউ বা চিকিৎসক, কেউবা প্রকৌশলী আবার কেউ বা কৃষিবিদ। শ্রমিকদের বেশির ভাগই একা বসবাস করেন। পরিবারসমেত বসবাস করেন এমন প্রবাসীর সংখ্যা সীমিত। আমাদের দেশের এমন অনেকে আছেন, যারা সৌদি আরবে চাকরির উদ্দেশে গিয়ে পরবর্তীকালে নিজেদের ব্যবসায় নিয়োজিত করেছেন। সৌদি আরবে বসবাসরত বাঙালিরা দুভাবে ব্যবসায় করে থাকেন। এর একটি হলো সৌদি মালিকের দোকান ও ভবনে ব্যবসায় পরিচালনা করে তাকে বছরে নির্র্ধারিত অঙ্কের অর্থ দেন, আর অপরটি হলো সৌদি মালিকের ব্যবসায় পরিচালনা করে প্রতিদিনের হিসাব তাকে বুঝিয়ে দিয়ে মাস শেষে মালিক থেকে নির্ধারিত অঙ্কের বেতন ও ভাতা নেন। কোনোরূপ পরিশ্রম না করে অতি সহজে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকায় সৌদি আরবের জনগোষ্ঠীর এক বিপুল অংশ কর্মবিমুখ হয়ে পড়ছেন। এদের অনেকে ভোগবিলাসে জীবন অতিবাহনে ব্যস্ত।
বাংলাদেশের যেকোনো যাত্রী হজ, ওমরাহ বা কাজের জন্য সৌদি আরব গেলে তার জেদ্দা বিমানবন্দরের বহির্গমন বিভাগের কার্য সমাধা করে বের হয়ে আসতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লেগে যায়। এবার ওমরা পালনের উদ্দেশে সৌদি আরব যাওয়ার সময় আমার সঙ্গী ছিলেন সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশী সিআইপি কাজী শাহ আলম, যিনি ঝুনু নামে সমধিক পরিচিত।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে আমার স্ত্রীসহ হজ পালনের সময় মুকিব ভাইয়ের সাথে পরিচয়। সে সময় তিনি এক দিন জেদ্দা থেকে মক্কায় এসে আমাদের তার জেদ্দার বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। সেবার ঝুনু ভাই তার স্ত্রীসহ আমাদের সাথে হজ পালন করেছিলেন।
তায়েফ শহর ঘুরে দেখার সময় আমার নিজ জেলা নিবাসী আবুল কালাম নামক এক ফল ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হলো। তিনিও বিএনপির সমর্থক। তার স্বল্প আয় থেকে উপজেলা নির্বাচনের সময় তিনি বিএনপিদলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থীর জন্য সামান্য কিছু অর্থ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তার আফসোস নির্বাচনী মাঠ তার প্রার্থীর অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও কারচুপির মাধ্যমে সরকারি দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করা হয়েছে। ক্ষণিকের পরিচয়ে কালাম যেভাবে আমাদের আপন করে নিলেন এবং আমাদের গাড়িতে পথে খাওয়ার জন্য জোর করে কিছু আম ও তুতফল দিয়েছিলেন তা ভাবতে অবাক লাগে এ কারণে যে, তিনি তো আমাদের নিকট কোনো বিনিময়প্রত্যাশী নন।
সেদিন তায়েফ থেকে মক্কা ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকালে মদিনার উদ্দেশে যাত্রার সময় শাহাবুদ্দিন ও মোতালেব আমাদের বিদায় জানানোর জন্য হোটেলে এসে উপস্থিত এবং তারা আমাদের সাথে বাসস্ট্যান্ড অবধি গেলেন। বিদায় জানানোর মুহূর্তে তাদের উভয়ের মধ্যে যে আবেগ দেখলাম তাতে মনে হয়েছে তারা উভয়ে তাদের পিতৃতুল্য কাউকে বিদায় দিচ্ছেন।
মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব সড়কপথে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার এবং বিলাসবহুল বাসে এ দূরত্ব অতিক্রম করতে চার ঘণ্টা লাগে। মদিনায় রেডিসন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হলো এবং সেখানে পৌঁছানোর পর প্রথমে মুকিব ভাইয়ের টেলিফোন পেলাম এবং তিনি জানালেন নুরুজ্জামান নামক এক ভদ্রলোক কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের সাথে কথা বলবেন। ঠিকই কিছুক্ষণ পর জামান সাহেব টেলিফোন করলেন এবং আলাপচারিতায় জানা গেল আমরা উভয়ে একই জেলার অধিবাসী। মদিনায় অবস্থানকালীন জামান সাহেব তিন রাত আমাদের সান্নিধ্য দিয়েছেন। জামান সাহেব ছাড়া মদিনায় সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী রাশেদ ও প্রবাসী বাংলাদেশী মিরু তাদের সাধ্যমতো আমাদের দেখভাল করায় সচেষ্ট ছিলেন। জামান সাহেব মদিনা বিএনপি আহ্বায়ক কমিটির সভাপতি ছাড়াও সৌদি আরব কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসভাপতি। মুকিব ভাইসহ সৌদি আরবে অবস্থানকালীন বিএনপির রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট যাদের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে তারা সবাই এক কথায় নিবেদিতপ্রাণ। রাজনীতির চেয়ে মানবসেবা তাদের কাছে অনেক বড় এবং একইভাবে রাজনীতির চেয়ে তারা দেশ নিয়ে অধিক চিন্তিত। তাদের সবার একই কথাÑ আমরা সব সময় চিন্তা করি আমরা দেশকে কী দিতে পারলাম আর এর বিনিময়ে দেশের কাছে আমাদের প্রত্যাশা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে যেন এমন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যা স্থিতিশীলতার পাশাপাশি দেশকে সুখ ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(নয়া দিগন্ত )
পাঠক মন্তব্য
All of your vibnart blues stand out so lovely to me - Sweet skies, cotton candy clouds and happy faces shall you meet all day - Karen
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন