কার স্বার্থে উপেক্ষিত?
19 Sep, 2014
পুস্তক জ্ঞানের আধার। পুস্তকের রয়েছে শ্রেণিভেদ। সাহিত্য, ভ্রমণ, বিজ্ঞান, রাজনীতিক, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ইত্যাদি নানা বিষয়ের পুস্তক। সাহিত্যবিষয়ক পুস্তক কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গল্প প্রভৃতিতে বিভাজিত। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পুস্তককে পাঠ্যপুস্তক বলা হয়। পাঠ্যপুস্তক বিষয়ভিত্তিক এবং বিশেষায়িত জ্ঞানসমৃদ্ধ।
আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে রচনা, সম্পাদন ও মুদ্রণ করা হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত বিষয়ের ওপর অতিরিক্ত জ্ঞান আহরণের জন্য সহায়ক পুস্তকের শরণাপন্ন হতে খুব একটা দেখা যায় না।
উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে দেখা যায় শুধু বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ের পুস্তক প্রকাশনা ও মুদ্রণের দায়িত্ব এনসিটিবি পালন করে থাকে। অপরাপর বিষয়ের পুস্তকের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয়ের পুস্তক এনসিটিবি অনুমোদিত হলেও এসব পুস্তক মুদ্রণের দায়িত্ব লেখক বহন করে থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কোন লেখকের পুস্তক অনুসরণ করবে সেটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক নির্ধারণ করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা দেশী ও বিদেশী উভয় লেখকের পুস্তক অধ্যয়ন করেন। কয়েক বছর থেকে প্রথমত প্রাথমিক পর্যায়ের সব পাঠ্যপুস্তক এবং পরে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব পাঠ্যপুস্তক সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে শহর ও গ্রামের স্কুল এবং নামীদামি স্কুলের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য করা হয় না। ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক অবস্থান নির্বিভেদে সব ছাত্রছাত্রী বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক পেয়ে থাকে। দেশে বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকেরা বিদ্যালয় চলাকালে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন কিন্তু তা বিদ্যালয়ের মান যত ভালোই হোক না কেন, ছাত্রছাত্রীদের গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন ঠেকাতে পারছে না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বেতন ও বার্ষিক ফি দিয়ে থাকে। মাসিক হিসেবে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষকের কাছে ও কোচিং সেন্টারে পড়াতে আট থেকে দশ গুণ অর্থ ব্যয় করে থাকেন। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, যেসব ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক বিদ্যালয়ের বেতন ও ফি এবং বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষকের বেতন ও কোচিং সেন্টারের ফি বাবদ প্রতি মাসে একজন ছাত্রছাত্রীর পেছনে ন্যূনতম দুই হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা ব্যয় করছেন, তাদের জনগণের করের টাকায় বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ কতটুকু বাস্তবসম্মত? বর্তমানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে ছাত্রপ্রতি সরকারের ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে। অভিভাবকেরা ছাত্রদের পেছনে বছরে যা খরচ করেন, তা খুবই নগণ্য।
আমাদের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের মান নিয়ে অনেককেই প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। আবার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এরা এদের পরিচালিত কোচিং সেন্টারে ছাত্রদের যেতে বাধ্য করতে ঠিকমতো শ্রেণিকক্ষে পড়ান না। কিছু কিছু শিক্ষকের ক্ষেত্রে এসব অভিযোগের সত্যতা থাকলেও তা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আমাদের বেশির ভাগ বেসরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের বেতন ও বার্ষিক ফির অর্থের বড় অংশ শিক্ষকদের বেতনভাতার পরিবর্তে ভিন্ন কাজে ব্যয় করা হচ্ছে অথবা স্কুলের তহবিলে জমা থাকছে। সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগ্যতা ও সক্ষমতার ব্যাপারে কোনো ধরনের ঘাটতি থাকলে তা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উত্তরণ সম্ভব। সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে ব্যয়িত অর্থ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকের মান উন্নয়নে এবং শিক্ষকদের বেতনভাতা বাড়ানোর জন্য ব্যয় করা হলে তা শিক্ষার অগ্রগতির জন্য খুবই সহায়ক হবে।
বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও মুদ্রণ শিল্পের উন্নয়ন ঘটেছে। আজ থেকে তিন-চার দশক আগে প্লেটে অক্ষর বিন্যাসের মাধ্যমে হস্তচালিত ছাপাখানায় মুদ্রণের কাজ করা হতো। এ ধরনের মুদ্রণের কাজে প্রচুর সময়ক্ষেপণ হতো। এরপর অফসেট কম্পোজের মাধ্যমে অফসেট প্রেসে মুদ্রণের কাজ করা হতো। অধুনা কম্পিউটার কম্পোজ থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরাসরি ডিজিটাল প্রেসে একসাথে বিভিন্ন রঙের মুদ্রণ কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। এখন যে কোনো ধরনের পুস্তক মুদ্রণে অতীতের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম সময় লাগে এবং মুদ্রণব্যয়ও তুলনামূলক হারে কমেছে।
বিগত এক দশকে আমাদের দেশে মুদ্রণ শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। এখন আমাদের রাজধানী শহরসহ বিভিন্ন জেলা শহরে এমন অসংখ্য ডিজিটাল প্রেস রয়েছে, যেসব প্রেস থেকে স্বল্প সময়ে যেকোনো ধরনের পুস্তক ছাপা সম্ভব।
সরকারের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রমের আওতায় বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ কোটি বই ছাপা হয়। এসব বই ছাপার জন্য আমাদের দেশে অত্যাধুনিক যেসব ছাপাখানা রয়েছে সেগুলোর সক্ষমতা শতভাগ। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে এবং আমাদের দেশের কিছু কর্মকর্তা মুদ্রণের কাজ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিদেশী ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে দেয়ার ব্যাপারে অধিক আগ্রহী। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিগত বছরগুলোতে ভারতীয় যেসব প্রতিষ্ঠানকে পুস্তক ছাপানোর কাজ দেয়া হয়েছে, এর মধ্যে একটি ছাড়া অপর কোনোটির প্রকাশনা বা মুদ্রণ শিল্পের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না। অপরগুলো ট্রেডার্স বা সাপ্লায়ার। এ বিষয়ে আমাদের দেশের মুদ্রণ শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং জনমানুষের জিজ্ঞাস্য যখন এনসিটিবির চার রঙের পাঠ্যবই ছাপার উপযুক্ত চার শতের কাছাকাছি ডিজিটাল প্রেস রয়েছে তখন দেশীয় এসব ছাপাখানাকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে কার স্বার্থে ভারতীয় ছাপাখানাকে মুদ্রণের কাজ দেয়া হচ্ছে?
পুস্তক আমদানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেকোনো ধরনের পুস্তক আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারককে ১২ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। ভারত থেকে যে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে আনা হয় তা আমদানি করা পুস্তক হিসেবে বিবেচিত এবং এ ক্ষেত্রে এনসিটিবি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে আমাদের দেশের যেসব প্রেস মালিক পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর সাথে জড়িত তাদের বক্তব্য আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে কাজ পাওয়া ভারতীয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো ১২ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ না করেই তাদের মুদ্রিত পুস্তকগুলো বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে এবং এগুলোর শুল্ক অযৌক্তিকভাবে এনসিটিবি পরিশোধ করছে। এ শুল্ক ভারতীয় মুদ্রণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে দিতে হলে তাদের পক্ষে কখনোই প্রতিযোগী মূল্যে পাঠ্যপুস্তক ছাপানো সম্ভব নয়। এখন প্রশ্নÑ কার স্বার্থে এবং কী উদ্দেশ্যে এনসিটিবি ভারত থেকে মুদ্রিত পুস্তকের শুল্ক বাবদ ১২ শতাংশ পরিশোধ করছে।
বাংলাদেশের মুদ্রণ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত একাধিক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির কিছু অসাধু কর্মকর্তার সাথে ভারতীয় পুস্তক সরবরাহকারীদের যোগসাজশ রয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে পাওয়া অবৈধ অর্থ পেয়ে এরা আমাদের শতভাগ সক্ষম মুদ্রণ শিল্পকে বঞ্চিত করছেন।
আমাদের মুদ্রণ শিল্পের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ ও অসাধু কর্মকর্তার কারণে ভারতের কিছু নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ চলছে। ভারত থেকে যে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে আনা হচ্ছে এর গুণগত মান আমাদের দেশে যেসব পাঠ্যপুস্তক ছাপা হচ্ছে তার চেয়ে ভালো নয়। তা ছাড়া এমন একাধিক উদাহরণ রয়েছে দরপত্রে সর্বনি¤œ দরদাতা না হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে।
পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশে দেশটির সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিজ দেশকে বঞ্চিত করে যদি অপর কোনো দেশের প্রতিষ্ঠানকে মুদ্রণের কাজ দেয়া হতো তাহলে সে দেশের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অঙ্গনে তোলপাড় হয়ে যেত। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ করা যাচ্ছে, আমাদের শতভাগ সক্ষম মুদ্রণ শিল্পকে বঞ্চিত করে যখন কোনো ধরনের যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া ভারতের বিভিন্ন ট্রেডার্সদের মুদ্রণের কাজ দেয়া হচ্ছে তখন আমাদের মুদ্রণ শিল্পবহির্ভূত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা একেবারে নিশ্চুপ। দেশের যেকোনো নাগরিককে যে কোনো বিষয়ে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর এতেই দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দেশপ্রেমের চেয়ে দেশের প্রতি আর কোনো ধরনের বড় সেবা হতে পারে না। দেশের মুদ্রণ শিল্পের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আজ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির কোন সব কর্মকর্তা দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিছক ব্যক্তিগত লাভের আশায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দায়িত্ব দিয়ে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যয় করছেন এদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলে ভবিষ্যতে হয়তো এ ধরনের অসাধুতার পথে আর কেউ পা বাড়াবে না।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন