|
ফারজানা কবির
|
|
সাঈদীর রায়, গণজাগরণ মঞ্চ এবং আমার কষ্টগুলো
19 Sep, 2014
বিদেশে থাকি অথচ সারাটা ক্ষণ মন পড়ে থাকে দেশে। দেশের একটা সুখবরে টগবগ করে ছুটতে থাকি। আর একটা খারাপ খবর এলে মনে হয়, এসময় দেশে থাকা প্রয়োজন ছিল। ২০১৩ এর ফেব্রুয়ারীতে যখন গণজাগরন শুরু হলো, তখন রীতিমত রাজা আর শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করেছি দেশে যাবার জন্য। তখন আমার পরীক্ষা চলছিল। সব বাদ দিয়ে আমি দিনরাত নেটে বসে থাকতাম। কত রাত যে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি আর মনের ভেতরটা কেমন করেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু রাজা আর আমার শাশুড়ীই যে ঠিক তা কদিন পরে টের পেলাম, যখন দেখলাম গণজাগরন কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে, আর কিছুদিন পরেই শুরু হলো ব্লগারদের গ্রেফতার। দেখলাম, জামাত নিষিদ্ধকরণের বদলে সরকার যখন জামাতের সঙ্গে আতাত করে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে। শুধু তাই নয়, এমনভাবে সব কিছু সুকৌশলে পরিবর্তন করছে যাতে আগামী ৫০ বছরও তাদেরকে গদি থেকে নড়ানো না যায়।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত আইনুযায়ী মৃত্যুদন্ড আছে। তাই না চাইলেও আমাদেরকে এই আইনকে মেনে নিতে হবে। আর একজন রাজাকার যে দেশের সঙ্গে দেশদ্রোহীতা করেছে, এমনকি আমার দেশের মানুষ হত্যা থেকে শুরু করে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করেছে; সঙ্গে দলবল নিয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়ে গেছে সেই বেঈমানকে আমৃত্যু কারাদন্ড দেয়া সত্যিই হাস্যকর। কেন হাস্যকর তার একটু ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। প্রথমত রাজাকার প্রধান গোলাম আযমকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় না কারন দর্শাণো হয়, তার বয়স। মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর একজন যুদ্ধাপরাধীর বয়স ৯০ এর ওপর হবে এটাই তো স্বাভাবিক। বয়সের কারনে শাস্তি যদি কমাবেন, তাহলে আরো আগে কেন এই শাস্তি প্রক্রিয়া শুরু করেননি? ৫ বছর খেলায় খেলায় কাটিয়ে দিলেন, যুদ্ধাপরাধূীদের বিচার করবেন বলে। আমরা আদালতের রায়কে মেনে নিলাম, বললাম, আদালতের আদেশ শিরোধার্য।
আদালতের আদেশ শিরোধার্য একবার মেনে নেয়াতে, নতুন যে নাটকটি আমাদের সামনে আনা হলো, সেটি হলো সাঈদীর মৃত্যুদন্ড বহাল না রেখে তাকেও আপিল বিভাগে আমৃত্যু জেলে থাকার রায় প্রদান করা হলো। অথচ কিছুদিন আগেও সাঈদীকে চাঁদে দেখে তার ভক্তরা। পুরো দেশে তান্ডব ঘটায় জামাত সমর্থনকারীরা। শুধু তাই নয়, সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আসা একজন রাজসাক্ষী খুন হয়। সাঈদীর বিরুদ্ধে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের কারো সাক্ষীই গ্রহণ করেনি রাষ্ট্রপক্ষ। কেন? অথচ তারা এখন বলছেন, তদন্তে তথ্যপ্রাপ্তির ঘাটতির কথা। আগে যখন ফাসির রায় হয়েছিল, তখন কি তদন্তে তথ্যপ্রাপ্তির ঘাটতি ছিলনা? নতুন করে তদন্তে তথ্যপ্রাপ্তির ঘাটতি হলো কোথা থেকে? আর যারা অন্ধ না তারা সবাই বোঝে এবং জানে, সঙ্গে ইতিহাসও সাক্ষী দেয় আমাদের দেশের আমৃত্যু কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে জেল থেকে। বর্তমান সরকার রাজাকারদের বিচারের আশা দেখিয়ে নিজেদের আসন পাকাপোক্ত করছে। কারন, দেশের মানুষ চায় রাজাকারদের শাস্তি হোক। আর এই দূর্বলতাকেই শক্তি হিসেবে নিয়ে বর্তমান সরকার জামাতের সঙ্গে আতাত করেছে। এতে তাদের আসন যেমন পাকাপোক্ত হয় সঙ্গে বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল ধ্বংস হয়ে যায়। মোদ্য কথা গণতন্ত্রের নামে তারা একনায়কতন্ত্রই চালিয়ে যাচ্ছেন, সারাজীবনের জন্য সিংহাসন পাকা করে।
ফেসবুক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী:
১. রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ (আপীল বিভাগ) রুলস ১৯৮৮ এর অর্ডার ২৬ অনুযায়ী রিভিউ করতে পারে। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপক্ষকে সেই অধিকার নিশ্চিত করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সংবিধানের ৪৭ক(২) প্রযোজ্য হলেও রাষ্ট্রপক্ষের জন্য তা প্রযোজ্য হবে না। সুতরাং সাঈদীর আপিল মামলার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ করতে কোনো বাধা নেই।
২. সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ (আপীল বিভাগ) রুলস ১৯৮৮ অনুযায়ী রিভিউ করতে হবে রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে। এটি কি সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা নাকি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ বুঝাবে তা নির্ধারণে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে সক্রিয় হতে হবে। তবে রীতি হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউর জন্য আবেদন করা যায়।
৩. সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ (আপীল বিভাগ) রুলস ১৯৮৮ এর অর্ডার ২৬, রুল ৩ অনুযায়ী নতুন প্রমাণ উদঘাটনের প্রেক্ষিতে রিভিউ করার সুযোগ রয়েছে। (... when the application proceeds on the ground of a discovery of fresh evidence....)
- courtesy--Akramul Hoque Samim
এর পরেও প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ''সাঈদীর রায় কাঙ্ক্ষিত ছিল না, এই রায় কাঙ্ক্ষিত না হলেও আদালতের আদেশ শিরোধার্য'', তখন আমাদের বুঝতে হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আসলে কিছু্ই না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সামনে রেখে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত রাখা আর নিজেদের আজীবন ক্ষমতাসীন রাখাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।
শুরু করেছিলাম বিদেশে থাকি অথচ সারাক্ষণ মন পড়ে থাকে দেশে নিয়ে। এখন শেষ করছি, এখন থেকে চেষ্টা করবো, যাকে ছেড়ে এসেছি তার জন্য নীরবে যদি কিছু করা যায় করবো, কিন্তু আমি আর আমার মাতৃভূমিকে নিয়ে মাথা ঘামাবো না। এভাবে কষ্ট পেতে, আশাহত হতে আর ভাল লাগে না। আমার প্রজন্মতো মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তবু তারা ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের দাম দেয়, লক্ষ লক্ষ ধর্ষিত মা বোনের কষ্টকে নিজের কষ্ট হিসেবে গণ্য করে। তাহলে জাতির জনকের কন্যা কেন সেই কষ্ট বোঝেনা? সুতরাং, ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতাসীন থাকাই তার রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য তা আর না বললেও চলে। তাই কাউকে কিছু না বলে, আমার মতো মানুষ যারা দেশকে ভালবাসে, দূরে থেকে দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা করে,তারা দেশের সঙ্গে সব সম্পর্কের ইতি টানে। এরচেয়ে বরং নিজের ক্যারিয়ারে মনযোগ দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু দুঃখ লাগে, রাজীব হায়দার, শান্ত, দ্বীপদের জন্য যারা মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পরে এসেও দেশের হক আদায় করতে ২০১৩ সালে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেয়। কষ্ট লাগে বিদেশে ভাল ক্যারিয়ার থাকা সত্ত্বেও রাসেল পারভেজরা দেশের জন্য কিছু করতে দেশে ফিরে যায় আর সরকার জামাতকে খুশী করতে তাদের মতো দেশপ্রেমিকদের ব্লাসফেমি আইনে গ্রেফতার করে আর আবারো বিদেশে ফিরতে বাধ্য করে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন