স্কটল্যান্ডকে উত্তরোত্তর অধিক রাজনৈতিক ক্ষমতা (ডিভল্যুশন) হস্তান্তরের ব্যাপারে ব্রিটেনের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের- কনজারভেটিভ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও লেবার পার্টি- কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল, 'স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি' (এসএনপি) এবং তার জনসংখ্যার প্রায় আধাআধি মানুষ চায় পূর্ণ স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীন হতে গেলে অবিচ্ছিন্ন ব্রিটিশ ভূখণ্ডে স্কটল্যান্ড যে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবে, তা রাজনৈতিক দিক থেকে কাটিয়ে উঠতে পারলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে কোনোমতেই সম্ভব হবে না বলে জোর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীনতার প্রশ্নে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ডের নির্ধারিত গণভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষের বিভিন্ন প্রশ্ন তাই ক্রমেই ধারালো হয়ে উঠছে। উত্তর আয়ারল্যান্ড ছাড়া ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও স্কটল্যান্ডের অবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড নিয়েই একদিন গঠিত হয়েছিল গ্রেট ব্রিটেন। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড নামক দুটি সার্বভৌম রাজ্যের পার্লামেন্টে যথাক্রমে ১৭০৬ ও ১৭০৭ সালে দুটি পৃথক 'ট্রিটি অব ইউনিয়ন' চুক্তি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে গ্রেট ব্রিটেন নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বৈবাহিক সূত্রে এ দুটি রাজ্যের রাজপরিবার যেমন মিলেমিশে একটি ব্রিটিশ সত্তায় আবির্ভূত হয়েছে, তেমনি এখানকার জনগোষ্ঠীও দিন দিন একীভূত হয়েছে একটি বৃহত্তর পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধগত ভিত্তির ওপর। ৩০০ বছর ধরে এ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মোটামুটি অব্যাহতভাবেই চলে এসেছিল। কিন্তু পৃথক সংসদ ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থাসহ অনেক রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করা সত্ত্বেও স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক ও তাঁদের সমর্থকরা এখন ব্রিটেন থেকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন হয়ে যেতে চাচ্ছে।
ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩০ হাজার ৪১৪ বর্গমাইলজুড়ে রয়েছে স্কটল্যান্ড। তার দক্ষিণ প্রান্তে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস এবং বাকি তিন দিকে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর (উত্তর ও পশ্চিম) ও নর্থ সি (পূর্ব)। যুক্তরাজ্যের ছয় কোটি জনসংখ্যার মধ্যে স্কটল্যান্ডের রয়েছে প্রায় পৌনে এক কোটি। স্কটল্যান্ডের সম্পদের মধ্যে রয়েছে নর্থ সির কিছু তেল ও গ্যাস, যা বড়জোর ২০৩০ সাল পর্যন্ত বর্তমান হারে চাহিদা মেটাতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর রয়েছে জাহাজ নির্মাণ ও পর্যটনশিল্প এবং সামান্য কিছু উৎপাদনমুখী কলকারখানা। তাতে স্কটল্যান্ডের যা আয়, তা দিয়ে বর্তমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আবাসিক বিনির্মাণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় খরচ চালানো সম্ভব হবে না বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মন্তব্য করে চলেছে। স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বেরিয়ে গেলে তার অনেক নাগরিককে কর্মসংস্থান হারাতে হতে পারে। আর পাশাপাশি তারা ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্থ আয়ারল্যান্ডের বিরাট বাজারও হারাতে পারে। তাতে শেষ পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের অনেক কারখানা, যার বেশির ভাগই ইংলিশ মালিকানাধীন, বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া বিশেষ করে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের মুদ্রার বিনিময় হার পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের তুলনায় অনেক কম হবে। বিষয়টি কোনোভাবেই কেউ অগ্রাহ্য করতে পারছে না। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের অন্যান্য অংশের মতো স্কটল্যান্ডেরও সম্মিলিতভাবে রয়েছে অনেক জাতীয় ঋণ। উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা সে ঋণের হিস্যা তাকে শোধ করতে হবে। নর্থ সির সামান্য তেল ও গ্যাসের ওপর ভরসা করে স্কটল্যান্ডের ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদী এসএনপিদলীয় বর্তমান প্রথম মন্ত্রী (ফার্স্ট মিনিস্টার) আলেক্স স্যামন্ড স্বাধীনতার যে স্বপ্ন দেখছেন, তা শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে পানামার মতো অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। স্কটল্যান্ড বর্তমান 'ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড নর্থ আয়ারল্যান্ড' থেকে সরে গেলে আন্তর্জাতিকভাবে এ দেশটি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বিশ্ববাজারে এবং বিশ্ব সভায় (জাতিসংঘ), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও ন্যাটোর মতো প্রতিষ্ঠানে যুক্তরাজ্যের অবস্থান আবার নতুনভাবে নির্ণয় করতে হবে। তাতে আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা ও সামরিক শক্তি এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির নতুন করে ভারসাম্য নির্ণয় করতে হতে পারে। এ বিষয়গুলো খুব সহজ হবে বলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন মনে করেন না।
'ট্রিটি অব ইউনিয়ন' আইন পাস করে ১৭০৬-১৭০৭ সালে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড 'গ্রেট ব্রিটেন' নামে এক রাষ্ট্রে পরিণত হলেও স্কটল্যান্ডে যে এর পরও স্বাধীনতার যুদ্ধ, আন্দোলন কিংবা দাঙ্গা বাধেনি তা নয়। স্কটল্যান্ড যত ছোট এবং তার জনসংখ্যা যত নগণ্যই হোক, গেইলিক ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবাধীন এক শ্রেণির শাসক ও জনগোষ্ঠী সময় ও সুযোগমতো অতীতে বহুবার কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং যুদ্ধ করেছে। এন্ড্রু মারে ও উইলিয়াম ওয়ালেস ১২৯৬ থেকে ১৩২৮ পর্যন্ত ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। ১৩০৬ সালে বিখ্যাত রবার্ট ব্রুস তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জন কমিনকে পরাজিত করে প্রথম রবার্ট নামে নিজেকে স্কটল্যান্ডের রাজা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন ২০ বছর তাঁর রাজত্ব স্থায়ী হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ক্রমেই সেখানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে। রবার্ট ব্রুসের স্বাধীনতা স্থায়ী হয়নি বেশি দিন। তারপর ১৫০২ সালে স্কটল্যান্ডের চতুর্থ জেমস ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম হেনরির সঙ্গে একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং হেনরির মেয়ে মার্গারেটকে বিয়ে করেছিলেন। তখন থেকে আবার এই দুই নিকট-প্রতিবেশী রাজত্বকে একীভূত করার প্রচেষ্টা চালু করা হয়। কিন্তু একপর্যায়ে অর্থাৎ চুক্তি স্বাক্ষরের ১০ বছর পর জেমস ফরাসিদের সমর্থনে ইংল্যান্ড আক্রমণ করার মতো ভুল করে বসেন। রোমের শাসনের পর এবং মধ্য যুগের শুরু থেকে স্কটল্যান্ড একটি ক্ষুদ্র অথচ আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পৃথক ছিল। তবে ১৫৬০ সালের দিকে স্কটল্যান্ডের রানি মেরি ইংল্যান্ডের সঙ্গে তাঁর রাজ্যকে একীভূত করার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়সহ বিভিন্ন কারণে তখন তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মেরির পর তাঁর ছেলে ষষ্ঠ জেমস ১৫৬৬ সালে স্কটল্যান্ডের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের মৃত্যুর পর একযোগে ইংল্যান্ডের শাসনভারও লাভ করেন। রানি প্রথম এলিজাবেথ ছিলেন অবিবাহিত এবং সে কারণে নিঃসন্তান। ষষ্ঠ জেমস ছিলেন তাঁর দত্তক পুত্র এবং সে কারণে ইংল্যান্ডের সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারী। তাই ১৫৬৭ সালে তিনি প্রথম জেমস হিসেবে ইংল্যান্ডের শাসনভার গ্রহণ করে স্কটল্যান্ড ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৬০৩ সালে জেমস তাঁর প্রয়াত রানি মাতা মেরির মতো আবার স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ড রাজ্য দুটিকে একীভূত করার বাসনা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর রাজকীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে দুটি রাজ্য নিয়ে গ্রেট ব্রিটেন নামে একটি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, যাকে পরে যথাক্রমে ১৭০৬ ও ১৭০৭ সালে লন্ডন ও এডিনবরার পার্লামেন্টে দুটি পৃথক আইন পাস করে গণতান্ত্রিকভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আবার অর্থাৎ ১৮০১ সালের ১ জানুয়ারিতে একই পদ্ধতিতে আয়ারল্যান্ডকে সংযুক্ত করে আরেকটি আইনের মাধ্যমে 'ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড' গঠন করা হয়েছিল।
স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতায় কি স্কটিশদের কোনো লাভ হবে?
সার্বভৌম অথচ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে জনগণের ওপর শোষণ, বঞ্চনা ও তাদের দুঃখ-দুর্দশা না বাড়িয়ে একই অবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্যে সেদিন যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, আজও তা এ অঞ্চলের চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। সে কারণেই হয়তো অষ্টাদশ শতাব্দীতে 'স্কটিশ এনলাইটেনমেন্ট'-এর ফলে বাণিজ্য, শিল্পায়ন ও বুদ্ধিবৃত্তির অবদানের ক্ষেত্রে স্কটল্যান্ড একটি শক্তিশালী অঞ্চলে পরিণত হতে পেরেছিল। তখনই গ্লাসগো আবির্ভূত হতে পেরেছিল ইউরোপের একটি 'পাওয়ার হাউস' হিসেবে। এরই ধারাবাহিকতায় শ্রমজীবী মানুষের নেতা কিয়ার হার্ডির (স্কটিশ) নেতৃত্বে ১৮৯৫ সালে গঠিত হতে পেরেছিল সমগ্র ব্রিটেনভিত্তিক 'ইনডিপেনডেন্ট লেবার পার্টি'। এর আগে স্কটিশ রাজনীতিক উইলিয়াম ই গ্ল্যাডস্টোন সমগ্র যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্কটল্যান্ডের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাঁরা যেমন কাজ করেছেন, তেমনি যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ঠিক রেখে প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন 'স্কটিশ রিফর্ম অ্যাক্ট ১৮৩২'-কে বাস্তবায়ানের লক্ষ্যে সহযোগিতার হাত বাড়ান, যা পরে স্কটল্যান্ডে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার পথকে প্রশস্ত করেছে। কিন্তু তাঁরা কেউ স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতার পথ দেখাননি। তাঁরা বলেছিলেন, সঠিক পরিকল্পনা ও জনগণের বৃহত্তর ঐক্যের মধ্যেই এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূলমন্ত্র নিহিত রয়েছে। ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনের সংকীর্ণ স্বার্থে যারা জনগণকে বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলে দেবে তারা আসলে সার্বিকভাবে এ অঞ্চলের বৃহত্তর সমৃদ্ধি ও অগ্রগতিকেই বাধাগ্রস্ত করবে। যুক্তরাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণেই ইউরোপের অন্যান্য ক্ষুদ্র দেশের তুলনায় স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন নগর উন্নয়ন, অবকাঠামোগত বিনির্মাণ এবং শিল্প-কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে বেশি। অনেকের মতে, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য এ মুহূর্তে স্কটল্যান্ডের প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ। ১৯৯৯ সালে স্কটিশ পার্লামেন্ট আবার চালু হওয়ার পর ইতিমধ্যে সেসব ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ব্যবসায়ীরা স্কটল্যান্ডে বেশ কিছু শিল্প-কারখানা এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করেছেন।
স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যে থাকলে কী হবে আর স্বাধীন হয়ে গেলেই বা কী হবে, তা নিয়ে গত প্রায় এক মাসে স্কটল্যান্ডের প্রথম মন্ত্রী আলেক্স স্যামন্ড এবং লেবারদলীয় সাবেক অর্থমন্ত্রী আলেস্ট্রার ডার্সিংয়ের মধ্যে দুটি জমজমাট টেলিভিশন বিতর্ক হয়ে গেছে। তাতে ডার্সিং স্কটল্যান্ডের একজন বাসিন্দা হয়েও স্পষ্টভাবে স্যামন্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে স্কটিশ জাতীয়তাবাদী পার্টির (এসএনপি) নেতা হিসেবে তিনি (স্যামন্ড) স্বাধীনতার দাবি ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। স্বাধীন হলে স্কটল্যান্ডের মুদ্রাব্যবস্থা ও সার্বিক অর্থনৈতিক দিক থেকে সুদৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর রূপরেখা কী হবে, স্যামন্ড তার পরিষ্কার জবাব দিতে পারেননি। লেবারদলীয় সাবেক স্কটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন থেকে শুরু করে কনজারভেটিভ ও লিবারেল ডেমোক্রেটিকদলীয় প্রায় সব রাজনীতিকই স্কটল্যান্ডের প্রস্তাবিত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। ব্যবসায়ী থেকে বুদ্ধিজীবী মহল এবং প্রতিষ্ঠিত আমলাসমাজ থেকে আধুনিক তরুণ ছাত্রসমাজ- কেউই এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ স্বাধীনতা সমর্থন করতে পারছে না। স্কটল্যান্ডের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজ ইংলিশসহ বৃহত্তর ব্রিটিশ সমাজে মিলেমিশে এখন প্রায় একাকার হয়ে গেছে। বদলে গেছে তাদের জীবনাচরণ এবং এমনকি বাচনভঙ্গিও। স্কটল্যান্ডের কেন্দ্রীয় নগরী এডিনবরা থেকে বাণিজ্য নগরী গ্লাসগো ও জ্বালানি সম্পদ নগরী এবারডিন এবং এমনকি ডান্ডি, পার্থ ও ইনভারনেস নগরীর বেশির ভাগ মানুষই এ স্বাধীনতার প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করেছে। ছোট ছোট শহর কিংবা গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ যারা এখনো অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে, তারাই স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতীয়তাবাদী স্কটিশ রাজনীতিকদের সঙ্গে তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের কাছে যুক্তরাজ্য কিংবা ব্রিটেন মানে ইংল্যান্ড। সেখানে স্কটল্যান্ডের কোনো গুরুত্ব নেই বলে তাদের অভিযোগ। কেন্দ্রীয় রাজধানী লন্ডন ও ইংল্যান্ডের কাছে স্কটল্যান্ড একটি বাজার ছাড়া আর কিছুই নয় বলে এখনো অনেকে মনে করে। স্কটিশ প্রথম মন্ত্রী আলেক্স স্যামন্ড মনে করেন, যে পরিমাণই হোক, তাদের তেল ও গ্যাসসম্পদ রয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে তারা স্কটল্যান্ডের প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে। কিন্তু স্কটল্যান্ড স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী পরিমাণ মানুষ তাদের বর্তমান সরকারি চাকরি (কেন্দ্রীয়) বা কর্মসংস্থান হারাবে, তা তিনি বলছেন না। ফলে গণমাধ্যমের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, এখনো স্কটল্যান্ডের ৫৫ শতাংশ মানুষ প্রস্তাবিত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তাই বারবারই বলেছেন, বৃহত্তর যুক্তরাজ্যকে বাদ দিয়ে যাঁরা স্কটল্যান্ডের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলেন, তাঁরা আসলে ভুল করছেন। স্কটল্যান্ড বর্তমানেই ইংল্যান্ডে যে পরিমাণ বাণিজ্য করে, সারা বিশ্বেও তার সমপরিমাণ হয় না। তিনি বলেছেন, উন্নয়ন, উৎপাদন ও সমৃদ্ধির জন্য এবং বিশেষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য স্কটল্যান্ডের এখন ঐক্যবদ্ধভাবে বিনিয়োগের সময়, বিচ্ছিন্নতার নয়।
স্কটল্যান্ডের আসন্ন গণভোটকে সামনে রেখে পরিস্থিতি বোঝার জন্য অন্য কোথাও ছুটি কাটাতে না গিয়ে পুত্র-কন্যা নিয়ে সপরিবারে তাই পাঁচ দিনের জন্য স্কটিশ হাইল্যান্ড-আইল্যান্ডের কেন্দ্র ইনভারনেস নগরীতে চলে গিয়েছিলাম। চারদিকে সুউচ্চ পর্বতমালায় ঘেরা, তলদেশে অসংখ্য ছোট-বড় জলাধার (প্রাকৃতিক লেক) এবং কোথাও কোথাও দৃশ্যমান খরস্রোতা রুপালি জলপ্রপাত। কোনো কোনো সুবিশাল লেকের কোনো শেষ প্রান্ত দেখা যায় না। পবর্তমালা ও লেকের মাঝে মাঝে নির্মাণ করা হয়েছে তিন-চার বেডরুমের ছোট ছোট দোতলা কটেজ। মৌসুমি ফুলের বাগানে ঘেরা সেসব কটেজ ভাড়া নিয়ে ভ্রমণকারীরা ছুটি কাটায়। এ অঞ্চলের যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে চোখ মেলে তাকালে মনে হয়, 'পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থেকে থাকে, তবে তা এখানেই।' গ্রীষ্ম মৌসুমে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড থেকে প্রচুর ভ্রমণকারী আসে এখানে। আসে পার্শ্ববর্তী সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি থেকেও। ইনভারনেসের 'লকনেস' (২৩ মাইল দীর্ঘ সুপ্রশস্ত প্রাকৃতিক লেক), ফার্থ অফলর্জ, বিউলির বিশাল জলাধারগুলো এবং বিশেষ করে আইল অফ স্কাইয়ের আকাশছোঁয়া পর্বতমালা ও তার পাশেই দুই দিকে আটলান্টিক এবং একদিকে নর্থ সি- এ এক ভিন্ন জগৎ। আইল অফ স্কাইয়ের কোনো একটি পর্বতে দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে সীমাহীন জলরাশির দিকে তাকালে মনে হয়, এখানেই পৃথিবীর জনপদ শেষ, তারপর আর কিছু নেই। রাতে জমে ওঠে রেস্তোরাঁগুলো। এখানে বাংলাদেশি, চায়নিজ, ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চসহ পৃথিবীর সব দেশের জনপ্রিয় খাবার পাওয়া যায়। তবে সেখানে এ মুহূর্তে আলোচনার বিষয়বস্তু একটিই, স্কটল্যান্ডের কী হবে? লন্ডনে ফেরার পথে ইনভারনেস এয়ারপোর্টে ভাড়া করা গাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে বিদায় জানাতেই ম্যানেজার বললেন, 'আবার আসবেন।' কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোথায়? যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডে, না স্বাধীন স্কটল্যান্ডে, সেটি বললেন না। শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা কেউ জানে না। তবে প্লেনে বসে প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের একটি উক্তিই বারবার ঘুরেফিরে মনে পড়তে লাগল, 'এটি আমাদের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার সময়, বিচ্ছিন্নতার নয়।'
স্কটল্যান্ড থেকে
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস)
সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন