|
এম হুমায়ুন কবির
|
|
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর বিগ-বি বড় ভূমিকা রাখবে
08 Sep, 2014
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ সফরটি নানা কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এই সফরকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গত মে মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর করেছিলেন। এর প্রায় তিন মাস পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বাংলাদেশ সফরে এলেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে মনে হয় যে এত দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশে এসেছেন। আরেকটি কারণে সফরটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, দীর্ঘ ১৪ বছর পর জাপানের কোনো প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশে এলেন। এটা থেকে বোঝা যায়, তারাও বাংলাদেশ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফরের কারণে এটা পরিষ্কার যে তারা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে, নানাভাবে এই দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে মনোযোগ দিচ্ছে।
জাপানের দিক থেকে বাংলাদেশ সফর গুরুত্বের একটা মূল কারণ জাপানের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানে বাংলাদেশের অবদান। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে তাঁর বক্তৃতায় সে কথা স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেছেন, জাপানের নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্যও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত জাপানের মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর সে কারণেই তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। বাংলাদেশ জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে আরো কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে প্রধান একটি কারণ, আমরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ছয়টি মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। এই মেগা প্রজেক্টের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সক্ষমতা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান বিশেষত আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যে চ্যালেঞ্জ, সেখানে কিছুটা হলেও অগ্রগতি ঘটবে। জাপান বড় পুঁজির দেশ। আমরা আমাদের এসব মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে তাদের সহযোগিতা চাই। তাদের টেকনোলজি, অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে সহযোগিতা ইত্যাদি আমাদের জন্য একান্তভাবে প্রয়োজন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের আগ্রহের আরেকটা বড় কারণ ২০১৬-১৭ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এশিয়া গ্রুপে অস্থায়ী সদস্য পদ লাভে জাপান ও বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বী। সে জন্য জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করেন, সহযোগিতা চান। দেখা গেল, বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদের নির্বাচনে জাপানের সমর্থনে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যেটাকে অনেকে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করছেন। এই প্রেক্ষাপটে একটি কথা বলা প্রয়োজন, ১৯৭৯-৮০ সালে বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদ লাভের সময় জাপান বাংলাদেশের কাছে হেরে যায়। তাই বাংলাদেশ এবার আগেই সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে যেন জাপানের আর কোনো বাধা না থাকে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর মতো আমরাও মনে করি, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আর যেন কোনো বিভাজন না থাকে। এটা জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফরের তাৎক্ষণিক একটা বড় কারণ বলা যেতে পারে।
বিগ-বি বড় ভূমিকা রাখবে
জাপান-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জাপান সরকারের প্রস্তাবিত বিগ-বি, বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বড় ভূমিকা রাখবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারত, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল- এসব দেশকে নিয়ে জাপানের এই পরিকল্পনা প্রণীত। এর আগেই নানা সময়ে জাপান সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে কথা বলেছে। যেমন, এই উদ্যোগের আওতায় এরই মধ্যে অনুমোদিত হয়েছে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই সহযোগিতা মূলত তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে। এক. শিল্প ও বাণিজ্য, দুই. জ্বালানি এবং তিন. পরিবহন। জাপান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আঞ্চলিক সহযোগিতায় এই ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা করবে, যেন দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে সহযোগী মনোভাব আরো উন্নত হয়।
বিগ-বি ধারণাটি মূলত বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই বন্দর বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে এশিয়ার অন্যান্য অংশের বাণিজ্যিক সদর দরজা হিসেবে কাজ করবে বাংলাদেশ। জ্বালানি প্রকল্প, যা মূলত মাতারবাড়ী প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতে বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যে আকস্মিক গতি সঞ্চার করবে। আর পরিবহনব্যবস্থার ক্ষেত্রে দেশের বৃহত্তর শিল্প, বাণিজ্য ও জ্বালানি উৎপাদনের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পরিবহনব্যবস্থা আরো শক্তিশালী হবে। এটা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগব্যবস্থা সম্প্রসারণ করবে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী বিগ-বি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। বিগ-বি ধারণাটি বাংলাদেশে নতুন হলেও থাইল্যান্ড ও জাপানে এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ হয়েছে। বাংলাদেশে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় শিল্পায়নকে সামনে রেখে এই বিগ-বি উদ্যোগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। জাপানের সহযোগিতা সব সময়ই আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এবার তাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরে দুই দেশের উন্নয়নের, সহযোগিতার আরো নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আর দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে জাপান যে সহযোগিতা-সহমর্মিতার ক্ষেত্র গড়ে তুলতে চাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ নিজেদের ক্ষেত্রকে লাভবান করে নিতে পারবে, নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো ব্যবহারে সাফল্যের পরিচয় দেবে- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন