শনিবার দুপুরে জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বিরাট একদল নিয়ে ঘণ্টা ২০-এর এক সফরে বাংলাদেশে আসছেন। রোববার সকালে তিনি যাবেন শ্রীলংকায় এবং ওখান থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাপানে তার পাঁচ দিনের সফর শেষে নতুন দিল্লিতে ফিরলেন ৩ সেপ্টেম্বর। তাকে বিদায় দিয়েই শিনজো আবে দক্ষিণ এশিয়ার আর দুটি দেশ সফরে বের হলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়াকে জাপান যথার্থই গুরুত্ব দিচ্ছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কের গভীরতা যে দিন দিন বাড়ছে, তার আর একটি উদাহরণ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাত্র কয়েক মাস আগেই গত মেতে জাপান সফর করে এলেন; আর এখন আসছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম আমলেও, সেই ২০০০ সালে, জাপানের আর এক প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিরো মোরি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। শুনেছি তবে নিশ্চিত নই, প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলের শেষদিকে ১৯৮৯ এবং ১৯৯০-তেও দুই জাপানি প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সেই হিসেবে সিনজো আবে চতুর্থ জাপানি প্রধানমন্ত্রী যিনি বাংলাদেশ সফরে আসছেন। ১৪ বছর পর বাংলাদেশে জাপানের আরেক প্রধানমন্ত্রীর এ সফর।
বাংলাদেশ থেকে প্রত্যেক সরকারপ্রধানই জাপান সফর করেছেন, কেউ কেউ একাধিকবার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন প্রথম সরকারপ্রধান ছিলেন এবং এই সিরিজে তার কন্যা শেখ হাসিনা সর্বসাম্প্রতিক। প্রেসিডেন্ট এরশাদের এমন এক সফরকালে আমিও তার একজন সফরসঙ্গী ছিলাম। আমি তখন ১৯৮৫-এর জুনে, সৌদি আরবের জেদ্দা দূতাবাস থেকে সদ্য ফেরত, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও যুক্তরাজ্য উইংয়ের মহাপরিচালক। জাপানে তখন প্রধানমন্ত্রী নাকাসোনে। সম্রাট হিরোহিতো এবং যুবরাজ আকিহিতোর সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্যও হয়েছিল তখন, প্রেসিডেন্ট এরশাদের জন্য জাপানি সম্রাটের ভোজসভা শেষে। ৬০-এর দশকের প্রথমদিকে তখন সদ্য বিবাহিত এই যুবরাজ পূর্ব পাকিস্তানও সফর করেছিলেন। তার স্ত্রীসহ একটি বিগ জুট মিলসও সফর করেছিলেন, আমার সঙ্গে স্মৃতিরোমন্থন করেছিলেন যুবরাজ। বুঝলাম, তিনি আদমজী জুট মিলসের কথা বলছেন। সেই যুবরাজ তার বাবার মৃত্যুর পর এখন জাপানের সম্রাট। তিনি ব্রিটিশ রাজা-রানীদের মতো শুধু হিজ ম্যাজেস্ট্রি নন, তিনি হচ্ছেন হিজ ইম্পোরিয়েল ম্যাজেস্ট্রি। তাদের প্রথম সন্তান নারুহিতো, যিনি এখন যুবরাজ, তার স্ত্রী মাসাকো জাপানি ফরেন সার্ভিসে একজন জুনিয়র কূটনীতিবিদ ছিলেন যখন ১৯৯৪-তে তাদের প্রেম পরিণয়ে গড়ায়।
জাপান স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২-এর ১০ ফেব্র“য়ারি; ভারত ৬ ডিসেম্বর এক নম্বরে এবং ভুটান ৭ ডিসেম্বর দুই নম্বরে এই হিসাবে জাপান ছিল ৩২ নম্বরে, সৌদি আরব বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরদিন ১৬ আগস্ট তালিকায় ১২২ এবং বিএনপি-জামায়াতিদের পরীক্ষিত বন্ধু চীন তালিকায় সর্বশেষ দেশ- ১২৩ নম্বরে, স্বীকৃতি দান ওই বছরের ৩১ আগস্ট।
জাপানের দিক থেকে বাংলাদেশে প্রথম সফর হয়েছিল তাকাশি হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে একটি জাপানি পার্লামেন্টারি দলের, বঙ্গবন্ধু আমলে। এই হায়াকাওয়া সাহেব বাংলাদেশের এবং বঙ্গবন্ধুর এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন যে, জাপানের কতগুলো জায়গায় তাকে মিস্টার বাংলাদেশ হিসেবেই জানত।
জাপান গত ৪০ বছরে বাংলাদেশকে ১১ বিলিয়ন ডলারের মতো সাহায্য দিয়েছে। বাংলাদেশে জাপানের পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ ২৮৬ মিলিয়ন ডলার মাত্র। এই গত ১৩-১৪ আর্থিক বছরে জাপানে আমরা রফতানি করেছি মাত্র ৮৬২ মিলিয়ন ডলার, আর জাপান বাংলাদেশে রফতানি করেছে ১.২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। জাপান ২০১৩ সালে দুনিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করেছে ৮৩৩ বিলিয়ন ডলারের জিনিসপত্র।
দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হচ্ছে জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পর। প্রতি বছর জাপানের শত শত বিলিয়ন ডলারের আমদানি এবং বিদেশে বিনিয়োগের বিপরীতে বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগ এবং বাংলাদেশ থেকে জাপানের আমদানি খুবই নগণ্য। আমাদের দুই দেশের সঙ্গে যে সুসম্পর্ক এখন বিরাজ করছে, তার ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যে বিশাল ব্যবসায়ী-শিল্পপতি এবং প্রায় ৭০ জনের মিডিয়া গ্র“প নিয়ে এই সফরে বেরিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের প্রতি তার এবং তার সরকারের আগ্রহই প্রতিফলিত হয়েছে। তার ওপর সবচেয়ে বড় ট্রেডিং পার্টনার এবং পুঁজি বিনিয়োগের দেশ, চীনের সঙ্গে চীন সাগরের সেনকাকু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দুই দেশের টানাপোড়েনও চলছে। সম্প্রতি চীনের কতগুলো জায়গায় জাপানবিরোধী হাঙ্গামাও হয়েছে। তারপর চীনে শ্রমিকদের মজুরিও বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং জাপান এখন নতুন ডেস্টিনেশন খুঁজছে। ভিয়েতনাম, লাওস, বার্মা, শ্রীলংকা- এসব দেশের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সদ্যসমাপ্ত জাপান সফরকালে জাপানি বিনিয়োগকারীদের বলে এসেছেন, ভারতে গেলে তাদের লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হবে। কিন্তু আমাদের দেশে যোগাযোগের যে দুরবস্থা, বিদ্যুৎ, গ্যাসের যে সংকট, চট্টগ্রাম বন্দরের যে জটিলতা- আশপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের সক্ষমতা কোথায়?
মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেও ২০১২ সালে গুজরাটে নরেন্দ্র মোদি জাপানি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। সাম্প্রতিক সফরে ৫ বছরে ভারতকে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য দেবে জাপান, এমন প্রতিশ্র“তি আদায় করতে সফলও হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
দুই.
প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে সম্পর্কে এখন কিছু ইন্টারেস্টিং প্রাসঙ্গিক তথ্য। তার বাবা সিনতারো আবেও একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সিনতারো আবে জাপানি পার্লামেন্ট, ডায়েটের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬- এই চার বছর। শিনজো আবের নানা, মানে মার বাবা, নবুশিকি কিসি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৫৭-৫৮ সালে।
শিনজো আবে আগেও একবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ২০০৬-তে মাত্র এক বছরের জন্য। তার মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য কতগুলো দুর্নীতি এবং কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়লে তিনি পদত্যাগ করেন, একজন প্রকৃত গণতন্ত্রপ্রেমী এবং ভদ্রলোক রাজনীতিবিদ হিসেবে। তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন ২০১২-তে। জাপানের গত ৬০ বছরের ইতিহাসে তিনি একমাত্র এমন দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবার ফিরে আসেন। এখানে জাপানি রাজনীতির আর একটি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার- ২০০৭ সালে, শিনজো আবের পদত্যাগের পর ২০১২-তে তার প্রত্যাবর্তনের বছর পর্যন্ত মাঝখানের ৫ বছরে ৫ জন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন এবং মাত্র এক বছরের মাথায় আবার চলেও গিয়েছেন।
শিনজো আবে আগেরবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে, ২০০৭ সালে ভারত সফর করেন। তখন ইচ্ছা করেই তিনি কলকাতায় আসেন একদিনের সফরে। তার উদ্দেশ্য, তিনি বিচারপতি রাধা বিনোদ পালের ছেলে, বৃদ্ধ প্রশান্ত পালের সঙ্গে দেখা করবেন।
এখন এই রাধা বিনোদ পাল সম্পর্কে কিছু কথা।
রাধা বিনোদ পালের জন্ম বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়া ইউনিয়নে; গ্রামের নাম সলিমপুর। ১৯৪১-এ তিনি কলকাতা হাইকোর্টের একজন বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান; দুবছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পরাজিত জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে টোকিও ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়, সেই ট্রাইব্যুনালে রাধা বিনোদ পালও একজন বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু তার ভিন্নমতের রায়ে তিনি জাপানি অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সুতরাং এই বাঙালি রাধা বিনোদ পালকে জাপানিরা তখন থেকেই একজন পীর হিসেবে সম্মান করে আসছে। ১৯৬৬-তে তার মৃত্যুর পর জাপানিরা এয়াসুকুনি সিমেটারিতে তার স্মৃতিতে মূর্তিও নির্মাণ করেছে। কয়েক বছর আগে একটি সচিত্র খবরে দেখেছিলাম, এক জাপানি তরুণ, রাধা বিনোদ পালের জন্মস্থানকে তীর্থস্থানের মর্যাদা দিয়ে কুষ্টিয়ার সেই জায়গা দেখতে গিয়েছে।
জাপানিদের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক স্থাপনে আরও দুই বিশ্বখ্যাত বাঙালি প্রবল ভূমিকা রেখেছেন। এরা হলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সুভাষচন্দ্র বসু। রবীন্দ্রনাথ ১৯০৬ সালেই বোধ করি প্রথম জাপান সফরে যান, পরে আরও কয়েকবার। বাংলা ভাষা এবং বাংলা সাহিত্যকে জাপানিদের কাছে তুলে ধরেছিলেন বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠতম মানুষটি। জাপানিরা এত বছর পরও তাকে স্মরণ করে, সম্মান দেয়।
আর সুভাষচন্দ্র বসু! মহাত্মা গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে অহিংস আন্দোলনকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার বিপরীতে নেতাজী সুভাষ বসু ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সহিংস, সশস্ত্র অভিযানকেই যথার্থ মনে করলেন; এবং জাপানিদের সাহায্য নিয়ে ভারতের পূর্ব সীমান্ত থেকে পশ্চিমে নতুন দিল্লির রেড ফোর্টের উদ্দেশে মার্চ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রায় ৪০ হাজারের মতো ভারতীয়, যারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে জাপানের বিরুদ্ধে বার্মা এবং ওই অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিল, তারা যখন জাপানের কাছে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করল, তাদের নিয়ে সুভাষ বসু গঠন করলেন আজাদ হিন্দ্ ফৌজ। ১৯৪৫-এর জুনে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের সিদ্ধান্তে এটম বোমা ফেলা হল, লাখ লাখ জাপানি মারা গেল, আহত হল, বাকি জীবনের জন্য বিকলাঙ্গ হয়ে গেল। আর জাপানও আত্মসমর্পণ করল। সফল হলেন না সুভাষ বসুও। কিন্তু সুভাষ বসুর দেশপ্রেম সেই জামানায় উজ্জীবিত, অনুপ্রাণিত করেছে স্কুলে আমাদের মতো বালকদেরও। আর জাপানও গেথে গেল আমাদের মনের গভীরে তখন, সেই কিশোর বয়সেই।
তিন.
জাপান আমাকে মুগ্ধ করে। এশিয়ার একটি দেশ, কিন্তু চোখ ধাঁধানো অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং উন্নয়ন এশিয়ার আর কোনো দেশের মতো নয়। ২০১২ সালের আগে জাপানের প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ বছর থমকে ছিল। কিন্তু এই আবে সাহেবের দ্বিতীয় আমল থেকে, কেউ কেউ বলছে, জাপান আবার চলবে। তবে বড় সমস্যা হল, যে তরুণদের ওপর দুনিয়ার অনেক দেশই ভরসা করে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করছে, জাপানের মোট জনসংখ্যায় তাদের পারসেন্টেজটা কম। একে তো জাপানের জনসংখ্যা কমছে, তার ওপর যারা আছে, তারাও প্রবীণ। তাই বলে তারা আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দক্ষ, উচ্চশিক্ষিত লোকদের অন্যান্য দেশ থেকে যে জাপানে ঢুকতে দেবে, তাও নয়। দুনিয়ার অন্য যে কোনো উন্নত দেশের তুলনায়, জাপানিরা এই একক্ষেত্রে সাংঘাতিক কঠোর। বিদেশীদের নাগরিকত্ব দেয় না বললেই চলে। এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, আমাদের কিছু নেতা-মন্ত্রী যখন বলেন, এসব বুড়িয়ে যাওয়া দেশগুলোতে আমরা লোক রফতানি করব; সুতরাং জনসংখ্যা আমাদের কোনোই সমস্যা নয়; তাদের বলি, ওহ্ গড, ফরগিভ দেম, দে নট নো, হোয়াট দে আর সেইং। (Oh God, forgive them, they not know what they are saying. হে সৃষ্টিকর্তা এদের মাফ করে দাও, এরা জানে না, এরা কী বলছে)
জাপানের পশ্চিম দিকে রয়েছে চীন, বিশাল জনসংখ্যার একটি দেশ। আছে রাশিয়াও। দুটো দেশই তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। রাশিয়ার ইউক্রাইন নীতি এবং তার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর হুমকি, হুংকার; পূর্বে, জাপানের দিকেও তো কোনো একদিন মোড় নিতে পারে। তারপর চীন তো প্রতিবেশী প্রায় সবগুলো দেশের সঙ্গেই টেনশন সৃষ্টি করে চলেছে। পশ্চিমে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলমানরা প্রতিবাদ বিক্ষোভ চালাচ্ছে; রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন কয়েক মাস আগে চীন সফরে গিয়ে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের গ্যাস চুক্তি করেছেন ঠিকই, কিন্তু এতগুলো দশকের ঠোকাঠুকি কি এত সহজে মিটবে? তারপর চীন সাগর নিয়ে ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম বিরোধ দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। পাশেই আনবিক বোমায় সজ্জিত উত্তর কোরিয়া এবং তাইওয়ান তো আছেই।
এমন একটি অঞ্চলে জাপান যতই সমৃদ্ধ হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে যতই নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিক না কেন, জাপানের অস্বস্তিবোধ করার যথেষ্ট কারণও আছে। ভারত এবং জাপান যতই কাছাকাছি আসবে ততই চীনকে যৌথভাবে মোকাবেলা করার সক্ষমতাও তাদের বাড়বে। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে জাপানের সম্পর্কোন্নয়নও, এখন মনে হচ্ছে, আরও গুরত্ব পাবে।
চার.
জাপানের টয়োটা এবং হোন্ডা জাপানি কারিগরি এবং বাজারজাতকরণ, দক্ষতার দুটো বিশ্ব প্রতীক। সনি, মিৎসুবিসি, মারুবেনি এমন সব বিশাল বিশাল জাপানি কোম্পানিতে প্রস্তুত করা পণ্যসামগ্রী দুনিয়ার মানুষজনকে অনেক আনন্দ ও স্বস্তির জোগান দিয়ে চলেছে। পাশের দেশ দক্ষিণ কোরিয়া জাপানের বড় প্রতিযোগী এসব ক্ষেত্রে। এমন সব জিনিসপত্রে আমেরিকার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো নয়।
আবার আমেরিকার ম্যাকডোনাল্ড, কোকাকোলা, জিনস,- আমেরিকার এমন সব আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী জিনিসপত্র জাপানের নেই। সিটি গ্র“পের মতো মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংক বা গোল্ডম্যান স্যাকসের মতো আর্থিক সেবাদান প্রতিষ্ঠানও জাপানের নেই। নেই হার্ভার্ড বা এমআইটির মতো কোনো সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ও। এমন কিছু অদূর ভবিষ্যতে যে হবে, এমনও তো মনে হয় না।
কিন্তু তারপরও এশিয়ার একটি দেশ হিসেবে জাপান আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা বেশি বুঝবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমাদের অনুভূতিগুলোও জাপান বেশি সম্মান করবে বলে ধারণা করি। জাপান কোনো বৃহৎ সামরিক শক্তি নয়। বাংলাদেশে জাপানের কোনো বিশেষ মতলব আছে বলে মনে হয় না।
আমাদের দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে জাপানিরা দরকার হলে সাঁতার কেটেই বাংলাদেশে আসবে। প্রেসিডেন্ট এরশাদও ২৬ বছর আগে টোকিওতে জাপানি ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের এক সম্মেলনে বাংলাদেশে আসতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাতে তেমন উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া যায়নি। পরিবেশ এবং ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে স্বাভাবিক নিয়মেই জাপানিরা প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিবেশী আকৃষ্ট হবে।
আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ৪০ বছর ধরেই চেষ্টা করে আসছে জাপানি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে। কিন্তু গ্যাস সংকট নিরসনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি করতে পারে?
জাপানে আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন (অপু) একজন যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিক্সে অনার্স ও এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট ১৯৮৫-তে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও সারা বাংলাদেশে ফার্স্ট হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে হাসনাত আবদুল হাই তার এক চাচা। আর তার শ্বশুর লুৎফুল মতিন আর আমি একই সময়ে ৭১-এ পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে আমাদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। মাসুদ বিন মোমেন জাপানের আগে ইটালিতেও আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিল। ওখানেও মাসুদ সফল হয়েছিল। আশা করছি, জাপানেও সফল হবে। তবে একটি কথা মনে রাখা দরকার। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রাষ্ট্রদূতরা আমাদের প্রেসিডেন্ট-প্রাইম মিনিস্টারদের জাপানে নিতে পারে, জাপানি প্রাইম মিনিস্টার এবং ফরেন মিনিস্টারদের বাংলাদেশেও আনতে পাারে। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েকে তো ২ লেন থেকে ৪ লেনে উন্নীত করতে পারে না।
শিউলীতলা, উত্তরা; শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ১৪
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন