ক্রেস্ট জালিয়াতিতে দেশের ইমেজ ভূলুণ্ঠিত
27 Aug, 2014
ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে বিভাজিত হলে ইন্ডিয়া (ভারত) ও পাকিস্তান নামে দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বিভাজন-পরবর্তী ভারত শুধু তার অখণ্ডতা অুণœই রাখেনি বরং ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সিকিম নামের একটি স্বাধীন রাজ্যকে নিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা-পরবর্তী দুই যুগের কিছুকাল পর আঞ্চলিক জাতিসত্তার ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানের দু’টি অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ভারত ভূখণ্ড দিয়ে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং স্থলপথে উভয় পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল এক হাজার মাইলেরও বেশি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ৭০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বেশি ছিল। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যর্থ হলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীকার আন্দোলন মুক্তিসংগ্রামে রূপ নেয়। এ মুক্তি সংগ্রাম ছিল সশস্ত্র। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এ দেশের ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতা এবং সামরিক-বেসামরিক বাহিনীর সদস্যরা একযোগে অংশ নিয়েছিল। মুক্তি সংগ্রামটি গেরিলা যুদ্ধের আকারে পরিচালিত হওয়ায় সংগ্রামটিকে সফল করার পেছনে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন তাদের চেয়ে যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে সশস্ত্র মুক্তি যোদ্ধাদের নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে খাদ্যসহ সব ধরনের আনুষঙ্গিক সরবরাহ করে গেরিলা যুদ্ধকে সফলতার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের অবদানও কোনো অংশে কম ছিল না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন পৃথিবীর পাঁচটি বৃহৎ শক্তিধর দেশের মধ্যে চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল, অপর দিকে রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। অবশিষ্ট দু’টি বৃহৎ শক্তিধর দেশ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের অবস্থান অনেকটা নিরপেক্ষ ছিল। আমাদের পাশের দেশ ভারত আমাদের মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিল এবং মুক্তিসংগ্রামের শেষের দিকে ডিসেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সর্বাত্ম¡ক যুদ্ধ বেধে গেলে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা এবং এ দেশের মুক্তিকামী জনতার সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাভূত করে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভাজন-পরবর্তী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্ররূপে চলতে থাকে। বাংলাদশের ৭২-এর সংবিধানে দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। অতঃপর পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিটি পরিহার করা হলেও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্্র হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৭-এর পর থেকে অদ্যাবধি ভারতে বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপুলসংখ্যক মুসলমান প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে বিভাজনের অব্যবহিত পর পাকিস্তানের উভয় অংশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেও তা কখনো ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেনি। বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয়-পরবর্তী বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের যেসব ঘটনা ঘটেছে এর সব ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ক্ষমতাসীনেরা এটিকে অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের ক্ষমতায় অক্ষুণœ রাখার জন্য ভারতের আনুকূল্য লাভে সচেষ্ট ছিল।
পাকিস্তান ও আমেরিকা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বিরোধেতা করলেও দেশ দু’টির কিছু বিশিষ্ট নাগরিকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠন আমাদের মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের লেখনী, সভা-সমাবেশে সঙ্গীত পরিবেশন ও বক্তব্যদানের মাধ্যমে সমর্থন জুগিয়েছিলেন। তাদের এ সমর্থন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সপক্ষে জনমত সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রেখেছিল। তাদের এ অনন্য অবদানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তিন পর্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের ৩৩৮ ব্যক্তি ও সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়। ক্রেস্ট দেয়ার সময় ক্রেস্ট পাওয়া অনেকেই ছিলেন পরলোকগত। তাদের পক্ষে তাদের পরিবারের সদস্যরা ক্রেস্ট নেন।
ক্রেস্ট দেয়ার অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে, যদিও ক্রেস্ট প্রস্তুতের দায়িত্ব এককভাবে পালন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আন্তঃমন্ত্রণালয় পর্যায়ে বৈঠক-পরবর্তী সিদ্ধান্ত হয় যে, সেগুনকাঠের ওপর জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতি সম্বলিত প্রতিটি ক্রেস্ট প্রস্তুতে ২২.৫ গ্রাম স্বর্ণ ও ৩৩৯ গ্রাম রুপা ব্যবহার করা হবে। এ উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়, সে কমিটি ‘এমিকন’ ও ‘মেসার্স মোহসিনুল হাসান নামের দু’টি প্রতিষ্ঠানকে ক্রেস্ট তৈরির দায়িত্ব দেয়। বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ, মোহসিনুল হাসান মূলত একজন নির্মাণ ঠিকাদার এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়। ক্রেস্ট দেয়ার পর বাংলাদেশ মাননিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় বের হয়ে আসে প্রতিটি ক্রেস্টে স্বর্ণের অস্তিত্ব দুই গ্রামের কিছুটা বেশি এবং রুপার বদলে রয়েছে সমপরিমাণ পিতলের অস্তিত্ব। ক্রেস্ট প্রস্তুতে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় সাত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলে স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগের তীর তৎকালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও সচিবসহ অপর কিছু কর্মকর্তার প্রতি নিবদ্ধ হয়। এ বিষয়ে অদ্যাবধি কোনো মামলা না হলেও বিষয়টি বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তাধীন। তদন্তের মাধ্যমে কোনো একদিন হয়তো দোষীরা চিহ্নিত হবে এবং বিচারপ্রক্রিয়া সমাপন শেষে তাদের হয়তো সাজাও হবে; কিন্তু ক্রেস্ট প্রস্তুতে যে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে এর সাথে সম্পৃক্তদের সাজা দেশের ভাবমূর্তির যে হানি হয়েছে, তার কী উত্তরণ ঘটাতে পারবে?
যেকোনো ব্যক্তিকে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ যখন স্বর্ণনির্মিত পদক বা ক্রেস্ট দেয়া হয়, তখন ওই ব্যক্তি এবং তার অবর্তমানের পরিবারের সদস্যরা পদক বা ক্রেস্টটিকে সযতেœ সংরক্ষণ করে থাকেন। এসব পদক বা ক্রেস্টে কী পরিমাণ স্বর্ণ বা রৌপ্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেসংক্রান্ত ধারণা ক্রেস্টের সাথে সন্নিবেশিত কাগজপত্রে উল্লেখ থাকে। এ পদক বা ক্রেস্টপ্রাপ্ত কেউ পদক বা ক্রেস্টে স্বর্ণের অস্তিত্ব কতটুকু কদাচিৎ এটি যাচাই করতে গেছেন বলে শোনা যায়নি। তবে অর্থাভাবে পড়ে অলিম্পিক পদকপ্রাপ্ত বা অন্যান্য পদক বা ক্রেস্টপ্রাপ্তের পদক বা ক্রেস্ট বিক্রয়ের দুই-একটি ঘটনার কথা শোনা গেছে। এরূপ পদক বা ক্রেস্ট পাওয়া ব্যক্তি তার পদক বা ক্রেস্টটি যেকোনো অসুবিধা বা সমস্যায় পড়ে বিক্রি করতে গেলেই তার কাছে ধরা পড়তে পারে প্রকৃতই পদক বা ক্রেস্টে সোনা ও রুপা নির্ধারিত পরিমাণের উপস্থিতি আছে কি না।
যেকোনো দেশ ও জাতি নিজেদের যেকোনো আন্দোলন বা সংগ্রামে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যারা তাকে সাহায্য করেছিল তাদের যদি সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়ার মাধ্যমে সম্মানিত করে, সে ক্ষেত্রে দেশ ও জাতি নিজেও সম্মানিত হয় এবং এতে দেশ ও জাতির উদারতা ও আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বিদেশী যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন জুগিয়েছিলেন তাদেরকে সম্মাননা ক্রেস্টের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে ক্রেস্ট দেয়া তাদের জন্য বিরল ঘটনা এবং অতীব সম্মানের; কিন্তু তাদের প্রতি সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়ার মাধ্যমে যে সম্মান দেখানো হয়েছে, এরূপ সম্মান এ দেশের নাগরিকদের মধ্যে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ের মাধ্যমে লালিত-পালিত করে গেরিলা মুক্তিসংগ্রামকে যারা সফলতার পথে নিয়ে গেছেন তাদের কারো কি প্রাপ্য নয়? এ ধরনের অনেক ব্যক্তি আছেন শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য যারা জীবন হারিয়েছেন, অথবা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার কারণে আশ্রয়হীন হয়েছেন, এদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তারা কী পেয়েছেন? আর এদের ক’জনকে দেশ বা জাতি সম্মানিত করেছে?
আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সামরিক-বেসামরিক বাহিনীর সদস্যসহ ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক জনতা আত্মাহুতি দিলেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এমন সাতজনের কপালে জুটেছে। এ পদক মুক্তিসংগ্রামে আত্মাহুতিদানকারী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানের কারণে হত্যার শিকার হয়েছেন, এমন কারো কি প্রাপ্য নয়Ñ এ প্রশ্নটি আজ বিভিন্ন মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে না গিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এবং অস্ত্র জোগাড় করে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন এমন অনেক যোদ্ধা রয়েছেন। এদের দুই-একজন স্বনামধন্য। এ দুই-একজনকে সবাই চেনেন ও জানেন। এ দুই-একজনসহ এদের অনুগতরা কী প্রাপ্য সম্মান পেয়েছেন? আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সহায়তাকারী বিদেশী ব্যক্তি ও সংগঠনকে সম্মাননা ক্রেস্ট দিয়ে যে একটি মহতী উদ্যোগ, এ বিষয়ে দেশের কারো মধ্যে কোনো ধরনের দ্বিমত নেই এবং এ মহতী উদ্যোগ নেয়ার জন্য বর্তমান সরকার ধন্যবাদার্হ। বর্তমানে সরকারের এ মহতী উদ্যোগ আরো মহিমান্বিত হতো যদি যে পরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্য দিয়ে ক্রেস্ট নির্মাণের কথা ছিল প্রকৃতই ক্রেস্টে সে পরিমাণ স্বর্ণ ও রৌপ্য দেয়া হতো এবং এ দেশের যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে লালিতপালিত করে মুক্তিসংগ্রামকে চূড়ান্ত সফলতা দিয়েছেন তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে বিদেশীদের মতোই তাদেরকে সমভাবে সম্মানিত করতে পারা যেত।
ক্রেস্ট প্রতারণা ও জালিয়াতিতে দেশের ভাবমূর্তির যে ভূলুণ্ঠন হয়েছে এবং তার জন্য সমগ্র দেশ ও জাতির ্ওপর যে কলঙ্ক আরোপিত হয়েছে, এর কিছুটা হলেও লাঘব হবে যদি প্রতারণা ও জালিয়াতির সাথে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে এমন সাজার ব্যবস্থা করা যায়, যাতে কেউ দেশের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয় ভবিষ্যতে এ ধরনের হীন ও জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হওয়ার পথে পা না বাড়ায়।
সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন