সম্প্রচার নীতিমালা কি সত্যি নীতিমালা, না ভীতিমালা, জাতীয় সংসদকে অভিশংসনের ক্ষমতা দিলে মাননীয়রা ফণা তুলে কাউকে দংশন করবেন কি না, অভিশংসন কি শেষটায় অভিসম্পাত হয়ে দাঁড়াবে জাতির জন্য, মস্তিষ্কের বকযন্ত্রে যখন এসব বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছিল, যখন ভাবছিলাম এগুলো নিয়ে সেলাই করা মুখের সেলাই খুলব, ঠিক তখনই গতকাল (১৮-৮-২০১৪) সকালে সহকর্মী ও ব্যাচমেট বন্ধু আবদুল্লাহ হারূন পাশার টেলিফোন : শুনেছিস, জালাল আর নেই। গত রাত সাড়ে ১০টায় জালাল চলে গেছে না-ফেরার দেশে।
খবরটা শুনে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকলাম। জালাল, পুরো নাম এ কে এম জালালউদ্দিন, আমার ব্যাচমেট ও আমাদের ১৯৬৬ ব্যাচের সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) অফিসারদের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের 'প্রথম বালক'- ফার্স্ট বয়। সমগ্র পাকিস্তানভিত্তিক সিএসএস (সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস) নামক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সে বছর জালাল হয়েছিল সেকেন্ড। পত্রিকায় পরীক্ষার ফল দেখে কেউই বিস্মিত হননি। আজীবন ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্র জালাল সিএসএস পরীক্ষায়ও দারুণ রেজাল্ট করবে, তা সবারই জানা ছিল। বরং সে ফার্স্ট হয়নি দেখে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। তবে আসল মাজেজাটা আমরা জানতে পারলাম লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ট্রেনিংয়ের জন্য ১৯৬৬ সালের ৯ অক্টোবর যোগদানের পর। সেবার পাঞ্জাবের মুহাম্মদ রিয়াজুল হক সারা পাকিস্তানে ফার্স্ট হয়েছিল। সে জালাল থেকে অল্প কয়েক নম্বর বেশি পেয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, জালাল লিখিত পরীক্ষায় রিয়াজ থেকে অনেক বেশি নম্বর পেয়েছিল। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় সে অস্বাভাবিক রকম কম নম্বর পায়। আর রিয়াজ পায় অস্বাভাবিক রকম বেশি। আমাদের বুঝতে বাকি রইল না, পূর্ব পাকিস্তানের পরীক্ষার্থী জালালকে 'ভাইভা' (মৌখিক) পরীক্ষায় কম নম্বর দিয়ে ফার্স্ট হওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিষয়টি সবার কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট হলেও জালালকে কোনো দিন এ নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি।
অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী জালাল ছিল 'উইট' ও 'হিউমার'-এর রাজা। যেকোনো বিষয়ে লেখা তার নিবন্ধগুলো হীরের টুকরোর মত দ্যুতি ছড়াত। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি সব বিষয়ে তার জ্ঞানের গভীরতা ছিল অপরিসীম। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ও সে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার ও মর্নিং নিউজে নিয়মিত কলাম, ফিচার ইত্যাদি লিখত। তখন একজন তরুণ নিবন্ধকার ও প্রতিবেদক হিসেবে সে প্রভূত সুনাম অর্জন করে। ইংরেজি ভাষার ওপর তার দখল যেমন ছিল অসাধারণ, তেমনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তার বিশ্লেষণধর্মী ও ভিন্ন মেজাজের লেখাগুলো এককথায় ছিল অপূর্ব। তার হাতের লেখাও ছিল মুক্তার মত।
দুটি নক্ষত্রের যুগপৎ নিঃশব্দ প্রস্থান
কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে আর দশটা ভাল ছাত্রের মত জালাল কিন্তু লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিল না। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় একজন অমনোযোগী, ফাঁকিবাজ ছাত্র হিসেবে নটর ডেম কলেজের তৎকালীন নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খলার প্রতিভূ অধ্যক্ষ ফাদার মার্টিন তাকে সোজা বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এরপর বোধ হয় সেই স্বনামধন্য অধ্যক্ষ নিজের ভুল ঝুঝতে পারেন যখন দেখেন তাঁর বিবেচনায় যে ছাত্রটি ছিল 'মোস্ট্ ইনডিসিপ্লিনড্', সে পরবর্তী ইন্টারমিডিয়েট অব আর্টস (আইএ) পরীক্ষায় ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে সবাইকে চমকে দিয়ে ফার্স্ট হয়েছে। এরপর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে বিএ পড়তে শুরু করে। কিন্তু অর্থনীতি পড়তে গিয়ে সে দেখল, আসলে এটা তার সাবজেক্ট নয়, বিষয়টি তার কাছে মোটেই আকর্ষণীয় ঠেকছে না। যেভাবে পরবর্তী জীবনে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত এএনইউ (অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি)-তে ডেমোগ্রাফি বা জনসংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ে পিএইচডি করতে গিয়ে তার 'বিবমিষার' উদ্রেক হয় এবং অবশেষে 'থিসিস' না লিখেই 'ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি' বলে চলে আসে ওই দেশ থেকে। তার পছন্দের বিষয় ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সাংবাদিকতা, ইতিহাস ইত্যাদি। সে সেটার প্রমাণও দিল অর্থনীতিতে অনার্স ফাইনালে আশানুরূপ ফল না হওয়ার পর যখন ওই বিষয়কে ওখানেই গুডবাই জানিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (ইন্টারন্যাশন্যাল রিলেশনস) নিয়ে পড়াশোনা করল এবং ওতে মাস্টার্স ফাইনালে রেকর্ড মার্কস পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলো।
জালালের একটা বড় গুণ ছিল, সব ধরনের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তার প্রাণখোলা আচরণ। সে যে একজন অসাধারণ মেধাবী ব্যক্তি, একজন 'জিনিয়াস', এটা তার চালচলনে-কথাবার্তায় কখনো প্রকাশ পেত না। লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আমাদের এক বছরব্যাপী অবস্থানকালে পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশিক্ষণার্থী সহকর্মী ও সিনিয়র অফিসাররাও সবাই তাকে খুব ভালবাসত তার সরস বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা ও মধুর ব্যবহারের জন্য। সেখানেও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সে ছিল মোটামুটি উদাসীন। ক্লাস ফাঁকি দেয়া এবং হর্স রাইডিং, টেনিস, পিটি ইত্যাদিতে পারতপক্ষে না যাওয়াতে পারঙ্গম ছিল এই কুঁড়ের বাদশা। ঘরে বসে দরজায় খিল দিয়ে যে আইন, উন্নয়ন অর্থনীতি বা জনপ্রশাসনের মোটা মোটা কেতাব গলাধঃকরণ করত, তা-ও নয়। বরং সুযোগ পেলেই এক সিঙ্গল ঘুম দেয়াতে পটু ছিল আমার এই 'ইজি গোয়িং' বন্ধুটি।
১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রথা চালু করে তৎকালীন সরকার সেই সময়ের ৬১টি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে এবং প্রত্যেক জেলায় একজন করে জেলা গভর্নর নিযুক্ত করে। এদের মধ্যে সাতজন সাবেক সিএসপি এবং কয়েকজন সাবেক ইপিসিএস অফিসারও ছিলেন। সিএসপিরা ছিলেন : ১৯৬৪ ব্যাচের কাজী মো. মনজুরে মাওলা ও মো. লুৎফুল্লাহিল মজিদ, ১৯৬৫ ব্যাচের মো. ইরশাদুল হক এবং ১৯৬৬ ব্যাচ, অর্থাৎ আমাদের ব্যাচের, জালাল, আমি, ফয়েজুর রাজ্জাক ও সফিউর রহমান। বঙ্গভবনে এক মাসের জন্য আমাদের একটা 'ওরিয়েন্টেশন কোর্সের' আয়োজন করা হয়, যেখানে জালাল, আমি বা মাওলা বিষয়টি নিয়ে মোটেই সিরিয়াস ছিলাম না। বরং লেকচার ক্লাসে নিয়মিত ঘুমানো, মাওলা ও আমার মধ্যে পাশাপাশি বসে ছড়া লেখালেখির মাধ্যমে এক ধরনের কবি-লড়াই, বক্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বই বা ম্যাগাজিন পড়া, এসব ছিল নীরস লেকচারের চেয়ে অধিক উপাদেয়। রংপুর জেলার জেলা গভর্নর 'ডেজিগনেট' জালাল গালে হাত দিয়ে দিয়ে বসে বসে দিবানিদ্রা উপভোগ করত অথবা সঙ্গে আনা কোনো বই পড়ত।
এর আগে ও যখন চাঁদপুরের এসডিও, আমি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আর সে যখন ময়মনসিংহ জেলার ডিসি, আমি তখন কুষ্টিয়ায়। চাকরিতে সে যখন যেখানে কাজ করেছে সেখানে তার দক্ষতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য সুনাম অর্জন করেছে। সত্তরের দশকের শেষভাগে বিসিএস (প্রশাসন)-এর উপসচিব পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা 'অপশন' দিয়ে ফরেন সার্ভিসে চলে যান। তাঁদের মধ্যে জালালও ছিল একজন। ওই সময়েই অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করতে যায় সে। সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী। দুর্ভাগ্যবশত ওই সময়টা ছিল তার জন্য সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ কাল। নিঃসন্তান জালাল দম্পতির পারিবারিক জীবন ছিল অশান্তিপূর্ণ। ক্যানবেরাতেই তাদের দাম্পত্য-জীবনের অবসান ঘটে। আশির দশকের শুরুতে দেশে ফেরে জালাল দ্বিতীয়বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং এবার তাদের দুটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ বিয়েও টেকেনি। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝার পর বিয়েটি ভেঙে যায় এবং জালালের সঙ্গী হয় এক দুরারোগ্য ব্যাধি- পারকিনসন্স ডিজিজ। সেই আশির দশকের মাঝামাঝি এর শুরু। অবশেষে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ জীবন্মৃত অবস্থায় শয্যাশায়ী থেকে চলে গেল জালাল। যে জীবন প্রস্ফুটিত হয়েছিল একগুচ্ছ গোলাপের সৌরভ নিয়ে, অবশেষে তার কী করুণ পরিণতি। জীবনের শেষ ২৫টি বছর জালালের সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার বলতে গেলে কোনো যোগাযোগই ছিল না। মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত পুরনো একটি পরিত্যক্ত বাসায় লোকচক্ষুর অন্তরালে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া বাকশক্তি-চলচ্ছক্তিহীন জালালকে দেখাশোনা করার জন্য ছিল মাত্র দু-তিনজন গৃহকর্মী- আর কেউ না। স্ত্রী না, পুত্র না, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ না। ক্বচিৎ কেউ হয়ত যেত এককালের সেই অপার সম্ভাবনাময় মেধা-মননের জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক মানুষটিকে দেখতে। কারো সঙ্গে কোনো বাক্যবিনিময় হতো না, শুধু বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকত শয্যায় মিশে যাওয়া জালাল। অন্তিমকালে পাশে ছিল কেবল একজন সেবাকর্মী। রাত তখন সাড়ে দশটা।
জালাল চলে গেল রোববার রাতে। পরদিন সকালে পাশার কাছ থেকে খবরটা পেয়ে মনটা সাংঘাতিক খারাপ হয়ে গেল। শুনলাম তার লাশ রাখা হয়েছে হাসপাতালের হিমাগারে। অস্ট্রেলিয়া থেকে তার বড় ছেলে নাভেদ ফেরার পর জানাজা-দাফন হবে।
(২)
পরদিন, সোমবার, বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সতীর্থ বন্ধু পুলিশের সাবেক আইজি শাহজাহানের ফোন। 'মোফাজ্জল, দুঃসংবাদ। সফিউর রহমান আর নেই। একটু আগে বেলা ২টা ২০ মিনিটে চলে গেছে সফিউর।' শুনে আমি রীতিমত বজ্রাহত। আমার আজীবনের বন্ধু, সতীর্থ, সাবেক সিএসপি সফিউর চলে গেল। সেও আমার ব্যাচমেট। ১৯৬৬ ব্যাচের সিএসপি। এর আগে সিলেট সরকারি এমসি কলেজে দুই সিলেটি একসঙ্গে চাকরি করেছি। ও ছিল অর্থনীতির প্রভাষক, আমি ইংরেজির। ওখান থেকেই দুজনে একসঙ্গে সিএসএস পরীক্ষা দেই, একসঙ্গে লাহোর যাই, সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ট্রেনিং নেই, একসঙ্গে দু'জন আড়াই মাস পেশোয়ারে ১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে শাহী মেহমানখানার অন্ধ প্রকোষ্ঠে থেকে জেলা প্রশাসনের ওপর প্রশিক্ষণ নেই, পরে একসঙ্গে রাজশাহীর গ্রামাঞ্চলে সেটেলমেন্ট ট্রেনিংয়ে একই ক্যাম্পে থাকি...। ইত্যাদি ইত্যাদি কত কী। সর্বোপরি ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাসে ও পরে গ্রামগঞ্জের বনবাদাড়ে আর্মি ট্রেনিংয়ে শুধু আমরা দুই বন্ধু একসঙ্গে কত সুখ-দুঃখ চেখে চেখে দেখি।
সেই সফিউর স্বরাষ্ট্র সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, নির্বাচন কমিশনার ইত্যাদি বিরাট বিরাট দায়িত্ব পালনের পর অবসরজীবনে নিজেকে সমাজ-সংসার থেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিল। কারো সঙ্গে মিশত না, যোগাযোগ রাখত না, কাউকে ঠিকানা-ফোন নম্বর ইত্যাদি কিছুই দিত না। রীতিমত গোয়েন্দাগিরি করে আজ থেকে বছর তিনেক আগে আমি তার বারিধারার ভাড়াটে বাসার ঠিকানা সংগ্রহ করে এক সন্ধ্যায় ছুটে যাই দেখা করতে। চিরকাল নিভৃতচারী সফিউর দেখলাম আরও নিস্পৃহ, নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত একজন মানুষ হয়ে গেছে। প্রায় এক যুগ পর আমাকে দেখে ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হয়েছে মনে হল, বাইরে যদিও তার প্রকাশ ছিল না বললেই চলে। তবু সেই আগের মত স্বামী-স্ত্রী দু'জনে রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়লেন না। এরপর মাঝে মাঝে আমি ফোনে খোঁজ-খবর নিয়েছি। কিন্তু সফিউর কাউকে ফোনটিও করত না। আমাকেও না। কী এক অজানা অভিমান বুকে চেপে বহুকাল যাবৎ সে ছিল সৃষ্টিকর্তার নিকট পুরোপুরি আত্মসমর্পিত।
কদিন পর সে আবারও হারিয়ে গেল। বাসা বদলিয়ে চলে গেছে শুনলাম নিকুঞ্জে নিজের বানানো বাসায়। এবং তারপর মাত্র মাস তিনেক আগে একদিন আমার অনুজ আমাকে জানাল, সফিউর ক্যান্সারে আক্রান্ত। সে আমাকে ওর ফোন নম্বরও দিল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম ওর বাসায়। ভাবি জানালেন জিহ্বা, গলা, তালু ইত্যাদিতে ক্যান্সারের বিবরণ। বললাম, আমি আজই আসব ওকে দেখতে। ভাবি বললেন, না ভাই, আসবেন না। উনি কারো সঙ্গে দেখা করেন না। আপনারা শুধু দু'আ করবেন ওর জন্য।...এর পরও দু'একবার যেতে চেয়েছি; কিন্তু ইজাজত মেলেনি আমার বন্ধুর। এমনকি কাউকে তার অসুখের কথা বলাও নাকি নিষেধ ছিল। শেষের দিকে তো নাকি আর কথাও বলতে পারত না, কানেও শুনতে পেত না, খেতে পারত না কিছুই। আর রীতিমত হৃষ্টপুষ্ট সুদেহী মানুষটি শুকিয়ে দড়ি হয়ে গিয়েছিল।
সিভিল সার্ভিসে- শুধু সিভিল সার্ভিস বলি কেন, বাংলাদেশের সব সার্ভিসে, সব ক্ষেত্রে- সফিউরের মত সৎ, নীতিপরায়ণ, দৃঢ়চেতা, ধার্মিক মানুষ দ্বিতীয়টি মেলা ভার। সে ন্যায়ের জন্য, নীতির জন্য, আদর্শের জন্য সারা জীবন নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল। একটি ছোট্ট উদাহরণ দেই। ১৯৬৬ সালে তখন আমরা লাহোর একাডেমিতে কেবল যোগ দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ বিশাল বাসে করে আমাদের নিয়ে গেল পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল সফরে। সেই সফরে একদিন খাইবার গিরিপথ পার হয়ে আমরা গেলাম লান্ডিকোটাল বাজারে। সস্তায় চোরাই মালের জন্য লান্ডিকোটালের তখন দারুণ সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি। সবাই ওখানে হামলে পড়ল এটা-ওটা কিনতে। কিছুই কিনল না শুধু একজন- সফিউর। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ৫০ জন প্রশিক্ষণার্থী অফিসার ও সঙ্গের আরো পাঁচ-সাতজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মধ্যে আমার বন্ধুই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। যাত্রার আগে পেশোয়ারের পল্লী উন্নয়ন একাডেমির রেস্ট হাউসে সে আমাকে বলেছিল : মোফাজ্জল করিম, লান্ডিকোটালে আমি কিন্তু কিছুই কিনব না। আমি জানতে চাইলাম, কেন? টাকা-পয়সার দরকার নাকি? সে বলল না, এ রকম কেনাকাটা ঠিক না। ওইসব চোরাই মাল কেনা অন্যায়। 'কিন্তু সব ব্যাচের সবাই তো কেনে, আমরাও সাধ্যমত কেনাকাটা করব। আপনি কিনবেন না কেন?' সে বলল, সবাই কিনুক, আমি কিনব না। এই ছিল সফিউর। শতকরা এক শ ভাগ হালাল রুটি-রুজির জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন মানুষ।
সফিউরের মৃত্যুসংবাদ পরদিনের দৈনিকগুলোতে ছাপা হয়েছে ছোট্ট করে। ওই একই দিনে ছাপা হয়েছে বর্তমানের একজন সচিবের ওএসডি হওয়ার খবর। তিনি নাকি বিদেশিদের স্বর্ণফলক প্রদানের কেলেঙ্কারিতে জড়িত। আরও অনেক সচিব ও পদস্থ কর্মকর্তা জাল-জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা সেজে ফেঁসে গেছেন। পত্রপত্রিকায় কদিন ধরে সে খবরও আসছে। জনপ্রশাসনের আরেক সচিব বেশ কিছুদিন আগে নিজের জন্মতারিখসংক্রান্ত গোপনীয় কাগজপত্র বদলিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নাকি চাকরি করে শেষটায় ধরা খেয়েছিলেন। তিনি আবার জাতে সাবেক সিএসপি- আমার ও সফিউরের স্বগোত্র! আল্লাহ এঁদের হেদায়েত করুন। সফিউর বোধ হয় এসব দেখেশুনে শেষ বয়সে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
(৩)
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত তৎকালীন পাকিস্তানে প্রতিবছর দেশব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে সিএসপি অফিসার নিয়োগ দেয়া হতো। এভাবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালি অফিসার নিয়োগ দেয়া হয় মোট ২০৮ জন। ১৯৬৬ সালে আমাদের ব্যাচে আমরা ছিলাম ১৪ জন। আমাদের আগের ও পরের ব্যাচসমূহের অনেকেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে শহীদও হয়েছেন। মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে ১৯৬৯ ব্যাচের অত্যন্ত মেধাবী ও প্রাণোচ্ছল অফিসার মো. আকমল হোসেন দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু আল্লাহর ফজলে এই একটি ব্যাচ, অর্থাৎ আমাদের ১৯৬৬ ব্যাচের কেউই আজ পর্যন্ত পরপারে পাড়ি জমায়নি। যখন ডাক এল তখন একসঙ্গে যুগলবিদায়। বলতে গেলে একই দিনে। যেন মৃত্যু নয়, স্বেচ্ছামৃত্যু।... সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
আমরা বাকি সবাই বসে আছি 'ডিপারচার লাউঞ্জের' যাত্রী হয়ে। যখন যার (অনন্ত) ফ্লাইটের যাত্রা ঘোষণা করা হবে, সে চলে যাবে নীরবে-নিঃশব্দে। আকমল, জালাল ও সফিউরের মত যারা দুই ঘড়ি আগে চলে গেছে তারা হয়ত বলছে : উইপ নট ফর মি, লেমেন্ট নো মোর/আই অ্যাম নট লস্ট, বাট গন বিফোর।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন