|
গাজীউল হাসান খান
|
|
গাজার যুদ্ধাপরাধ তদন্তে প্যানেল গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ইসরায়েলের
20 Aug, 2014
সম্প্রতি পর পর দুই দফা দু-তিন দিনের জন্য ঘোষিত তথাকথিত যুদ্ধবিরতি মূল সমস্যার কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধান বয়ে আনতে ব্যর্থ হলে ১৪ আগস্ট সকালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কায়রোতে আবার পাঁচ দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। অবশ্য আগে থেকে এমনটাই ধারণা করা হয়েছিল। কারণ বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে বাস্তবতার ভিত্তিতে দীর্ঘ আলোচনা এবং কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা ছাড়া যুদ্ধবিরতি যে প্রকৃত অর্থে কোনো পরিবর্তন সাধন করতে পারবে না, এটা আগেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। গত ৮ জুলাই থেকে ২৮ দিনের অব্যাহত ইসরায়েলি হামলায় গাজা ভূখণ্ডে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে, যার অধিকাংশই শিশু এবং নিরীহ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। স্পষ্টতই সে যুদ্ধ ছিল একতরফা, অসম ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসরায়েল তাকে যুদ্ধ বলে অভিহিত করলেও তাতে হামাসের রকেট নিক্ষেপের ফলে তাদের দু-তিনজন মানুষ মারা গিয়েছিল। বাকি ৬৪ জন ছিল যুদ্ধরত ইসরায়েলি সেনা, যাদের প্রায় অধিকাংশই নিহত হয়েছে হামাস নির্মিত সুড়ঙ্গপথে। ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের আরোপিত গত প্রায় আট বছর স্থায়ী অবরোধ প্রত্যাহারসহ তাদের চলাফেরা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবহারসামগ্রী আনা-নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় গাজাবাসীর পক্ষে একটি পাঁচ দফা শর্ত উত্থাপন করা হয়েছে। তাতে গাজা সমুদ্র উপকূল ব্যবহার এবং ভূমধ্যসাগরে মৎস্য শিকারের বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। মিসরের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, কোনো দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থায় যাওয়ার আগে গাজাকে সম্পূর্ণরূপে অস্ত্রমুক্ত করা এবং হামাসকে ইসরায়েলের ভেতরে রকেট নিক্ষেপ থেকে বিরত করা। কিন্তু প্রদত্ত শর্ত না মানলে ফিলিস্তিনিরা কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছে।
হামাস ফিলিস্তিনের, বিশেষ করে গাজা উপত্যকার একটি রাজনৈতিক সংগঠন হলেও তাদের সামরিক অংশের কার্যকলাপ নিয়ে ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত। হামাসের জঙ্গি তৎপরতার কারণেই এ পর্যন্ত চারবার ইহুদিবাদী ইসরায়েল গাজার ওপর হামলা চালিয়ে অগণিত নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করেছে। হামাসকে সমর্থন করে না মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ আরব রাষ্ট্র। বরং তারা জঙ্গিবাদী ও রাজতন্ত্রবিরোধী শক্তি হিসেবে হামাসকে যথেষ্ট ভয় পায়। অথচ ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে হামাস অত্যন্ত সক্রিয় ও সোচ্চার বলে শুধু গাজার অধিবাসীরাই নয়, সমগ্র ফিলিস্তিনের জনগণের মধ্যেই তারা অত্যন্ত জনপ্রিয়। তারাই এখনো আপসহীনভাবে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত রেখেছে বলে সে অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ধারণা। হামাসের সঙ্গে লেবাননের শিয়াপন্থী গেরিলা সংগঠন হিজবুল্লাহ ও ইরানের অত্যন্ত সুসম্পর্ক রয়েছে। তবে হামাসের সঙ্গে মৌলবাদী আল-কায়েদার যে কোনো সম্পর্ক নেই, তা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা শক্তি এবং ইহুদিবাদী ইসরায়েলও ভালো করেই জানে। হামাস ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্নে আপসহীন এবং ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের ইহুদিবাদী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর। হামাস মনে করে, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের 'আল-ফাতাহ' নেতারা পশ্চিমা শক্তির তাঁবেদার ও আপসকামী। মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি জনগণের সে 'নরমপন্থী' কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ দিয়ে জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জন হবে একটি অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ব্যাপার।
গাজার যুদ্ধাপরাধ তদন্তে প্যানেল গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ইসরায়েলের
ইহুদিবাদী ইসরায়েলের একতরফা ট্যাংক ও জঙ্গিবিমান হামলায় গাজার অভ্যন্তরে প্রায় দুই হাজার নারী-পুরুষ ও বিশেষ করে শিশু অকাতরে প্রাণ হারালেও যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের পশ্চিমা মিত্রশক্তি এ ঘটনার জন্য হামাসকেই দোষারোপ করে চলেছে। অথচ হামাসের সামরিক শাখার সদস্যরা না প্রবেশ করেছে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে, না তাদের আছে কোনো ট্যাংক বা জঙ্গিবিমান। তা ছাড়া তথাকথিত সে যুদ্ধের আগে হামাস সদস্যরা কোনো ইহুদি কিশোরকে অপহরণ করেনি বলে ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী নিজে ঘোষণা করলেও একটি ফিলিস্তিনি আরব কিশোরকে পুড়িয়ে মেরেছে ইহুদিরা। তারই প্রতিবাদে হামাসের কিছু রকেট নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশই ইসরায়েলিরা আকাশেই ধ্বংস করেছে নতুবা সেগুলোর বেশ কিছু পড়েছে সীমান্তে নির্মিত ইসরায়েলের 'আয়রন ডোমের' ওপর। তার পরও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা শক্তি একজোট হয়ে বলে যাচ্ছে, 'ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।' এখন বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী ও প্রতিবাদী মানুষের প্রশ্ন হচ্ছে, 'এটাই কি ইসরায়েলের আত্মরক্ষার নমুনা।' ইসরায়েল ২০০৬ সালে গাজার ওপর অন্যায়ভাবে অবরোধ আরোপ করে, যা গত আট বছরে একটি বিশাল অমানবিক কারাগারে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে, অর্থাৎ পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে অবৈধভাবে ইহুদি বসতি নির্মাণ অব্যাহত রাখা এবং অবরোধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কোনো দেশই এ পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়নি। তা ছাড়া পূর্বঘোষিত দুই রাষ্ট্রভিত্তিক (ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন) পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফিলিস্তিনিরা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বরং নিরাপত্তা পরিষদে তার বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করে যায়। এ অবস্থায় মুক্ত বিশ্বের স্বাধীন মতামতের অধিকারী মানুষ মনে করে, ফিলিস্তিনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো ন্যায়সংগত মীমাংসা আশা করা যায় না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলো পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের রয়েছে সীমাহীন ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামরিক স্বার্থ। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও সিনেটে রয়েছে যথেষ্ট প্রভাবশালী ইহুদি রাজনীতিক। যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলি আমেরিকান লবি অত্যন্ত শক্তিশালী। সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জগতের অধিকাংশ ধনিক-বণিক ও প্রভাবশালী মানুষই ইহুদি ধর্মাবলম্বী এবং সে কারণে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তার বিপরীতে আরবদের মধ্যে নেই ন্যূনতম কোনো ঐক্য এবং শিক্ষাদীক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত পিছিয়ে রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট গাজায় প্রথম সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে দলে দলে মার্কিন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের প্রভাবশালী নেতাদের অনেকে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে তাঁদের সমর্থন ও সংহতি প্রকাশের জন্য। ইসরায়েলের বাইরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইহুদিদের সমাবেশ ঘটেছে নিউ ইয়র্কে। তাই নিউ ইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর এন্ড্রু এম কুমো ছুটে গেছেন তাঁর দলবল নিয়ে ইসরায়েলি বিমানের প্রথম শ্রেণির প্রায় সব আসন দখল করে। তা ছাড়া তাঁর পূর্বসূরি, অর্থাৎ নিউ ইয়র্ক রাজ্যের সাবেক গভর্নর মাইকেল আর ব্লুমবার্গ প্রথম শ্রেণিতে আসন না পেয়ে ইকোনমি আসনে বসেই ছুটে গেছেন তাঁদের পুণ্যভূমি জেরুজালেম সফর করে নেতানিয়াহুর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে। গেছেন আরো অনেক ইহুদি রাজনীতিক, ধনিক, বণিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তবে ভ্রমণকারী অধিকাংশ রাজনীতিক বা কংগ্রেসম্যান ও সিনেটর হচ্ছেন তাঁরাই, যাঁদের নির্বাচনী এলাকায় রয়েছে যথেষ্ট ইহুদি ভোটার। তাঁরা ভালো করেই জানেন, ইসরায়েলি সমর্থন ও অর্থ সাহায্য ছাড়া তাঁদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যয়বহুল নির্বাচন করাই কঠিন হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকেও ওয়াশিংটন ডিসির ইসরায়েলি আমেরিকান লবি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে তাঁদের প্রচারাভিযান চালানোর জন্য। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বেশি দুঃখের কারণ হচ্ছে ওবামা প্রশাসনের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সবার আগে তেল আবিবে ছুটে যাওয়া। তিনি সেখানে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর প্রতি নিজের সমর্থন ব্যক্ত করেই দায়িত্ব শেষ করেননি। সংবাদ সম্মেলন ডেকে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁর প্রতি নিজের অকুণ্ঠ সংহতিও প্রকাশ করেছেন। তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন হামাসের বিরুদ্ধে এবং ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার অধিকার নিয়ে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন অত্যন্ত তির্যক ভাষায়। অথচ কী করে গাজার নিরীহ মানুষদের বাঁচানো যায়, সে ব্যাপারে তেমন কোনো কথা বলেননি তিনি।
হিলারি ক্লিনটন ও গভর্নর এম কুমো- দুজনই ডেমোক্র্যাট-দলীয় রাজনীতিক। তাঁদের দুজনেরই ২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা রয়েছে। তাই গাজা আক্রমণ-পরবর্তী সময়ে ইসরায়েল সফরে গেলেও তাঁরা কেউ ফিলিস্তিনের কোথাও যাওয়ার কর্মসূচি নেননি। গভর্নর এম কুমো পশ্চিম তীর সফর করার নিমন্ত্রণ নাকচ করে দিয়েছেন। আর হিলারি ক্লিনটন তেল আবিবে অবস্থানকালে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন। তিনি ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও তার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রতি সমর্থন জানানোর পর ইহুদিদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রত্যেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিই তেল আবিব বা জেরুজালেম সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার পেয়েছেন। লন্ডন, প্যারিস, কেপটাউন ও ব্রাজিলের বিভিন্ন নগরীতে গাজা আক্রমণ ও ইসরায়েলের আগ্রাসনবিরোধী বিশাল বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও ওপরে উল্লিখিত নেতাদের কাছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। এ অবস্থায় এঁদের মতো ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের নেতাদের পদলেহনকারীদের কাছে অধিকারবঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত ফিলিস্তিনিরা কি সাহায্য বা সমর্থন আশা করতে পারে? ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কারণে সম্প্রতি নিজ দলীয় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কঠোর সমালোচনা করেছেন হিলারি ক্লিনটন। তিনি বলেছেন, ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কারণেই ইসলামপন্থী জিহাদিরা বর্তমানে এ অবস্থার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের হাত থেকে কুর্দিস্তানের উত্তরাঞ্চলের খ্রিস্টানদের রক্ষা করার জন্য তিনি যতটা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গাজার শিশু ও নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে বাঁচানোর জন্য তিনি ততটাও তাগিদ দেখাননি। জেরুজালেম থেকে প্রকাশিত দৈনিক হারেৎজ পত্রিকা হিলারি ক্লিনটনকে নেতানিয়াহুর শ্রেষ্ঠ উকিল বা প্রতিরক্ষা কেঁৗসুলি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ইতিমধ্যে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ তদন্তের লক্ষ্যে একটি প্যানেল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই প্যানেল গাজায় ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ তদন্ত করে ২০১৫ সালের মার্চের মধ্যে কমিশনের কাছে তাদের রিপোর্ট প্রদান করবে বলে ঠিক করা হয়েছে। তবে ইসরায়েল এরই মধ্যে সে প্রস্তাবিত প্যানেল গঠনের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে। এভাবে এর আগেও, অর্থাৎ ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে গাজায় সংঘটিত তিন সপ্তাহব্যাপী ইসরায়েলি হামলায় যে এক হাজার ৪০০ নিরস্ত্র গাজাবাসী নিহত হয়েছিল, তা পর্যালোচনা করে বিচারপতি গোল্ডস্টোনের নেতৃত্বাধীন কমিশন যে রিপোর্ট দিয়েছিল, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সেটাও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সে রিপোর্ট অনুমোদন না করার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওবামার নির্দেশেই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রদান করেছিল। তা ছাড়া যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলের এতদ্সংক্রান্ত সভায় তাদের ভোটই প্রদান করেনি। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালিসহ কয়েকটি দেশ তার বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। এ অবস্থায় এ ধরনের লোকদেখানো তদন্ত কমিশন বা প্যানেল গঠন করে ফিলিস্তিনিদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মতো নিদারুণ পরিহাস করে তাদের অসহায়ত্ব বাড়িয়ে আর লাভ কী? তার চেয়ে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক আদালতে যাওয়া ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। ফিলিস্তিন জাতিসংঘের একটি অসদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সাধারণ পরিষদের ভোটে কয়েক বছর আগে নির্বাচিত হয়েছে। এ অবস্থায় গাজা প্রশাসন এবং পশ্চিম তীরে অবস্থিত ফিলিস্তিনি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক আদালতের সদস্যপদের জন্য আবেদন করা বাঞ্ছনীয় বলে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। সে ধারায় তাদের প্রয়োজন ফিলিস্তিনের নির্ধারিত ভূমিতে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের বেআইনিভাবে বসতি নির্মাণ, গাজা অবরোধ এবং গাজাবাসীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করার অপরাধের বিচার চাওয়া। সেই বিচার ঠেকানোর অধিকার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কোনো বৃহৎ শক্তি বা কারো নেই। তাতে ফিলিস্তিনিদের হারানো ভূমি ফিরে পাওয়া যেমন সম্ভব হবে, তেমনি মানবতাবিরোধী অপরাধ অথবা যুদ্ধাপরাধেরও ন্যায়সংগত বিচার পেতে পারে তারা। ফলে জাতিসংঘের পরিকল্পিত দুই রাষ্ট্রের ভিত্তিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করাও সম্ভব হবে। নতুবা যুক্তরাষ্ট্রের মিথ্যা আশ্বাস ও ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের ষড়যন্ত্র ও বিভিন্ন চক্রান্তের কারণে তা বছরের পর বছর ঝুলে থাকবে। এবং সে অবস্থায় বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে আরো বহু নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনবাসী প্রাণ হারাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান এ অচলাবস্থায় সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহেই নিউ ইয়র্কে বসবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভা। তাই এখন থেকেই বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষের উচিত হবে ফিলিস্তিনকে তার ন্যায্য অধিকার ও বিচার পাওয়ার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক আদালতে যেতে উৎসাহিত করা। নতুবা ইসরায়েলের ছলচাতুরী কিংবা বৃহৎ শক্তির বিভিন্ন মিথ্যা আশ্বাসে তারা যে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন