|
জসিম উদ্দিন
|
|
প্রেস ফ্রিডমের বিলাসিতা
16 Aug, 2014
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম সরকারি নিবর্তনমূলক আইনের যাঁতাকলে পড়তে যাচ্ছে। সাংবাদিক হত্যা, বল প্রয়োগ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এত দিন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এখন নীতিমালা তৈরির নাম করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করার দিকে হাঁটছে সরকার। নিজেদের হাত-পা বাঁধার কাজটিকে আবার একদল সাংবাদিক বিবৃতি দিয়ে সমর্থন করলেন। বাংলাদেশে যে অগণতান্ত্রিক ও সর্বাত্মকবাদী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে এর জন্য সাংবাদিকদের অনৈক্য একটি প্রধান কারণ। পতিত বিশৃঙ্খল ভেঙেপড়া রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশী সাংবাদিকেরা পাকিস্তানের নাম নিতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সেই পাকিস্তানে সাংবাদিকেরা নিজেদের অধিকার রক্ষায় সবাই এখন এক মঞ্চে এসেছেন। দেশটিতে এখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারও রয়েছে। অন্য দিকে বাংলাদেশে ঠিক এর বিপরীত অবস্থা বিরাজ করছে।
সমাজকল্যাণের ধারণা বদলে দেয়া মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর সাম্প্রতিক উত্থান সেই ধারাবাহিকতার অংশ। একটি মফস্বল শহরের মেয়রের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নিয়ে হঠাৎ করে মন্ত্রী হয়ে টাল সামলাতে পারছেন না তিনি। মঞ্চে ঘুমিয়ে ইতোমধ্যে তিনি সদ্য সাবেক মন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর ও সাহারা খাতুনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। ঘুম নিয়ে তিনি উচ্চমার্গের ব্যাখ্যা দিয়ে হাসি ঠাট্টার নতুন ব্যঞ্জনা যোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনারা মঞ্চে আমার চোখ বন্ধ অবস্থায় ছবি তুলে পত্রিকায় প্রকাশ করেন, আমি ঘুমাই। আমি মঞ্চে আসলে ঘুমাই না, চোখ বন্ধ করে চিন্তা করি দেশ ও মানুষের জন্য কী করতে হবে।’ মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে শ্রমিকদের সমাবেশে এমন বক্তব্য দেয়ার দুইদিন পর তিনি নিজেই নিজের বক্তব্যকে মিথ্য প্রমাণ করে দেখান।
আদিবাসী দিবস উপলক্ষে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে স্মরণকালের সেই বক্তব্যটি তিনি রাখেন। এর আগে মঞ্চে অশ্লীল গালিগালাজের এমন চর্চা কেউ কোনো দিন দেখেনি। মাইক হাতে নিয়ে প্রথমেই সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের ঠিক করতে নীতিমালা হয়েছে। ওই দিন ক্যাবিনেট মিটিংয়ে আমি থাকলে সাংবাদিকদের... (অকথ্য শব্দ) দিয়ে বাঁশ ঢুকাতাম। সাংবাদিকদের এখন এমনভাবে ঠিক করা হবে, যাতে নিজের স্ত্রীকে পাশে নিয়েও শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। সাংবাদিকেরা বদমায়েশ, চরিত্রহীন, খবিশ ও লম্পট।’ মহসিন আলীর অশ্লীল বাক্যবাণের পরও এ নীতিমালার পক্ষে বিবৃতিদাতা সাংবাদিকেরা তা প্রত্যাহার করেননি। এ সাংবাদিকেরা সাধারণভাবে মহসিন আলীর অশ্লীল বক্তব্যের সমালোচনা করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন।
তার উন্মাতাল বক্তব্যে উপস্থিত মহিলা সংসদ সদস্য কেয়া চৌধুরী ও সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী হতবাক হয়ে যান। তারা তাৎক্ষণিক সাংবাদিকদের কাছে করজোড়ে মাফ চান। অন্য দিকে অচেতন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী তার অশ্লীল বক্তব্য চালিয়ে যান। তার বক্তৃতার উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি ছিল প্রধানমন্ত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করা। মহসিন আলী বলেন, শেখ হাসিনা আমাকে ডেকে বলেছেন, হাসানুল হক ইনু ১৪ দলের নেতা, আর তুমি আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা। সাংবাদিকেরা যা ইচ্ছে লেখুক, তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি চালিয়ে যাও। প্রধানন্ত্রীকে কোট করে চাতুর্যের সাথে এমন কথা বললেন যার মাধ্যমে এক দিকে নিজেকে সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর পর্যায়ে টেনে তুললেন, অন্য দিকে নিজের অশ্লীল বক্তব্যকে জায়েজ করে নিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেননি এমন একটি মিথ্যা তিনি অবলীলায় চালিয়ে দিলেন। একজন মন্ত্রী যাবতীয় গোপনীয়তা রক্ষা করে দেশের স্বার্থে কাজ করবেন বলে শপথ নেন। তিনি কিভাবে অবলীলায় খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামে মিথ্যা বলে দিতে পারেন। তার সততা ও নিষ্ঠা বলে কিছু থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। মন্ত্রীর এ ধরনের অশ্লীল কথাবার্তার প্রতিবাদ জানিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ওই মন্ত্রী যেসব অগ্রহণযোগ্য তথ্য দিয়েছেন, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেবেন। অসততার দায়ে মহসিন আলী বরখাস্ত হলে দেশবাসীর মনে সন্দেহের অবকাশ থাকবে না যে, প্রধানমন্ত্রী এমন অশ্লীল কথাবার্তা বলার সার্টিফিকেট তাকে দিতে পারেন। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মহসিন আলীকে মৃদু ভর্ৎসনা করেছেন। কেন তাকে মিস কোট করা হলো এ ব্যাপারে কোনো কৈফিয়ত প্রধানমন্ত্রী তার কাছে চেয়েছেন কি না তা জানা যায়নি। সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর প্রত্যাশা পূরণ হলো না। নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারের পর ওই জেলার গডফাদার শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রধানমন্ত্রী ওই সময় সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারের অবদানের স্বীকৃতি দেন এবং এ পরিবারের পক্ষে অবস্থান নেয়ার আশ্বাস দেন। অবশ্য মহসিন আলী বলেছেন, তিনি মন্ত্রিত্বের পরোয়া করেন না। মন্ত্রিত্ব থাকলেই কী, আর না থাকলেই কী? জনগণ আমাকে ভালোবাসে, আমিও জনগণের ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে চাই। প্রধানমন্ত্রী তাকে পদচ্যুত করলে তার পক্ষ থেকে হতাশ বা ুব্ধ হওয়ারও কোনো আশঙ্কা ছিল না।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো সাংবাদিকদের তিনি চরম অপছন্দ করলেও নিজের মেয়েকে সাংবাদিকতাই পড়িয়েছেন। মানুষের মধ্যে এমন দ্বৈতচরিত্র বিরল। মন্ত্রী এ নিয়ে গর্বও করেছেন যে, তার মেয়ে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স। কোনো কোনো পত্রিকা তার মেয়েই ‘সাংবাদিকতায় একমাত্র মাস্টার্স’ বলে তার বক্তব্য কোট করেছে। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স অর্জন করা দেশের শত শত নাগরিক আহত হতে পারেন। মহসিন আলী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ পড়েছেন সেই প্রশ্ন সাংবাদিকেরা তাকে ছুড়ে দেননি। অন্য দিকে ঢালাওভাবে সব সাংবাদিকের ব্যাপারে তার মন্তব্য, ‘অল্পশিতি আর যারা পত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে লেখালেখি করে তারা দুই-এক কলম পড়ালেখা করেছে।’ মঞ্চে চোখ বন্ধ করে (পত্রিকার সাংবাদিকেরা যাকে ঘুমিয়ে পড়া লিখেছেন) মহসিন আলী যে দেশ জাতি নিয়ে ভাবেন না এটা তার বক্তব্যেই মিথ্যা প্রমাণ হলো। এমনটি ভাবলে জাতির বর্তমান অবস্থায় তিনি দিশেহারা হতেন। তাকে উসকে দেয়া সাংবাদিকদের ব্যাপারে একটি বাক্য ব্যয় করার সময়ও তার হতো না। তবে তিনি যে সাংবাদিকদের নিয়ে ভেবেছেন তা নিশ্চতভাবে বলা যায়। তাদের ক্ষেত্রে কী কী অশ্রাব্য শব্দচয়ন করবেন সেটাও আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন। মঞ্চে বসে চোখ বন্ধ করে এমন ভাবতে হবে এটা কোনো শর্ত নয়। গাড়িতে বসে কিংবা কোনো এক অবসরে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার জন্য অশ্লীল শব্দগুলোকে ভাঁজ করে হয়তো তুলে রেখেছিলেন।
মিডিয়ার প্রতি মহসিন আলীর অশ্লীল তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ক্ষমতাসীনদের চূড়ান্ত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। এ চরম আক্রমণ এক দিনে হঠাৎ করে এ পর্যায়ে আসেনি। দীর্ঘ দিনের ধারাবাহিক আক্রমণের চূড়ান্ত রূপ এটি। এই মন্ত্রী আরো কয়েকটি বখাটে মন্তব্য করেছিলেন এর আগে। সেগুলো এতটা চরম পর্যায়ের ছিল না। তবে সম্ভবত সেগুলো ছিল পরীক্ষামূলক। ওই সব বক্তব্য দিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাংবাদিকদের ওপর অসভ্য আক্রমণ চালালে কিছুই হবে না। একটি কমন ডায়ালগ তো এমন আছে, ‘সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না’। পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা এ চর্চা অনেক দিন ধরে জারি রেখেছে। সংবাদমাধ্যম ও পেশাদার সাংবাদিকদের প্রতি ক্ষমতাসীনদের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রতিবাদ জানাচ্ছে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ।
সাংবাদিক সমাজের পেশাদারিত্বের অভাব ও দলবাজি এ করুণ পরিণতির প্রধান কারণ। সাগর-রুনির মতো তারকা সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়নি। একজন সম্পাদককে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছে। সাংবাদিক নেতাদের অনেকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন সেই সম্পাদক নির্যাতনকে। অনেকে সেই সময় পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে সরকারের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
ভোটাধিকারের আন্দোলনকে জঙ্গিবাদ মৌলবাদের খোলসে ঢুকিয়ে দমিয়ে দেয়ার পেছনে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের অবদান রয়েছে। আন্দোলন দমিয়ে ভোটারবিহীন নির্বাচনের আয়োজন করার পেছনে সাংবাদিকদের বৃহত্তর অংশের জোরালো সমর্থন ছিল। তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সরকার সম্প্রচার নীতিমালার নামে মতপ্রকাশের ওপর টুঁটি চেপে ধরার আয়োজন করছে। মহসিন আলী অশ্লীল বক্তৃতায় যে হুমকি দিয়েছেন তার মূল বিষয় ছিল ওই নীতিমালা। সরকারের ধামাধরা সাংবাদিকদের কেউ কেউ সরকারের এ নীতিমালার সমালোচনা করছেন। সর্বাত্মকবাদীরা এখন সরকার সমর্থক এ সাংবাদিকদেরও সহ্য করতে পারছে না।
কিংবদন্তির সাংবাদিক আবদুস সালাম পাকিস্তান সরকারের চাকুরে ছিলেন। ডেপুটি অডিটর জেনারেল থেকে এসে সংবাদপত্রের সম্পাদক হন। দেশের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি ছিল প্রশ্নাতীত। ন্যায়ের পথে অবস্থান নিতে গিয়ে দুইবার তিনি কারাগারে যান। সম্পাদক হতে তার সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার লাগেনি। একজন অসাংবাদিক বাংলাদেশের মিডিয়াকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। সবাই তার আপসহীনতা ও সততাকে প্রশংসার চোখে দেখেছে। সেখানে কেউ রাজনীতির রঙ লাগাতে পারেনি। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ নিয়ে কেউ সেদিন আবদুস সালামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি।
মাহমুদুর রহমান আমার দেশের সাংবাদিকদের দুর্দিনে পত্রিকাটির হাল ধরেন। সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন। সম্পাদক হওয়ার আগে তিনি একটি উচ্চ অসাংবাদিক ক্যারিয়ার রেখে এসেছেন। সাংবাদিকতা করতে এসেও তিনি সত্য প্রকাশে নিষ্ঠার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে লেখনীর মাধ্যমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলে তার চরম পরিণাম নাগরিক সমাজ দেখেছে। সম্পাদক হয়েও রিমান্ডে নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সাংবাদিক কমিউনিটি শক্ত করে তার পক্ষে দাঁড়ায়নি। উল্টো সাংবাদিক নেতাদের একটি অংশ ঘোরতরভাবে তার বিরুদ্ধে নেমেছিল। কেউ কেউ অন্তরালে থেকে তাকে গ্রেফতার করে সরকারি হেফাজতে নেয়ার নানা কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে সরকারকে।
মাহমুদুর রহমানকে প্রথমবার আটক করার পর একটা বিবৃতি দিতে সম্পাদকেরা ৪০ দিন সময় নিয়েছিলেন। বিলম্ব বিবৃতির পর সম্পাদক পরিষদের নেতা আত্মপক্ষ সমর্থন করে ‘কৈফিয়ত নয়’ বলে সাফাই ছাপছেন বড় করে নিজ পত্রিকায়। এর মাধ্যমে তিনি সেই বিবৃতি থেকে আলাদা করে নিজেকে সরিয়ে সরকারের সমান্তরাল অবস্থানে নিয়ে যান। কৈফিয়তে এমন ভাষা ও যুক্তি প্রয়োগ করা হলো যাতে পরস্পর বিরোধিতা ছিল। এর গুঢ়ার্থ দাঁড়াল, ওই সম্পাদক গোষ্ঠীগতভাবে অন্যায়ের সমর্থক; কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এর বিপক্ষে। শাপলা চত্বরে জমায়েত হওয়া হেফাজতের লাখ লাখ সদস্যকে ‘দুর্বৃত্ত’ আখ্যা দিলেন তিনি। অথচ যেখান থেকে সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেয়া হয়েছে। সঙ্কীর্ণ ওই সব স্লোগানের ফলে দাঙ্গা বাধার উপক্রম হয়েছিল। সম্পাদক সেই ‘গণজাগরণ’ মঞ্চকে উচ্চ প্রশংসা করেছেন। আমার দেশের সাংবাদিকতাকে ‘অসাংবাদিকতা’ ও ‘অপপ্রচার’ বলে অভিহিত করেছেন।
বন্ধ হয়ে যাওযা টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উসকানির অভিযোগ এনে তিনি নিজ থেকেই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের চ্যানেল দু’টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। ওই রাতেই দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়। আমার দেশের মতোই দু’টি টেলিভিশনের ব্যাপারেও ওই সম্পাদকের ঢালাও অভিযোগ সীমাবদ্ধ রয়েছে কিছু শব্দচয়নের মধ্যে। এ ধরনের ধারণাগত শব্দ প্রয়োগ না করে নিজ পত্রিকায় ‘সাম্প্রদায়িক উসকানি’ ‘অসাংবাদিকতা’ ও ‘অপপ্রচারের’ মুখোশ কেন তিনি উন্মোচন করে দেননি? সংবাদ প্রচারে এসব মিডিয়া কোন আইন ভঙ্গ করেছে সেটা তিনি সুনির্দিষ্ট করে বলছেন না।
অন্য এক শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক তখন সরকারের দমনপীড়নের শিকার সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে শাণিত কলম চালালেন। বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকাকে তিনি প্রচারপত্র বলে উপস্থাপন করলেন। মিথ্যা ও হলুদ সাংবাদিকতা করেই পত্রিকাটি হটকেক হয়েছিল বলে গল্প উপস্থাপন করে জানালেন। অবশ্য তিনি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক মার্জিত ছিলেন এমনকি তিনি পত্রিকাটির নামও ধরেননি। ২৫টি টিভি চ্যানেল জাতীয় দৈনিকসহ আরো অসংখ্য প্রকাশনা থাকতে কিভাবে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হলো সে প্রমাণ উপস্থাপন করলেন না ‘কৈফিয়ত নয়’- এর লেখক সম্পাদকের মতো।
উনাদের বক্তব্যে প্রভাবিত না হলে দৈনিক আমার দেশের ক্ষেত্রে আমরা ব্যতিক্রমী ঘটনাই দেখব। পত্রিকাটির দাম ও প্রচারসংখ্যা অর্থনীতির সব তত্ত্বকে ব্যর্থ করে একসাথে বেড়ে গিয়েছিল। পত্রিকাটির কাগজের মান ছিল গড় মানের চেয়ে খারাপ, অন্য পত্রিকা যেখানে ২৪ পৃষ্ঠা সেখানে তারা দিচ্ছিল ১৬ পৃষ্ঠা, ভাষার মাধুর্য এবং পৃষ্ঠাসজ্জার মানদণ্ডে এটি অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল বিষয়টি এমন ছিল না। তাহলে কোন জিনিস পত্রিকাটিকে হটকেক করেছিল। কেন পাঠকেরা উঁচু দাম বিবেচনায় নিচ্ছিল না। বাংলাদেশের মিডিয়ার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হওয়া শব্দ ‘নতজানু’ ‘স্বাধীনতা’ কি এর কারণ?
বাংলাদেশের মিডিয়া কি সত্য জানাতে ব্যর্থ হচ্ছে? পাঠক বেপরোয়া হয়ে কি সেই আসল ঘটনা জানতে চেয়েছে? সে জন্যই কি তারা কাগজের মান, পৃষ্ঠাসংখ্যা, পৃষ্ঠাসজ্জা ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি? একটি সত্য ঘটনা জানার জন্যই কি ১২ টাকা ব্যয় তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি? সম্ভবত পাঠকের এ চাহিদা মেটাতে গিয়ে পত্রিকাটি ও এর সম্পাদককে এক অসম লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল। তার পরিণাম ভোগ করছেন সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও আমার দেশ পরিবার।
তিনি লিখেছেন, ‘সংবাদপত্রের ডিকারেশন বা টেলিভিশনের লাইসেন্স নেয়ার আবেদনে এক একজন মালিক সরকারের কাছে ‘আপনার বিশ্বস্ত’ বলে সব শর্ত মেনে নেয়ার মুচলেকা দেবেন আর লাইসেন্সটি পাওয়ার পর পরই মাথায় স্বাধীনতার শিং গজাবে? যে পণ্য বিক্রির জন্য লাইসেন্স নেয়া হলো দোকান খুলে, সেখানে লাইসেন্সের শর্ত ভেঙে ভিন্ন পণ্য বিক্রি করলে এবং এর পরিণতিতে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে তার দায় কে নেবে।’ সরকারের বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রকাশ করাকে কেউ ‘স্বাধীনতার শিং’ বলতে চানÑ এটা আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মিডিয়াকে দোকানের সাথে তুলনা করাকে হয়তো তিনি নিজেও পছন্দ করবেন না। ঢালাওভাবে তো সম্মানিত সম্পাদক ‘কৈফিয়ত নয়’ কলামে লিখেছেন। প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন পণ্য কী বিক্রি করেছেন সুনির্দিষ্টভাবে না উল্লেখ করে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলা কতটা যৌক্তিক। সরকার কিন্তু আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মিডিয়া বন্ধ করেনি। তাহলে লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গের যে কথা তারা বলছেন তা কিভাবে প্রমাণ হলো।
মিডিয়ার বড় একটি অংশ গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ায়নি। এই সরকারের শুরুটা হয়েছিল নাশকতা ও তাণ্ডব দমনের নামে। সরকারের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগকে এ মিডিয়া দেখেছে ‘জামায়াত-শিবির’ দমন হিসেবে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ না হলেও মহাজোট সরকার এ দলটির প্রতি একটি নিষিদ্ধ দলের মতোই আচরণ করে আসছে। তাদের অফিসে আক্রমণ করে নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে গেছে পাইকারি হারে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের অফিস সিলগালা করে দিয়েছে। ধর্মীয় বইপুস্তক যার হাতে পেয়েছে ‘জিহাদি’ বই রাখার অপরাধে তাকেই গ্রেফতার করেছে। অথচ এসব বই সরকার নিষিদ্ধ করেনি। দলটির সাথে সম্পর্ক রয়েছে এমন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে বন্ধ করে দিয়েছে তারা। এসব করার সময় মানুষের রুটি-রুজি তথা অর্থনৈতিক দিকটি বিবেচনায় নিতে চায়নি সরকার। বাংলাদেশের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম এ খবর এড়িয়ে গেছে অন্যায়ভাবে বা কখনো পুলিশের সাথে ‘জিহাদি’ ও ‘নাশকতার’ তত্ত্বে সুর মিলিয়েছে।
সরকারি এসব বেআইনি পদক্ষেপের প্রতিবাদে সমাবেশ করতে চাইলে দলটিকে অনুমতি দেয়া হয়নি। সংবাদমাধ্যম তখন চুপ রইল। তারা যখন বিুব্ধ হয়ে রাস্তায় মিছিল বের করার চেষ্টা করেছে তখন টিয়ার শেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে তা পণ্ড করেছে পুলিশ। যাকে যেখানে পেয়েছে নির্যাতন চালিয়েছে, গ্রেফতার করে বাণিজ্য (ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে উৎকোচ গ্রহণ) করেছে। আশকারা পেয়ে পুলিশ আরো বেপরোয়া হয়ে সরাসরি গুলি চালাল। শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করল। কিভাবে মিছিলে আক্রমণ করা হলো; তাজা বুলেট ছোড়া হলো মিডিয়া সেসব খবর গায়েব করে দিলো। মিডিয়ায় খবরের মর্যাদা পেল যখন জামায়াত-শিবির ঢিল ছুড়তে শুরু করল। কখনো বা ক্ষোভের আতিশয্যে পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো তারা বা পাবলিক যানবাহনে আক্রমণ করল। ঘটনার পেছনের দিকটি সম্পর্কে পাঠককে অন্ধকারে রেখে প্রতিক্রিয়াকে বাড়িয়ে দেখাল মিডিয়া। এটি তখন মিডিয়ার ভাষায় ‘তাণ্ডব’।
গুলি ছুড়ে বিক্ষোভ দমনকে এ মিডিয়া জায়েজ করে দিয়েছে। এই সুযোগকে সরকার কাজে লাগিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিঃশেষ করার কাজে। তার পরিণাম এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একটি দোয়া মাহফিল নাশকতার অভিযোগে পুলিশ পণ্ড করে দিয়েছে। দলটি প্রকাশ্যে তাদের কেন্দ্রীয় অফিসে কর্মসূচি পালন করতে পারেনি কয়েকবার। বাধ্য হয়ে গোপনে তাদের কার্যক্রম চালাতেও দেখা গেছে। মিডিয়া সরকারের অন্যায়ের বিরদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে পারে না। তারা কেবল তথ্য-উপাত্ত ও মন্তব্য করে সব পক্ষকে সহযোগিতা করতে পারে; কিন্তু সেই সহযোগিতা তারা আগেই বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি দমনে সরকারকে করেছে। এখন মাঠে একতরফাভাবে সরকার ও শাসকগোষ্ঠী। মিডিয়াকেও দেখা যাচ্ছে দুর্বল। সাংবাদিক খুন, সম্পাদক আটক, রিমান্ডে নির্যাতন, পত্রিকা বন্ধ সম্পাদকদের হুমকির বিরুদ্ধে বিরোধী দল শক্ত করে কোনো অবস্থান নিতে পারেনি। প্রশ্নও আসে না; কারণ বিরোধী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা নিজেরাই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এখন এই কথা স্পষ্ট কোনো পক্ষ জয়ী হতে পারছে না। বরং সবাই মিলে একসাথে পরাজয় ও ব্যর্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র গভীর খাদের কিনারে। ‘নতজানু’ থেকে ‘কেবল বাঁচিয়া থাকা’ এখন সাংবাদিকদের জীবনের পরিণতি হতে চলেছে। মার খাওয়া সম্পাদক কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়া চ্যানেলের বিরুদ্ধে বলার জন্য সাহসিকতার প্রয়োজন হয় না। সাহসিকতার প্রয়োজন একটি অগণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের অন্যায় রুখে দেয়ার জন্য। মহসিন আলীরা যে আক্রমণের সূচনা করেছেন সেটা প্রতিরোধের জন্য কতটা শক্তি প্রদর্শন করতে পারেন এ সাংবাদিকেরা সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন