বেশ কিছু দিন হলো এক শ্রেণির গণমাধ্যমে ফলাও করে বলা হচ্ছিল, সরকার সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে আইন পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিছু কাগজ তাদের পাঠকদের প্রায় খোলাখুলিই জানিয়ে দিয়েছে, সরকারের 'অপকর্ম' ও 'অগণতান্ত্রিক আচরণ' সম্পর্কে কেউ যেন লিখতে না পারে, সে কারণেই ১৯৭৩ সালের 'দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট' পরিবর্তন করা হচ্ছে। সরকারবিরোধী বিভিন্ন গোপন ও প্রকাশ্য রাজনৈতিক মহল এ-ও বলে দিয়েছে যে শেখ হাসিনার সরকার নতুন 'বাকশাল' কায়েম করতে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনটি হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
বাংলাদেশ এখন আর সত্তর বা আশির দশকে নেই যে জে. জিয়াউর রহমান বা জে. এরশাদ যেভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর 'স্টিমরোলার' চালাতেন, আজ তা করা সম্ভব। পিআইডির সেদিনকার কর্মকর্তা বন্ধুবর হারুন-অর-রশিদসহ এখনো অনেকেই আছেন, যাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারবেন কিভাবে 'প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট' থেকে পত্রপত্রিকার অফিসে প্রতি রাতে 'প্রেস অ্যাডভাইস', অর্থাৎ কী ছাপা যাবে, কী যাবে না, নির্দেশিত হতো। বন্ধুবর হারুন তো বেশিই বলতে পারবেন। কারণ সেদিনকার অন্যতম জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর ওপরেই প্রতি রাতে পত্রপত্রিকার 'নিউজরুমে' টেলিফোনে সরকারি 'সেন্সর' পৌঁছানোর দায়িত্বটি চাপানো হয়েছিল। এতে কতটা মর্মযাতনায় ভুগতেন তিনি, তার কিছুটা হলেও আমি জানি।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সেই রাজনীতির বা সেই সময়ের কট্টর অনুসারীরা আজ যখন 'প্রেস ফ্রিডম' নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেন, তখন সত্যিই দুঃখ হয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সরকারের সমালোচনা হবে, সরকারবিরোধীরা সরকারকে তুলাধোনা করবে- হোক না। কিন্তু অন্তত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্নে সমালোচনা করার আগে নিজেদের অতীতটাও একবার দেখে নেওয়া উচিত।
চার যুগ সংবাদমাধ্যমে কাটিয়েছি। সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালনের পরও আজও আমি 'রিপোর্টার'। কারণ এতে আমার তৃপ্তি আছে। দেশের ঘটনাবলি নিয়ে 'রিপোর্ট', বিশ্লেষণ ইত্যাদি এখনো লিখি। এসব কারণে বলতেই পারি, যত জনপ্রিয় ও শক্তিধর সরকারই হোক না কেন, এ যুগে কোনো সরকার যদি গণমাধ্যম বা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে চায়, তা করা সম্ভব হবে না; বরং এমন কাজ করতে গেলে সরকার বিপাকে পড়বে।
স্বাধীন গণমাধ্যম বনাম স্বেচ্ছাচারী গণমাধ্যম
বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি গণতন্ত্র থাকে, সংবিধান থাকে, তাহলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিকল্প কিছু নেই। কাজেই আমি নিশ্চিত যে বর্তমান সরকার কখনোই কোনো স্তাবককুলের কুপরামর্শে এমন কোনো আইন করতে যাবে না, যা গণমাধ্যমের স্বাধীন চর্চায় বাধার সৃষ্টি করে। এটিও কখনো ভাবা ঠিক হবে না যে সরকারবিরোধী 'বেয়ারা' পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কেবলই সরকার প্রশস্তি করতে বাধ্য হবে। সরকারকে গণমাধ্যমের সমালোচনা, শক্ত সমালোচনা সইবার সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করতে হবে, কিছু কিছু মন্ত্রীসাহেবের বক্তব্য উপস্থাপনে আরো পরিশীলিত হতে হবে। কারণ গণতন্ত্রে এর বিকল্প নেই।
দেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যপ্তি এখন বিশাল। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে বেসরকারি টেলিভিশন চালু করার ঐতিহাসিক উদ্যোগ নিয়েছিল, সেখান থেকেই বেসরকারি খাতে সম্প্রচারমাধ্যমের নতুন যুগের সূচনা। কাজেই এই বিশাল মাধ্যমটি সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য একটি নীতিমালা অবশ্যই জরুরি। এই মাধ্যমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও চ্যানেলগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে স্বাধীন একটি সম্প্রচার কমিশন দাবি করেছেন। কিন্তু কমিশন গঠনের আগেই 'জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা' মন্ত্রিসভার বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে, গেজেটও হয়েছে। সমালোচনা সেখানেই বেশি। আশা করি, সরকার দ্রুত একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করবে, যাতে সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন না হয়, একই সঙ্গে কেউ পরিকল্পিতভাবে স্বেচ্ছাচারিতাও করতে না পারে। এর জন্য দরকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা।
বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে নীতিমালা নিয়ে। এসবের জবাব দিতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, 'কণ্ঠরোধের' জন্য নয়, নীতিমালা করা হয়েছে গণমাধ্যমের 'কল্যাণের' জন্য। মন্ত্রীর কথায় আরো একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। তিনি বলেছেন, সম্প্রচার নীতিমালা দিকনির্দেশনামূলক, কোনো আইন নয়। এতে শাস্তিরও কোনো বিধান নেই। ভালো লেগেছে যে তিনি আরো বলেছেন, নীতিমালার আওতায় আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সম্প্রচার কমিশন গঠন করা হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের ও সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কাজেই গণমাধ্যম কী প্রচার করবে, কী প্রচার করবে না, তা সরকার বা তথ্য মন্ত্রণালয় বলে দিতে পারে না। যদি কখনো তা ঘটে তা গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু প্রশ্ন থাকে যে গণমাধ্যম বা মিডিয়া কি যা ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা, তাই প্রচার করার অধিকার রাখে? প্রশ্ন আরো আছে, গণমাধ্যমের দায় বা দায়িত্ব বলে কি কিছু থাকতে নেই? সে কারণে সব স্বাধীন সমাজেই যুক্তিসংগত বা আইনসিদ্ধ নিয়ন্ত্রণ, মূল্যবোধের নিয়ন্ত্রণ, পেশাগত দায়বদ্ধতার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তবে নিয়ন্ত্রণটি সরকার কর্তৃক একপেশে আরোপিত হলে তা কার্যকর হয় না।
অনুমোদিত নীতিমালায় বিচারিক ক্ষমতা আছে- এমন সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়- এমন ছবি ও বক্তব্য প্রচার করা যাবে না বলা হয়েছে। ব্যাপারটা বোধগম্য নয়। এতে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা অবমাননাকর দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার না করার কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কোনো সদস্য যদি বেআইনি কিছু করে বসেন, তা যদি গণমাধ্যম প্রচার করে, তাহলেও কি গণমাধ্যম অপরাধ করবে? তবে ব্যক্তির অপরাধ প্রতিষ্ঠানের অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। এর পরও বলি, এসব নীতি অবশ্যই পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
নীতিমালায় আছে, আলোচনামূলক অনুষ্ঠান, অর্থাৎ 'টক শো'গুলোতে বিভ্রান্তিমূলক ও অসত্য তথ্য পরিহার করতে হবে। সব পক্ষের যুক্তি যথাযথভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে। তাই তো হওয়া উচিত। বাংলাদেশ বহুমাত্রিক দেশ, এতেই গণতন্ত্র। কিন্তু যে যে দলেরই অনুসারী হোন না কেন, এটিও কি বলা সংগত হবে না যে কিছু কিছু টিভি চ্যানেল রীতিমতো পরিকল্পিতভাবে একপক্ষীয় বিষোদ্গার করে থাকে? স্বভাবতই এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, প্রতারিত হয়, রাগান্বিতও হয়। তবে আইন চাপিয়ে এসব ক্ষেত্রে লাভ বেশি হয় না; বরং প্রতিক্রিয়া হয়। আমার বিশ্বাস, এসব দলীয় প্রচারণার গণমাধ্যম জনপ্রিয়তা হারাতে বাধ্য। কারণ মানুষ ভালো-মন্দ বিচার করার সামর্থ্য রাখে।
নীতিমালায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এমন তথ্য প্রচার করা যাবে না বলা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, সাংবাদিকতায় ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি বেশ তর্কসাপেক্ষ। এসব ক্ষেত্রে সরকারের আরোপিত বিবেচনা আগে তেমন গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে বিতর্কের জন্ম হয়েছে। বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে।
সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচারে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও নীতিমালা সমুন্নত রাখার বিষয়টি নীতিমালার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বলা হয়েছে, জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে- এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও হিংসাত্মক ঘটনা প্রদর্শন করা যাবে না। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত করতে পারে- এমন ধরনের অনুষ্ঠান বা বক্তব্য প্রচার থেকেও বিরত থাকতে হবে। বলা হয়েছে, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি, জাতির পিতার জন্মদিন, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, জাতীয় শোক দিবসসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো যথাযথভাবে প্রচার করতে হবে।
কোনো সরকার যদি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ বা নিছক একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এসব বিধি প্রয়োগ করে, তাহলে নিশ্চয়ই তা সমালোচিত হওয়ার যোগ্য। কিন্তু উল্লিখিত নীতিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার সুযোগ কোথায়? বেশির ভাগ গণমাধ্যম নিজেদের উদ্যোগেই এসবের দিকে নজর রাখে। যারা রাখে না তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে কাজ করে, ভাবার কারণ নেই!
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় স্বাধীনতা, মৌল জাতীয় বিষয় কখনো দলীয় রাজনীতির বিষয় নয়। বাঙালি জাতি ও রাষ্ট্রের গৌরব ও অস্তিত্ব- এসব। কাজেই স্বাধীনতার ইতিহাস, জাতীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ চালানোর স্বাধীনতা হতে পারে না। এমন অধিকার কোনো দায়িত্বশীল গণমাধ্যম ভোগ করতে পারে না।
বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়, বর্ণ বা মতাবলম্বীদের মধ্যে বিদ্বেষ বা বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে- এমন দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না বলেও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে এমন ধরনের প্রচারণা, যা বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে বিরোধের বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে অথবা বন্ধুভাবাপন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন ধরনের প্রচারণা, যার ফলে সেই রাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে- এমন দৃশ্য বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। এ ধরনের নীতি ভারতসহ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও আছে। দুর্নীতিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহ দেয়- এমন ধরনের অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপন দেশের প্রচলিত আইন, রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
আমি মনে করি না যে এসবে সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীন পথচলায় বড় কোনো হেরফের হবে। হবে তখনই, যদি কোনো সরকার নীতিগুলোকে বিশেষ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো গণমাধ্যম যদি পরিকল্পিতভাবে সংঘাত সৃষ্টি করতে চায়, কোন্দল-সহিংসতা বাধিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়, তখন রাষ্ট্র বা সমাজ কী করবে?
একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে জন্ম লাভ করেছে বাংলাদেশ। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধীরা আজ সংঘবদ্ধ। সাম্প্রতিক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তারা যেকোনো অবলম্বনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে পরাজিত করে ১৯৭১ সাল-পূর্ববর্তী রাজনীতির পুনর্জাগরণ নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কিছু গণমাধ্যম রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার সব ধরনের অপকৌশল অবলম্বন করে চলেছে। ধর্মে, গোত্রে, মানুষে মানুষে তারা সংঘাত উস্কে দিচ্ছে, ধর্মের অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করছে, সন্ত্রাসে উদ্বুদ্ধ করছে, সংঘাতে প্রলুব্ধ করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো গণমাধ্যম কি স্বাধীনতার নামে এসব অপতৎপরতা চালানোর অধিকার রাখে?
গণমাধ্যম সরকারের ইচ্ছামতো চলবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। গণমাধ্যমকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হবে, সেই সঙ্গে তার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনও আশা করবে সবাই। সে দায়িত্বশীলতা সরকারের আরোপিত হওয়ার চেয়ে গণমাধ্যমের নিজস্ব দায়বদ্ধতায় প্রতিপালিত হলেই ভালো। কথা থাকেই, পরিকল্পিতভাবে যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের মৌল নীতির বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রকে বিপদগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে, ধর্মে ধর্মে, গোত্রে গোত্রে, পরিকল্পিতভাবে সংঘাত বাধানোর প্রয়াস হয়, তাহলে জাতীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্র কী করবে?
অতীতের সরকারগুলো বিরুদ্ধমতের গণমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে। এর জন্য একটি আইন ছিল। বলাই বাহুল্য, আইনটি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে বহুবার। জে. এরশাদের পতনের পর সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার 'প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস' অর্ডিন্যান্সের প্রকাশনা বাতিল সংক্রান্তু ধারাটি বাতিল করে।
সম্ভবত দিনটি ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। সেদিনই সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ পদত্যাগ করেন। এরপর এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করার পর নয়া উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগপ্রাপ্ত হন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন। একজন রিপোর্টার হিসেবে ঐতিহাসিক সে দৃশ্য দেখার সুযোগ হয় আমার। সেদিনকার রাষ্ট্রপতির প্রেস সেক্রেটারি তোয়াব খান ফোনে জানালেন দ্রুত পৌঁছতে। গিয়ে সংবাদ সংস্থা বাসসের বরাতে যে খরবরটি আমি প্রথম প্রচার করেছিলাম, তা সংবাদপত্র নিষিদ্ধসংক্রান্ত বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিশেষ বিধানটি রহিতকরণের। বলাই বাহুল্য, এটি ছিল দেশের গণমাধ্যমকর্মীদের দীর্ঘ আন্দোলনের বিজয়।
'দুর্বল গণভিত্তির সরকারই মিডিয়া নিয়ে বেশি আতঙ্কে ভোগে। টক শো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক সমালোচনা, সংবাদপত্রের প্রকাশনা বাতিলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ আর মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে মন্ত্রীদের উষ্মা সরকারের দুর্বলতা ও অপরিপক্বতার প্রকাশ।'- মন্তব্যটি আমার নয়, সামাজিক মাধ্যমে একজনের প্রতিক্রিয়া।
আমি সর্বতোভাবেই বিশ্বাস করি, বর্তমান সরকার দুর্বল গণভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের বিপক্ষে দাঁড়ানোর যে ব্যাপক জনগোষ্ঠী আছে, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারাই এ সরকারের জনভিত্তি। এ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদীদের, পাকিস্তানপন্থী জঙ্গিবাদীদের প্রতিরোধে বদ্ধপরিকর।
এর পরও বলি, গণতান্ত্রিক সমাজে সমালোচনা, অতি-শক্ত সমালোচনা না সইবার বিকল্প নেই। প্রয়োজন শুধু এসব অপপ্রচারের উপযুক্ত জবাব দেওয়ার উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণ। সরকার কতটা তা করতে পারছে, তা তারাই ভালো বুঝবে।
লেখক : সাংবাদিক, লেখক ও মিডিয়া বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন