ঈদের ছুটির ভেতর সংবাদপত্রশূন্য বাংলাদেশে খবরের কাগজ না থাকলেও টিভি অবশ্য মোটামুটি সচল ছিল। দেশ-বিদেশের নানা খবর টিভির মাধ্যমেই জানা গেছে। দেশের খবরের মধ্যে রাজনৈতিক আকাশের ঈশান কোণে মেঘ জমার খবর, গার্মেন্ট শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকদের চিটিংবাজি, এখানে-ওখানে নিয়মিত লাশ পড়া, র্যাব বা পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের 'বন্দুকযুদ্ধ', দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার পাগলামি ইত্যাদি গা-সওয়া সংবাদের ভেতর এবার সড়ক দুর্ঘটনা, বাস-ট্রেন সংঘর্ষ ইত্যাদির খবর বাড়াবাড়ি রকম বেশি মনে হয়েছে। এগুলোও এখন আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চ দুর্ঘটনা ইত্যাদি সংবাদের শিরোনাম না হয়। এগুলো দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে আমাদের অনুভূতি কেমন যেন ভোঁতা হয়ে আসছে। এখন আর এসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের ভেতর তেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।
যেন সেই গণকের গল্পের মত। এক যুবক গেছে এক গণকঠাকুরের কাছে হাত দেখাতে। গণক তার হাত দেখে আর কেবল নাকমুখ কোঁচকায়, কিছু বলে না। ছেলেটি খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, কী দেখলেন, জ্যোতিষমশায়? গণকঠাকুর তখন মুখ খুলল, আপনার জীবনের প্রথম ৪০ বছর খুব খারাপ যাবে- অসুখ-বিসুখে খুব কষ্ট পাবেন, চাকরি-বাকরি জুটবে না, অভাব-অনটন লেগেই থাকবে, দাম্পত্য জীবনে চরম অশান্তি, আকণ্ঠ ঋণে জর্জরিত হয়ে চক্ষে অন্ধকার দেখবেন...। এটুকু শোনার পর যুবক কাতরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, এরপর কী হবে, জ্যোতিষমশায়? চল্লিশ বছর পর কী হবে? ছেলেটির রীতিমত কাঁদো কাঁদো অবস্থা। 'এরপর আর কী, এরপর আর কোনো সমস্যা নেই, সব কিছু গা-সওয়া হয়ে যাবে', ত্রিকালদর্শী সর্বজ্ঞ গুণিনের মত ভঙ্গি করে বলল গণকঠাকুর।
আমাদের খুন-গুম-জ্বালাও-পোড়াও-ব্যাংক ডাকাতি-ধান্দাবাজি ওয়াগায়রাহ ওয়াগায়রাহকেও আমাদের গণকঠাকুররা স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে বলেছেন। আর আমরাও আল্লাহর ওপর তাদের বিচারের ভার দিয়ে আবার মাঠে-ময়দানে, কলে-কারখানায়, অফিস-আদালতে নিজেদের রক্ত পানি করি ওই সব হুজুরের অস্থিরক্তমজ্জার অশ্লীল প্রবৃদ্ধির জন্য।
ঈদে-চান্দে রাস্তাঘাটে ঘরমুখো মানুষের ভিড় বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশে লঞ্চ-বাস দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া যেন স্বাভাবিক নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। ঈদ আসে সারা দেশের মানুষের জন্য খুশির বার্তা নিয়ে, আর উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গসহ সব বঙ্গের মানুষের মনে সেই সঙ্গে নেমে আসে উৎকণ্ঠা-আতঙ্ক। যারা ট্রেনে-বাসে-লঞ্চে করে কোথাও কাঁঠালবোঝাই, কোথাও বাদুড়ঝোলা হয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় তারা ভাবে, ছেলেপুলে নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করে ঠিকমত গিয়ে পৌঁছাতে পারব তো? আর তাদের পথ চেয়ে সারা বছর অপেক্ষায় থাকা তাদের বুড়ো বাপ-মা জায়নামাজে সিজদায় পড়ে থেকে আল্লাহকে ডাকেন : আল্লাহ, ওদের তুমি সহিসালামতে পৌঁছিয়ে দাও।... তারপর হঠাৎ খবর আসে, অমুক স্থানে বাস খাদে পড়ে অতজন মারা গেছে। অন্য কোথাও শতাধিক যাত্রীসহ লঞ্চ ডুবে গেছে নদীতে। সেই সঙ্গে সলিল সমাধি হয়েছে ঘরে ফেরা মানুষ এবং তাদের স্বজনদের ঈদের আনন্দ ও সারা জীবনের আশা-স্বপ্নের। এই চিত্র বরাবরের। ঈদের ছুটিতে মানুষ গ্রামগঞ্জের বাড়িতে যেতে এবং ছুটির পর কর্মস্থলে ফিরে আসতে এসব দুর্ঘটনা ঘটবেই, এটাই যেন নিয়ম। আর সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী-এমপি, ডিসি-এসপি, সাংবাদিক, উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম-হামজা, পুলিশ-র্যাব, ডুবুরি সবার দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি, ডোবাডুবি শুরু হয়ে যায়। লঞ্চডুবি হলে নদীতীরে স্বজনহারা শত শত মানুষের ভিড় জমে যায়। তাদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। কর্তৃপক্ষ দ্রুত এক বা একাধিক উচ্চ-নিম্ন-মধ্যম পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলে। ভাবটা এ রকম : রিপোর্ট পেলেই দোষী ব্যক্তিদের এমন সাজা দেব যে তারা তাদের ফোরটিন জেনারেশনের নাম পর্যন্ত ভুলে যাবে। তবে ওই পর্যন্তই। আজ পর্যন্ত বাস বা লঞ্চ দুর্ঘটনায় দায়ী কোনো মালিক, চালক বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর শাস্তি হয়েছে বলে শোনা যায়নি। অবশ্য দুষ্ট লোকে বলে, দোষীদের কিছু না হলেও এই সুবাদে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকারকরা দুটো কাঁচা পয়সা ঠিকই হাতিয়ে নেন।
অতি সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি ফেরি দুর্ঘটনার পর সে দেশের শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক তোলপাড় হয়ে গেল। মন্ত্রীর চাকরি গেল, প্রধানমন্ত্রী নিজে দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করলেন। আর আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত ঘটলেও কোনো সরকারের আমলেই পদত্যাগ করেননি কেউ। তবে হ্যাঁ, তাৎক্ষণিকভাবে 'গভীর শোক প্রকাশ' নামক বয়ান প্রদান এবং অতি দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠনের কাজটি বিশ্বস্ততার সঙ্গে করা হয়। মনে হয়, এগুলো যেন আগে থেকেই তৈয়ার করা অবস্থায় ড্রয়ারে রাখা থাকে!
(২)
মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়াগামী পিনাক-৬ নামের ছোট লঞ্চটি দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে পদ্মা নদীতে তলিয়ে যায় ঈদের ছয় দিন পর আগস্টের ৪ তারিখ, সোমবার, বেলা ১১টার দিকে। ৮৫ জন যাত্রী পরিবহন ক্ষমতার লঞ্চটিতে নাকি প্রায় তিনগুণ বেশি যাত্রী ছিল। ওই সময় আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল এবং ২ নম্বর সতর্ক সংকেত জারি ছিল, যার কারণে ওই আকৃতির লঞ্চটির জন্য ওই সময় নদীপথে চলাচল নিষিদ্ধ ছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, পরিবহন ক্ষমতার তিনগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি কী করে যাত্রা করল- তাও নাকি আবার বৈধ সার্ভে সনদ ছাড়াই- এসব মৌলিক প্রশ্নের জবাব তদন্ত রিপোর্টে হয়তো থাকবে, হয়তো থাকবে না; কিন্তু এটা ঠিক, যে যাত্রীটি পরবর্তী ঈদে আরেক পিনাক-৬-এ উঠবে সে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবে না কোনো দিন। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চরম অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে ঘটে যাওয়া এত বড় দুর্ঘটনাকে আমি দুর্ঘটনা না বলে বলব জেনোসাইড। এবং এর প্রকৃত কারণ কেউ কোনো দিন জানবে না।
যেভাবে রানা প্লাজার বেঁচে যাওয়া গার্মেন্ট শ্রমিকরা কোনো দিন জানতে পারবে না কোনো রাজনৈতিক কর্মী কি সত্যি ওই বিশাল দালানটিকে এক ঝাঁকুনি দিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলেছিল। যেভাবে ব্যাংকের আমানতকারীরা জানতে পারবে না সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা কি একা একজন হলমার্ক কম্পানির এমডি তানভির মেরে দিল, না ধরাছোঁয়ার বাইরের ওপরের তলার স্যারদেরও ওতে যথোপযুক্ত হিস্যা আছে। বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি, ইউনিপে-টু, বেসিক ব্যাংক, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি- এগুলোর মূল রুই-কাতলারা সব সময়ই জালের বাইরে থেকে যাবে, পাবলিক কোনো দিনই জানতে পারবে না এরা কারা। জানবে কী করে? জানতে চাইলেই তো বলা হবে, 'তদন্ত হচ্ছে, তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।' এই তদন্তকার্য হয়তো রোজ কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। আর যদি তার আগেই শেষ হয় তাহলে দেখা যাবে প্রধান আসামিদের নামই বাদ দেওয়া হয়েছে চার্জশিট থেকে।
আসলে আমাদের দেশের ঘাগু অপরাধীরা ঠিকই জানে, কোনো অপরাধ করে- তা নারায়ণগঞ্জ-ফেনী-লক্ষ্মীপুর-সাতক্ষীরার মার্ডার কেসই হোক, আর মাওয়ার লঞ্চডুবিই হোক- পার পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। খালি মানসাঙ্কটা একটু ঠিকমত করতে পারলেই হল। যেমন : 'খেপটা' ঠিকমত মারতে পারলে কত আসবে? দশ কোটি? ঠিক আছে, এর থেকে স্যারদের জন্য পাঁচ কোটি বাদ দাও। কত রইল? পাঁচ কোটি। এর ভেতর 'কামলাগুলানকে' দিতে হবে এক কোটি। থাকল কত? চার কোটি। নট ব্যাড। নেমে পড়ো। তবে সবার আগে স্যারদের দু'আ নিয়ে কামে নামতে হবে। তাহলে সবই চলবে ঠিকমত। খোদা না খাস্তা, খুব বেশি ঝামেলা হলে কিছুদিন না হয় নাজিমুদ্দিন রোড বা গাজীপুরে বেড়িয়ে আসতে হবে। এই তো। তার পরও যদি জেলের ভেতর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে দেয় কিংবা কল্লা ঝুলানোর হুকুম হয়, তবুও ঘাবড়ানোর কিছু নেই। একদিন কাকপক্ষীও জানবে না- জানবেন শুধু বড় স্যার, জেলার ব্যাটা তো শুধু চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকবে- জেল গেট দিয়ে গট্গট্ করে হেঁটে গিয়ে কালো কাচ লাগানো এসি কার এবং তারপর সাতক্ষীরা/বেনাপোল/ সোনামসজিদ/হিলি/বাংলাবান্ধা/ আগরতলা, আর না হয় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে পগার পার। তারপর সাগর পার। আর যদি কল্লা বাঁচানোর সওয়াল হয় তাহলে 'দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে'(!) চূড়ান্ত মার্জনার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। তাই বলছিলাম, ছোটবড় সব অপরাধী জানে, সব চাইতে ঝুঁকিমুক্ত, নিরাপদ ও লাভজনক প্রফেশন হচ্ছে তাদের প্রফেশন।
এ ধরনের আইনের প্রয়োগ নিয়ে আমরা কী করে আশা করতে পারি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, বাসচালক ১২০ কিলোমিটার বেগে বাস না চালিয়ে নির্ধারিত গতিসীমা ৮০ কি.মি. বেগে চালাবে, উন্মাদের মত একটার পর একটা গাড়িকে ওভারটেক করবে না, লঞ্চের সারেং ৮৫ জন যাত্রী নিয়েই রওনা হবে, ২৫০ জন নিয়ে নয়। কিংবা আবহাওয়াসংক্রান্ত বিপদসঙ্কেত মেনে চলবে, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চালাবে না।
আর এসব বাস-ট্রাক-লঞ্চের মালিক কারা জানেন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাঁরা আইন বানান বা আইন প্রয়োগের দায়িত্বে আছেন তাঁরা। অথবা এই দুই শ্রেণির মানুষের আত্মীয়-কুটুম্ব-ইয়ার-দোস্ত কাতারের লোক। আর না হয় সমাজের উঁচু স্তরের ভিআইপিরা। এবং সর্বাবস্থায় আছে ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপার।
পদ্মাবক্ষে জেনোসাইড
(৩)
ইদানীং রাস্তাঘাটে সময়ে-অসময়ে আমাদের জনৈক মাননীয় মন্ত্রীর দৌড়ঝাঁপ দেখে আমরা অবশ্যই পুলকিত বোধ করি। সড়ক ও জনপথ বিভাগের হালহকিকত সরেজমিনে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সদিচ্ছা থেকেই তাঁর এই ছোটাছুটি। অন্যরা যে যা-ই বলুক, আমি কিন্তু তাঁর এই দৌড়ঝাঁপের প্রশংসা করি। মন্ত্রী মানেই যে এসি রুমে বসে বুঝে না বুঝে দস্তখত দেওয়া আর হাই-হ্যালো করা নয়, তা কজন মাননীয় বোঝেন? সারা জীবন মাঠকর্মী হিসেবে মহকুমা (উপজেলা)-জেলা-বিভাগে চাকরি করে আমি জানি, নিজে দেখে, জনগণের কথা শুনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিকল্প নেই।
তবে এখানে আবার 'দুইখান কথা আছে'। মাননীয় মন্ত্রী আপনাকেই যদি সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটির ওপর থাকতে হয় তাহলে আপনার দপ্তর-পরিদপ্তর-উপদপ্তর ইত্যাদিতে যে শত শত কর্মকর্তা আছেন তাঁদের কাজটি কী? আপনাকে ঢাকা শহর থেকে এক শ কিলোমিটার দূরের রাস্তায় গ্রীষ্মের রোদে দাঁড়িয়ে কেন জানতে হবে, এই রাস্তা আজ পর্যন্ত কেন মেরামত হল না? কেন বলতে হবে, ঈদের আর মাত্র সাত দিন বাকি, আমি চাই, আগামী তিন দিনের ভেতর এই রাস্তা সম্পূর্ণ উপযোগী হোক যানবাহন চলাচলের জন্য। আপনার যে অফিসারটি বা অফিসারগণ শুধু এই কাজের জন্য কুরসি রওনক করে আছেন, তিনি বা তাঁরা কি শুধু বসে বসে তামাক আর ডুডু সেবন করবেন? এটাই নিয়ম হলে তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে রোজ রাতে বের হয়ে পাড়ায় পাড়ায় প্যাট্রল ডিউটি করতে হবে, নৌপরিবহনমন্ত্রীকে দেশের প্রত্যেকটা লঞ্চ বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়ার আগে যাত্রীদের মাথা গুনতে হবে, লঞ্চের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে, শিক্ষামন্ত্রীকে দেখতে হবে প্রত্যেকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাসে আসছেন কি না, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ...। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
(৪)
আমার আজকের লেখার মূল বক্তব্যটা এখানেই। আমাদের প্রশাসনব্যবস্থা- যেটা মোগল আমল-ব্রিটিশ আমল-পাকিস্তান আমল পার হয়ে এসে মোটামুটি ধোপে টেকে গেছে- ব্রিটিশদের সৃষ্টি সেই আমলাতন্ত্র, আমরা যতই গালমন্দ করি না কেন, একেবারে কিন্তু খারাপ না। স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অবশ্যই বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের প্রয়োজন আছে, মানলাম; কিন্তু তা করা হয়নি বা হচ্ছে না এই অজুহাতে প্রচলিত ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাব না তা তো হয় না। আমার দরকার একটি ছয় ইঞ্চি লম্বা ফলাযুক্ত ধারালো ছুরির, তা আমার নেই; কিন্তু যে পেনসিল কাটা ছুরিটি আমার আছে, তাকে তো আমি যথাসম্ভব নানা কাজে লাগাতে পারি। ব্রিটিশ আমলে তো কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিন, যত্রতত্র টেলিফোন, টেলিপ্রিন্টার, গাড়িঘোড়ার দবদবা রবরবা ছিল না, এমনকি সুশিক্ষিত কর্মীবাহিনীও ছিল না; কিন্তু যা ছিল, তা-ই দিয়ে কি ব্রিটিশরা জনগণকে সেবাদান করেনি? দুর্নীতিবাজ, কামচোর কর্মকর্তা-কর্মচারী সে আমলেও ছিল; কিন্তু তারা সব সময় যোগ্য, দক্ষ, সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ 'বস্'দের ভয়ে তটস্থ থাকত। দেশ বিভাগের আগে পাঠশালা স্কুলের একজন শিক্ষকের মাসিক বেতন ছিল কুল্লে ১২ টাকা। হ্যাঁ, ১২ টাকা। (তবে সে আমলে এক মণ- অর্থাৎ সাড়ে সাঁইত্রিশ কেজি চাল পাওয়া যেত মাত্র ছয়-সাত টাকায়।) তবু ওই বেতনে একজন দরিদ্র স্কুলশিক্ষকের সংসার চালানো ছিল দুরূহ। কিন্তু ওই কারণে যে তিনি স্কুল ফাঁকি দেবেন তার জো ছিল না। তাঁর যম স্কুল পরিদর্শক সাহেব সাইকেল চালিয়ে, নৌকা বা বাসে চড়ে, অথবা ঘোড়ায় চড়ে (সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে অনুন্নত যাতায়াতব্যবস্থার কারণে ট্যুরে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ঘোড়া বরাদ্দ পেয়েছিলেন বলে আমি আমার ওই আমলের স্কুল পরিদর্শক পিতার কাছ থেকে শুনেছি) যেকোনো মুহূর্তে হঠাৎ করে হাজির হয়ে যেতেন। আর এখন?...পরিদর্শন, তদারকি, তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা ইত্যাদি যেন অতীতের বিষয় হয়ে গেছে। লঞ্চের ফিটনেস আছে কি না, ওতে কতজন যাত্রী ও কী পরিমাণ মালামাল উঠল, আবহাওয়াগত কারণে লঞ্চটি ছাড়া উচিত কি না, হাইওয়েতে হাইওয়ে পুলিশ ডিউটি করছে কি না, রাস্তার যানবাহনগুলো সর্বোচ্চ গতিসীমা মেনে চলছে কি না, বাস-ট্রাক ইত্যাদির ফিটনেস আছে কি না, গাড়িটি ড্রাইভার চালাচ্ছে না হেলপার, রাস্তাটি মেরামতের প্রয়োজন আছে কি না ইত্যাদি সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য জনগণের টাকায় নিয়োজিত হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। তাঁরা নিয়মিত রিপোর্ট-টিপোর্টও দিয়ে থাকেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। তেমনি বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে-গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, কোর্ট-কাচারি-থানা-হাসপাতাল ইত্যাদির কাজকর্ম নিয়মিত পরিদর্শনের জন্য অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, তাঁরা যে ঠিকমত দায়িত্ব পালন করছেন তার নিশ্চয়তা কী? বড় সাহেব তো হুকুম দিয়েই খালাস : এক্ষনি ব্যাটাকে ধরে নিয়ে এসো। হুকুম পালন করবেন যিনি তিনি কি সবগুলো 'ওয়ারেন্ট-অব-অ্যারেস্ট' বোন্দা বানিয়ে ড্রয়ারে রেখে রোজ রাতে তাসের আসরে যোগ দিচ্ছেন, না নাকে তেল দিয়ে বাসায় ঘুমাচ্ছেন তা কী করে জানা যাবে? সেটা জানতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কষ্ট করে নিয়মিত অধস্তন অফিস, বাসস্টেশন-রেলস্টেশন-বিমানবন্দর-লঞ্চঘাট-স্টিমারঘাট পরিদর্শনে যেতে হবে, পরিদর্শন বহিতে নোট লিখতে হবে, নির্দেশনা দিতে হবে, সেগুলো পালিত হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে হবে।
যতটুকু খবর পাই, পরিদর্শন, পরিবীক্ষণ, তত্ত্বাবধান- এগুলো এখন প্রশাসনের বড়ই অবহেলিত দিক। মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এখন অতিমাত্রায় 'ডেস্ক-ওরিয়েন্টেড' হয়ে পড়েছেন। সেই সঙ্গে তাঁদের আসল কাজ হয়ে পড়েছে কর্তাব্যক্তিদের মনোরঞ্জন। অথচ এঁদের অন্যতম প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে অধস্তনদের কাজ পরিদর্শন করা- ইন্সপেকশন ও সুপারভিশন। মাসান্তে যেসব 'প্রোফর্মা রিপোর্ট' অধস্তন কর্মকর্তা 'বসের' কাছে পাঠিয়ে থাকেন, তাকে 'সব ঠিক হ্যায়' মনে করে এবং চোখ বুঁজে টিএ বিল পাস করে দিলে 'বস্' নিজে ঠকবেন এবং জাতিও পদ্মায় জেনোসাইডের মত লঞ্চডুবি ও সারা বছর বাস দুর্ঘটনা-রানা প্লাজা ধসে পড়ার মত মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির কবলে পড়তেই থাকবে। ছোট-বড় নানা ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হবে না।
(৫)
প্রসঙ্গটি নিশ্চয়ই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কোর্স, মিটিং, সেমিনারে আলোচিত হয়, তবে পরবর্তী পর্যায়ে তা কতটুকু আমল করা হয় তা গুরুত্বসহকারে দেখার জন্য নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব অনস্বীকার্য। সেই দায়িত্বটি পালন করুন। তাহলে আর মুম্বাই সিনেমার নায়ক অনিল কাপুরের ভূমিকায় আপনাদের নামতে হবে না। আর অনিল কাপুর তো 'নায়ক' ছবিতে মন্ত্রী হয়েছিলেন একদিনের জন্য, আপনাদের খায়েশ তো মন্ত্রী থাকবেন এক লাখ দিন। তার জন্য নিজে দৌড়ঝাঁপ করার সঙ্গে সঙ্গে সিস্টেমটাকেও কার্যকর করুন। নইলে কোনো দিন হয়ত দৌড়াতে দৌড়াতে পড়ে গিয়ে হাঁটুভাঙ্গা দ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে হবে। আল্লাহ না করুন।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন