|
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
|
|
সমুদ্রসীমা : এখন সামনের দিকে তাকাতে হবে
17 Jul, 2014
আন্তর্জাতিক আদালত ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা বিরোধে যে রায় দিয়েছে তাকে আমাদের সরকারপক্ষ ‘বিজয়’ হিসেবে দেখছে। অপরদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এতে বাংলাদেশের পরাজয় হয়েছে, কারণ এই রায়ে বিরোধীয় ‘দক্ষিণ তালপট্টি’ দ্বীপ ভারতকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার মামলাটি ঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেনি এবং ঠিকভাবে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরতে পারেনি- সে জন্যই এই বিপর্যয় ঘটেছে।
‘দক্ষিণ তালপট্টি’ নামে কোনো দ্বীপ কোনোকালেই ছিল না?
এই মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের প্রধান (এজেন্ট) দীপু মনি বলেছেন, ‘তালপট্টি দ্বীপের কোনো অস্তিত্ব কোনোকালেই ছিল না।’ (কাগজে তার বক্তব্য এভাবেই ছাপা হয়েছে, তিনি প্রতিবাদ করেননি)। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে অন্যরা বলছেন, ‘যারা এই দ্বীপ নিয়ে কথা বলছে তাদের উচিত সমুদ্রে সাঁতার কেটে গিয়ে দেখে আসা কোথায় সেই দ্বীপ।’ এই বক্তব্যের মর্ম বোধগম্য নয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা বিরোধে প্রধান আলোচ্য বিষয় বরাবরই ছিল ‘দক্ষিণ তালপট্টি’ দ্বীপ। এটি কার ভাগে পড়বে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তরেখা অংকনের দায়িত্ব পালনকারী ব্রিটিশ আইনজ্ঞ র্যাডক্লিফের রোয়েদাদ অনুযায়ী নদী দ্বারা দু’দেশের সীমান্ত চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নদীর ‘মধ্যরেখা নীতি’ অনুসৃত হবে।
নদী যখন সমুদ্রে পশে করে, তার স্রোতধারা সমুদ্রের ভেতরে বেশ কিছুদূর পর্যন্ত এগিয়ে যায়। সেই নদীর মোহনায় যদি কোনো দ্বীপ জেগে ওঠে তাহলে নদীর মূল স্রোতধারা সেই দ্বীপের কোন পাশ দিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ামক বিষয় হয়ে ওঠে। কারণ তার নিরিখে স্থির হবে দ্বীপটি কার ভাগে পড়বে। বাংলাদেশের দাবি ছিল, ১৯৪৭ সালে হাঁড়িভাঙ্গা নদীর গতিপথ যেভাবে চিহ্নিত ছিল তাতে তালপট্টি স্পষ্টত বাংলাদেশের ভাগে পড়ে। ইতিমধ্যে নদীর গতিপথ কিছুটা পরিবর্তিত হলেও তার মধ্যস্রোত নতুন দ্বীপটির পশ্চিম দিক দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত ছবিতে সেটাই প্রতীয়মান ছিল। অপরদিকে ভারত দাবি করে, নদীটি তার বর্তমান গতিপথ ধরে পূর্বমুখী কৌণিকভাবে দ্বীপটির পূর্বদিক দিয়ে সমুদ্রে এগিয়ে গেছে, অতএব সেটি ভারতের।
দেখা যাচ্ছে, সব বিবাদ ও যুক্তিতর্কই এই দ্বীপকে ঘিরে। সে অবস্থায় ‘তালপট্টি নামে কোনো দ্বীপ কখনোই ছিল না’ এমন কথা কী কারণে বলা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
‘দক্ষিণ তালপট্টি’ দ্বীপের ইতিহাস
নতুন প্রজন্মের পাঠকরা, যাদের এ বিষয়ে জানার তেমন সুযোগ হয়নি, তাদের জন্য এই বিতর্কের প্রেক্ষপটে দ্বীপটির কিছু ইতিবৃত্ত তুলে ধরা অবান্তর হবে না।
এটা ঠিক যে অতীতে এই নামে কোনো দ্বীপ কোথায়ও ছিল না। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে এক ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে আঘাত হানে। আবহাওয়াবিদরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘ভোলা’। এই ঘূর্ণিঝড় বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে। তাতে আমাদের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৫ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ও অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে ‘ভোলা’ কেবল ভাঙনের দূত হয়েই আসেনি, গঠনের কাজও করেছে। সেই জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় সমুদ্রতলের পলিমাটি উত্থিত হয়ে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় একটি নতুন দ্বীপ সৃষ্টি করে। স্থলভাগ থেকে কয়েক মাইল দূরে জেগে ওঠা এই চরটি প্রথমে খুব ছোট ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার পরিসর বাড়তে থাকে। ভাটার সময় তার পরিসর বেড়ে ৬-৭ বর্গকিলোমিটার হয়ে যেত, জোয়ারের সময় তার অধিকাংশ পানির নিচে থাকত। বাংলাদেশী জেলেরা মাছ ধরাকালে সেখানে অবস্থান নিতে শুরু করে এবং উপকূলবর্তী বাংলাদেশের তালপট্টি এলাকার নামের সঙ্গে মিল রেখে তারাই এর নাম দেয় ‘দক্ষিণ তালপট্টি’। ১৯৭৪ সালে মার্কিন উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দ্বীপটি সুস্পষ্টরূপে চিহ্নিত হলে ভারত তড়িঘড়ি ব্রিটিশ এডমিরাল ও জাতিসংঘে দ্বীপটির মানচিত্র জমা দিয়ে এটি ভারতের ভূখণ্ড বলে দাবি পেশ করে। ভারত এর নাম দেয় ‘নিউ মূর’। দুর্ভাগ্যবশত দ্বীপটির মালিকানা পাওয়ার জন্য শুরু থেকেই ভারত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেও বাংলাদেশ পক্ষের ঘুম ভাঙতে অনেক সময় লেগেছে।
১৯৭৮ সালে ভারতীয় সেনাবহিনী দ্বীপটিতে অবতরণ করে এবং সেখানে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তৎকালীন প্রধান রিয়ার এডমিরাল এমএইচ খান কঠোর অবস্থান নিয়ে সেখানে নৌ-সেনা প্রেরণ করলে ভারত দ্বীপটির প্রহরায় তার নৌবাহিনীর দুটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। এ সময় তালপট্টি দ্বীপ জাতীয় রাজনীতিতে একটি উত্তপ্ত ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।
জিয়াউর রহমানই দ্বীপটি ভারতকে দিয়ে গেছেন?
সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানই তালপট্টি দ্বীপ ভারতকে দিয়ে গেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০- এই দু’বছরই তালপট্টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি নাড়াচাড়া হয়েছে। ওই সময়ই তালপট্টিতে সবল ভারতের যুদ্ধজাহাজের বিপরীতে দুর্বল বাংলাদেশের গানবোট প্রতীকী অবস্থান নিয়ে বিষয়টিকে আলোচনার টেবিলে এনেছিল। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়া বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের বাংলাদেশ সফরকালে বিষয়টি আনুষ্ঠানিক আলোচনায় উত্থাপন করেন। ১৮ আগস্ট ১৯৮০ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নরসিংহ রায় বাংলাদেশ সফরে এলে দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলা হয়। ১৯৮১ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ সরকার তালপট্টি দ্বন্দ্ব বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে এবং তা জাতীয় সংসদে পেশ করে। অতঃপর ওই বছর ১১ সেপ্টেম্বর দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে এ বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই বছর দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়। তারপর বিষয়টি ধীরে ধীরে হিমঘরে চলে যায়। ’৮০ ও ’৯০-এর দশকে কোনো সরকারই এ নিয়ে জোরালো ভূমিকা রাখেনি।
১৯৯৮ সালে ভারত তালপট্টিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএসএফের একটি ক্যাম্প স্থাপন করলে বাংলাদেশ এর প্রতিবাদ জানায়। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তালপট্টির ওপর বাংলাদেশের অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরে আলোচনার নিস্ফল উদ্যোগ নেয়। অতঃপর ২০০৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ইতিমধ্যে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার উপক্রম হলে সরকার তড়িঘড়ি আদালতের শরণাপন্ন হয়।
২০১০ সারে প্রথম জানা যায় যে দ্বীপটি আর নেই। পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এখন উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে সেখানে কয়েকটি ডুবোচর বিদ্যমান দেখা যায়। দেখা যাচ্ছে, তালপট্টি প্রায় ৩৮ বছর বিদ্যমান ছিল। ২০০৯ সালেও সেখানে অর্ধনিমজ্জিত গাছপালা দৃশ্যমান ছিল (ছবি দ্রষ্টব্য)।
কী কারণে দ্বীপটি এভাবে ক্ষয়ে গেল?
কী কারণে দ্বীপটি এভাবে ক্ষয়ে গেল তা স্পষ্ট নয়। তবে কার্যক্ষেত্রে দ্বীপটির ওপর বাংলাদেশের কোনো নজরদারি ছিল বলে মনে হয় না। নইলে দ্বীপটি যে তলিয়ে গেছে বা যাচ্ছে সে তথ্য আমাদের ২০১০ সালে এসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের গবেষকদের মাধ্যমে জানতে হবে কেন? বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা ‘দ্বীপটি ১৯৮০ সালেই তলিয়ে গেছে’, এমন বিভ্রান্তিকর তথ্যই বা দেবেন কেন?
তালপট্টির ব্যাপারে পরিবেশবিদরা কেউ কেউ বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্বির কারণে সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে এটি ঘটেছে। (আমি এই অতি-সরলীকরণ মানতে মোটেই রাজি নই)। তাহলে তো আশপাশের আরও অনেক চরের একই দশা হতো। তাছাড়া বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর ৩.২ মিমি হারে বাড়ছে। সেই হিসাব মেনে নিলেও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সাগরের উচ্চতা ৩০-৪০ বছরে ৩-৪ ইঞ্চির বেশি বাড়ার কথা নয়। উপগ্রহের তথ্য অনুযায়ী তালপট্টি দ্বীপ জেগে ওঠার পর তার উচ্চতা ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে ২ থেকে ৩ মিটার। সে হিসাবে দ্বীপটি সম্পূর্ণ ডুবে যেতে কমপক্ষে ৩০০ বছর লাগার কথা। অতএব দ্বীপটি সে কারণে ডুবে যায়নি।
দ্বীপটি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সার্র্বক্ষণিক নজরদারি ও তদারকিতে ছিল। এটি হঠাৎ করে একদিনে বা এক বছরে ডুবে যায়নি। ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে বা দেবে গেছে। তলদেশে আকস্মিক ভূমিধসে, জলোচ্ছ্বাসে কিংবা সুতীব্র স্রোতের তোড়েও তা হতে পারে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনে ‘স্পার’ বা ‘গ্রোয়েন’ নির্মাণ করার প্রক্রিয়া অতি পুরনো। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ এভাবে বিলীন হওয়ার বিষয়টি আমাদের কর্তৃপক্ষের অগোচরে ঘটে গেছে, সেটা তাজ্জবের বিষয় বটে। দ্বীপটি নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম হয়েছে, সরকারি পর্যায়ে মিটিং-সিটিং হয়েছে, কিন্তু তার অবস্থান নিয়ে আমাদের সরকারের তরফ থেকে কোনো খোঁজখবর রাখা হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের ভূমি জরিপ বিভাগ, কোস্টগার্ড বা নৌবাহিনীসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই দ্বীপ বা তার সন্নিহিত অঞ্চলে নদী ও সমুদ্রতলের ভূপ্রকৃতির বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও যথাযথ মানচিত্র তৈরির দিকে দৃষ্টি দেয়নি, তা স্পষ্ট।
বাংলাদেশের মানচিত্রেই দক্ষিণ তালপট্টি ভারতে দেখানো হয়েছিল?
২০১১ সালের ১৮ মে ঢাকার দৈনিক ‘সান’ পত্রিকায় ‘All previous maps flawed, Govt. to reprint map to include Talpatti’ শিরোনামে ফাহুদ খানের এক রিপোর্টে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক আদালতের মামলায় বাংলাদেশের নথিতে যে মানচিত্র পেশ করা হয় তাতে দক্ষিণ তালপট্টির অবস্থান ছিল ভারতের ভাগে। এ বিষয়টি ধরা পড়ার পর বাংলাদেশের কৌঁসুলিরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। তখন তড়িঘড়ি লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালের র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মানচিত্র সংগ্রহ করা হয়। এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, ভূমি জরিপ অধিদফতর ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ মানচিত্র মুদ্রণ বিভাগের মধ্যে তীব্র বাগবিতণ্ডা হয়। একে অপরকে দোষারোপ করে দায় এড়াতে থাকেন। কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। (এরপর মামলায় জিততে হলে স্বয়ং জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে নেমে আসতে হবে)। এমন একটি স্পর্শকাতর মানচিত্র যারা এভাবে তৈরি করেছেন, যারা তা ছেপেছেন এবং যারা সেটি ভালোভাবে না দেখেই আদালতে পেশ করেছেন, তারা সবাই আমাদের জাতীয় স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। বলা যায়, তালপট্টি বাংলাদেশের হাতছাড়া হওয়ার পেছনে তাদের অবহেলা ও অযোগ্যতা বড় ভূমিকা পালন করেছে। তারা কি জেনেশুনেই কাজটি করেছেন? নাকি কোনো মহল তাদের দিয়ে এ কাজটি করিয়েছে, সে ব্যাপারে তদন্ত হওয়া আবশ্যক।
তালপট্টি চলে যাওয়ায় আমাদের লাভ হয়েছে?
এখন এ কথাও বলা হচ্ছে যে, তালপট্টি দ্বীপ ডুবে যাওয়ায় বাংলাদেশের লাভ হয়েছে। সেটি থাকলে নাকি বাংলাদেশের সমূদ্র এলাকা আরও কমে যেত। সাধারণ বুদ্ধিতে বলা যায়, দ্বীপটি ডুবে না গেলে এবং তা বাংলাদেশের ভাগে পড়লে আমাদের সীমান্ত আরও পশ্চিমে সরে যায়। সেক্ষেত্রে আমাদের সমুদ্র এলাকা কীভাবে কমে যায়, তা বোধগম্য নয়।
দ্বীপটি ডুবে গেলেও তার অবস্থানের জায়গাটি মানচিত্র থেকে উবে যায়নি। সেখানে এখন ডুবোচর রয়েছে। সেক্ষেত্রে ওই ডুবোচরের মালিকানা কাদের থাকবে সেটা বিচার্য ছিল। সংশ্লিষ্ট এলাকায় কোনো যৌথ জরিপ কাজ হয়নি। আন্তর্জাতিক আদালতও তা নির্ধারণের জন্য কোনো কমিশন পাঠায়নি। এমতাবস্থায় হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মূল স্রোত কোন দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করেই তালপট্টির ডুবোচরগুলো ভারতকে দেয়া হয়েছে।
এর ফলে ওই দ্বীপ বা ডুবোচরের দক্ষিণে সমুদ্রের দিকে বিশাল জলভাগ ভারতের ভাগে চলে গেছে। যে এলাকাটি খনিজসম্পদে বিপুল সম্ভাবনাময়। (এর দক্ষিণেই বঙ্গোপসাগরে ভারত একটি গ্যাসক্ষেত্র পেয়েছে, তাতে গ্যাস মজুদ ১০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের বেশি)। কৌশলগত কারণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের ‘অতল খাড়ি’ (swatch of no ground) অদূরেই অবস্থিত। এমতাবস্থায় দ্বীপটি হাতছাড়া হওয়ায় ‘বাংলাদেশের লাভ হয়েছে’ এ কথা বলা ব্যর্থতা ঢাকার প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়।
মনে হয়, ভারত বরাবরই সন্দিহান ছিল যে, বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত এবং নিরপেক্ষ জরিপে এ দ্বীপটি তার ভাগে পড়বে না। সে জন্যই কখনও যৌথ জরিপে রাজি হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত দ্বীপটির অবস্থানস্থল ভারতের ভাগে চলে গেলে দ্বীপটির ডুবে যাওয়া ভারতের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে। দ্বীপটি অক্ষত থাকলে এই রায়ের পর ভারতের উপকূলীয় ‘বেস্ লাইন’ আট-দশ মাইল দক্ষিণে দ্বীপটির দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত সরে যেত। তাতে করে ভারতের উপকূলীয় এলাকা এবং ‘নিজস্ব অর্থনৈতিক এলাকা’ (ঊঊত) বেড়ে যেত। বাংলাদেশের ভাগে পড়লে সে সুবিধা আমরা পেতাম। যে সুবিধা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কারণে আমরা আংশিক পেয়েছি। দ্বীপটি না থাকায় ভারত এখন সেই সুবিধা পাচ্ছে না। তবে সেটি আবার জেগে উঠলে ভারত লাভবান হবে।
এখন সামনে তাকানোই উত্তম
ভারত ও মিয়ানমার দু’দেশই যেভাবে বাংলাদেশর উপকুলের দিকে কৌণিকভাবে সমুদ্রসীমা দাবি করেছিল, তাতে বাংলাদেশ কার্যত ভূ-পরিবেষ্টিত (ষধহফষড়পশবফ) ভূখণ্ডে পরিণত হয়। স্পষ্টত এটা ছিল উভয় দেশের চাপ সৃষ্টির কৌশল, যা কোনো অবস্থাতেই কোনো আদালতে গ্রাহ্য হওয়ার নয়। ‘ইটলস’ ও ‘আইজেসি’ সে দাবি আমলে নেয়নি। অতএব ভারতের দাবি অনুযায়ী বিরোধীয় এলাকা ছিল ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে বাংলাদেশ ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার পেয়েছে। এতে বাংলাদেশের জয় হয়েছে, এই বক্তব্য শিশুর হাতে টফি তুলে দেয়ার মতো। এ নিয়ে বিজয় উৎসব করা কিংবা সমালোচকদের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে বলা শোভন আচরণ নয়।
মিয়ানমারের ক্ষেত্রে যেমন ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পাদিত খসড়া ‘চুক্তি’তে নির্ধারিত সীমানা (যা ২০০৮ পর্যন্ত মিয়ানমার মান্য করেছে) বহাল রাখা যায়নি, তেমনি ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের নির্দেশনা মোতাবেক আমাদের প্রাপ্যও আদায় করা যায়নি। এ নিয়ে এখন আর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।
তবে উভয় ক্ষেত্রেই আমরা যা পেয়েছি, তা আমাদের ন্যায্য পাওনার চেয়ে কম হলেও ‘মন্দের ভালো’। এখন ভালো হয় যদি আমরা পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি থেকে বিরত থাকি এবং যা পেয়েছি তার সুরক্ষা, উন্নয়ন, সুব্যবস্থাপনা ও সুব্যবহারের দিকে মনোনিবেশ করি।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক; চেয়ারম্যান, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল- পিডিপি; ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন