|
মোস্তফা কামাল
|
|
বিএনপির আন্দোলনের আগাম হুমকি এবং মামলার জাল
16 Jul, 2014
বিএনপির রাজনীতি এখন ইফতার পার্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। রোজার মাসে ইফতার পার্টিকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে আপাতত আর কিছুই করার নেই তাদের। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ইফতার পার্টির অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে পর পর কয়েক দিন আন্দোলনের আগাম হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঈদের পরই সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করবেন। তাঁর এই আগাম ঘোষণার কারণে বিপাকে পড়েছেন বিএনপি নেতারা। তাঁদের মামলার জালে আটকাতে সরকারও আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা সচল করা হচ্ছে। অনেককে নতুন নতুন মামলায় জড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের পোড় খাওয়া অনেক নেতাই এখন এলাকাছাড়া। আবার অনেকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন।
স্থানীয় নেতাদের মতে, দল না গুছিয়ে কিংবা সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত না করে আন্দোলনে যাওয়া বিএনপির জন্য বোকামি হবে। অতীতেও দল গোছানোর প্রতি নজর না দিয়ে আন্দোলন করায় বিএনপি তার ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। বিএনপিকে বাইরে রেখেই নির্বাচন হয়েছে। তুমুল জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক দলও কৌশলের কারণে যে পর্যুদস্ত হতে পারে তার প্রমাণ বিএনপি। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, বিগত নির্বাচনে না গিয়ে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নির্বাচনে গেলে নিশ্চয়ই তার ফলাফল অন্য রকম হতো। এখন এই সরকার যদি পাঁচ বছর টিকে যেতে পারে তাহলে বিএনপি গভীর অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য যে সাংগঠনিক শক্তি দরকার তা এ মুহূর্তে বিএনপির নেই। আন্দোলনের ডাক দিলেই বিএনপি মাঠ গরম করতে পারবে না। শুধু নেতারা জেলের ভাত খাবেন এই যা! শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতাকে জেলে ঢোকাতে পারলে বিএনপির আন্দোলন হালে পানি পাবে না। এর পরও কেন বেগম জিয়া আন্দোলনের আগাম হুমকি দিলেন? সত্যিই কি তিনি আন্দোলন চাঙ্গা করতে পারবেন?
কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই বলছেন, আগাম আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে বেগম জিয়া তাঁদের বিপাকে ফেলেছেন। এখন তাঁদের ঈদটাই মাটি হবে। অনেকে এলাকায় গিয়ে ঈদ উদ্যাপন করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ভয়ে তাঁরা গা ঢাকা দেওয়ার চিন্তা করছেন। নেতাদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়াও সঠিক নেতৃত্বের পরিচায়ক হতে পারে না।
এর আগেও আমরা দেখেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে বিএনপির আন্দোলন মাঠে মারা যায় কেন্দ্রীয় নেতাদের আত্মগোপনে চলে যাওয়ার কারণে। আসলে তাঁদের মামলার জালে এমনভাবে আটকানো হয়েছিল যে তাঁদের পক্ষে রাজপথে নামা সম্ভব ছিল না। রাস্তায় নামলেই গ্রেপ্তার করা হতো। কেউ কেউ সরকারের সমালোচনা করে আর মঞ্চ ত্যাগ করতে পারতেন না। মঞ্চ থেকে তাঁদের নামিয়ে তুলে নেওয়া হতো।
আমরা এও দেখেছি, বিগত পাঁচ বছরই বিএনপি নেতারা সরকারের জেল-জুলুম আর নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। একের পর এক মামলায় জড়িয়ে তাঁদের নাস্তানাবুদ করা হয়েছে। কেউ মুখ খুললেই পুলিশি হয়রানির ভয়! বিএনপি নেতাদের এই আত্মগোপনে থাকার চিন্তা কেউ-ই সমর্থন করছেন না। দলের ভেতরে অনেক সমালোচনা হয়েছে। সুদূর লন্ডনে বসে তারেক রহমান হয়তো নেতাদের প্রতি বিষোদ্গার করতে পারেন; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে থাকলে তারেকও হয়তো টের পেতেন কত ধানে কত চাল!
১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার যে আবির্ভাব ঘটেছে, তা এখন রাজনৈতিক বাস্তবতা। এটা সবাইকে মানতেই হবে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটোই তুমুল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। ১৯৯১ সালে বিএনপি, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, ২০০১ সালে আবার বিএনপি, ২০০৯ সালে আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। এবারের নির্বাচনেও বিএনপি অংশ নিলে এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে দলটি ক্ষমতায় ফিরে আসত বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আবার বিভিন্ন জরিপ রিপোর্টও সে ইঙ্গিতই দিচ্ছিল।
বিএনপির আন্দোলনের আগাম হুমকি এবং মামলার জাল
কিন্তু শুধু জনপ্রিয়তা থাকলেই হয় না, রাজনীতি হচ্ছে কৌশলের খেলা। সেই খেলায়ও জিততে হয়। এবার বিএনপি কৌশলের খেলায় হেরে গেছে। তাই বলে কি বিএনপি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? জেল-জুলুম, নিপীড়নের ভয়ে নেতারা কি গর্তে লুকিয়ে থাকবেন?
অতীতে সব সরকারই বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছে; কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। বাড়াবাড়ির ফল কোনোকালেই ভালো হয়নি। বিএনপিও ক্ষমতায় থাকাকালে অনেক বাড়াবাড়ি করেছে। নানা কৌশলে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়েছে। একই পথে চলেছে আওয়ামী লীগও। শেষ পর্যন্ত এর পরিণতি ভালো হয়নি; ভালো হয় না। এটা মাথায় নিয়েই বিএনপিকে এগোতে হবে।
এ ক্ষেত্রে প্রথমত বিএনপির নিজেদের দোষত্রুটি শোধরাতে হবে। ক্ষমতায় গেলে তা কুক্ষিগত না করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করা উচিত। নিজেদের কল্যাণের কথা ভুলে যাওয়া উচিত; কিন্তু আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি উভয়েরই প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, নিজেদের উন্নয়ন। দেশ ও জনগণের স্বার্থের ব্যাপারে তারা ভাবে না। দেশের উন্নয়ন কেবল মুখে মুখে ভেসে বেড়ায়।
বিএনপির বিগত সরকারের আমলে দুটি বড় ভুলের কারণে দলটি দ্রুত অজনপ্রিয় হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হারাতে হয়। এক. জামায়াতকে সরকারের অংশীদার করা এবং দুজন যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া। দুই. ক্ষমতার দ্বিতীয় কেন্দ্র হিসেবে হাওয়া ভবনের আত্মপ্রকাশ। কোনো কোনো সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নাকি হাওয়া ভবন থেকে সরকার পরিচালিত হচ্ছে, তা নিয়ে দ্বিধায় পড়তেন কর্মকর্তারা। এখনো যে পড়ছেন না তা নয়। এখনো ঢাকা আর লন্ডনের নেতৃত্ব নিয়ে নেতারা দ্বিধান্বিত। বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যাচ্ছে। মা ও ছেলের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় অনেক সময় আন্দোলন নিয়ে নানা জটিলতায় পড়তে হয় নেতাদের। বেগম জিয়া ও তারেক সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর এটা নিশ্চিত করা তাঁদেরই দায়িত্ব।
বিএনপি সারা জীবন ক্ষমতার বাইরে থাকবে না। আবারও নিশ্চয়ই ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু এ বিষয় দুটিকে মাথায় রাখা জরুরি বলে মনে করি। বিগত নির্বাচনগুলোতে জামায়াতকে সঙ্গী করে বিএনপি লাভবান হয়েছে, না ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। এ ছাড়া বিএনপির ভারতনীতির বিষয়টিও সুস্পষ্ট করা দরকার। কেবলমাত্র ভোটের জন্য ভারত বিরোধিতার ইস্যুকে জিইয়ে রাখা ঠিক নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও বাস্তবতার নিরিখে বিষয়টি দেখতে হবে। নিকট প্রতিবেশী ভারতের মতো একটি বড় দেশের বিরাগভাজন হয়ে ক্ষমতায় আসা বিএনপির জন্য কঠিন হবে। আবার ভারত বিরোধিতা করলেই যে দেশের সার্বভৌমত্ব অটুট থাকবে তার কি গ্যারান্টি আছে? আমরা তো বিগত বিএনপি আমলেও দেখেছি, সংসদে ভারতবিরোধী কথাবার্তা বলে বিএনপি এমপিরা ভারতের সঙ্গেই বেশি ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন! এ ধরনের দ্বিমুখী নীতিও পরিহার করা জরুরি।
আমরা এও মনে করি, এ মুহূর্তে বিএনপি নেতৃত্বের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও মনোযোগ দেওয়া উচিত দল গোছানোর কাজে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলকে পুনর্গঠন করে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো বেশি জরুরি। দল ঠিক না থাকলে জনপ্রিয়তাও কোনো কাজে আসবে না। ১৯৯১ সালে বিএনপি নিজেও ভাবেনি ক্ষমতায় আসবে। তখন বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি একেবারেই নড়বড়ে ছিল। কেবলমাত্র জনপ্রিয়তার জোরে তখন বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই '৯১ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে মনে হয় না। বিএনপির এখন যে সাংগঠনিক অবস্থা তা মোটেই আন্দোলন করার মতো অবস্থানে নেই। এ অবস্থায় আন্দোলনে যাওয়া বিএনপির আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত হবে। তাড়াহুড়া না করে বিএনপির উচিত, সরকারকে আর কিছুটা সময় দেওয়া। তাহলে হয়তো বিএনপির খুব বেশি আন্দোলনও করতে হবে না। সরকার নিজেদের ভুলের কারণেই বিপাকে পড়বে। আর সেটাই হয়তো বিএনপির জন্য সুফল বয়ে আনবে। এ সুযোগে দলটাকে গুছিয়ে নেওয়া ভালো না!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
(কালের কন্ঠ)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন