এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ পাঠাতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থার অনুমোদন গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। এ ধরনের অনুমোদন গ্রহণের প্রক্রিয়া জটিল বিধায় বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী প্রমুখ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের অবলম্বন হিসেবে অর্থ পাচারের পথ বেছে নেয়। বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে প্রেরিত অর্থ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিস্তারের ক্ষেত্রে সহায়ক বিবেচনায় বর্তমানে উন্নত দেশগুলো বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান অর্থ পাচার বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। উন্নত দেশের মতো অর্থ পাচার প্রতিরোধে আমাদের দেশেও রয়েছে মানি লন্ডারিং আইন। কিন্তু অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের অসাধু ব্যক্তিরাও আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে দিয়ে সেখানে সুখের নীড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর।
বাংলাদেশের অসাধু ব্যক্তিরা যেসব দেশে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ পাঠিয়ে ভূসম্পত্তি ক্রয় ও বাড়িঘর নির্মাণে ব্যয় করছেন সেসব দেশ হল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংক, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড। এসব দেশের মধ্যে সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং ও দক্ষিণ আফ্রিকায় পাচারকৃত অর্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় সাময়িকভাবে বা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গচ্ছিত রাখার পর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে, যা টাকায় রূপান্তর করলে দাঁড়ায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এ বিষয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রকাশিত তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার কম নয়। আমাদের বর্তমান গড় জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) ১০ লাখ কোটি টাকা। সে হিসাবে আমাদের দেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয়েছে তার পরিমাণ জিডিপির ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। পাচারকৃত সমুদয় অর্থ যদি দেশে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, তাহলে রাতারাতি বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে যাবে, দারিদ্র্য বিমোচিত হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, বেকারত্ব কমবে, দ্রুত শিল্পায়নের দিকে দেশ এগিয়ে যাবে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো দৃঢ়তর হতে থাকবে।
ইতিপূর্বে কখনও সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সে দেশে বাংলাদেশীদের কী পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করেনি। ২০০৪ সাল থেকে অদ্যাবধি সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের অর্থ গচ্ছিত থাকার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ থেকে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকার কোটা অতিক্রম করেছে। তাদের তথ্যমতে, বিগত বছর পর্যন্ত পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের অভিমত, এ অর্থ বাংলাদেশ থেকে বিগত বছরগুলোয় যে অর্থ পাচার হয়েছে তার এক শতাংশেরও কম।
নবম সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে এক বছরের মাথায় রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে বাজারে ধস নামিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়ে দেয়। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হলে তদন্তে যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম বেরিয়ে এসেছিল, আমাদের প্রবীণ অর্থমন্ত্রী যে কারণেই হোক তাদের নাম প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেন। ধারণা করা হয়, শেয়ারবাজার থেকে লুণ্ঠনকৃত ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে এবং এর ভাগ যে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা পেয়েছেন সে বিষয়টি আজ আর অজানা নয়।
শেয়ারবাজারের ধস সামলাতে না সামলাতেই দেখা গেল হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্র“প, ডেসটিনি ও বেসিক ব্যাংক- এ চারটি প্রতিষ্ঠান দেশের সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ চারটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থের সুবিধাভোগীদের মধ্যে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরাও রয়েছেন। এসব অর্থের অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়েছে, বিশ্বস্ত সূত্র এমন তথ্যই নিশ্চিত করেছে। এ অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার নিয়ে দেশব্যাপী যখন হৈচৈ চলছিল, তখন অর্থমন্ত্রী আত্মসাৎকৃত অর্থকে সামান্য অবহিত করে দেশবাসীকে বিস্মিত করেন।
বাংলাদেশ এক বিচিত্র দেশ। এ দেশে দুর্নীতি নির্মূলের সঙ্গে টিআইবি নামক যে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে, একসময় অভিযোগ উঠেছিল এ প্রতিষ্ঠানের তখনকার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছেন। উল্লেখ্য, ওই সময়টিতে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানে ছিল।
মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশীদের বিনিয়োগ দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং এর পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশীদের অনুরূপ বিনিয়োগ রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে। বৈধভাবে এসব দেশে বিনিয়োগের জন্য অর্থ প্রেরণের কোনো সুযোগ নেই। তাই প্রশ্ন, কী করে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে বেরিয়ে গেল? অনুসন্ধানে জানা যায়, এলসির মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের উচ্চমূল্য দেখিয়ে একভাবে অর্থ পাচার করা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অবহিত হলেও তাদের কখনও এ তৎপরতায় জড়িতদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখা যায়নি। এ দেশের রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং ব্যবসায়ীরা, যারা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তারা বিভিন্ন প্রকল্পকে অতি মূল্যায়িত করে যে বাড়তি অর্থ পরস্পর ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন, এর বেশিরভাগই হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। তাছাড়া অন্যভাবেও দুর্নীতিলব্ধ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের ধারণা, দেশে যে কোনো ধরনের পটপরিবর্তন হলে অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য মামলায় বিজড়িত হয়ে তাদের হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে। আর তাই যদি দুর্নীতিলব্ধ অর্থ বিদেশে রাখা যায়, তাহলে সাময়িকভাবে দেশত্যাগ করে নির্বিঘ্নে বিদেশে অবস্থান করা যাবে এবং পরিস্থিতি অনুকূল বিবেচিত হলে আবার দেশে ফিরে আসা যাবে।
এক দেশ থেকে অপর দেশে অর্থ পাচার রোধে যে সংস্থাটি তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে সহায়তা করে থাকে তার নাম এগমন্ট গ্র“প। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ১৪৭টি দেশ এ গ্র“পের সদস্য। বাংলাদেশ সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আন্তরিক হলে কাজটি কঠিন কিছু নয়। এটি সত্য যে, বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশ পাচার করেছে। তাই পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে দলমত নির্বিশেষে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে অবৈধভাবে প্রেরিত সবার অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও দেখা গেছে একপেশে উদ্যোগ। তাই পাচারকৃত অর্থের সামান্যও ফেরত আসবে কি-না এ বিষয়ে দেশবাসী সন্দিহান।
বাংলাদেশ থেকে ইতিপূর্বে বিদেশে গেছেন এমন যাত্রী বিদেশ যেতে চাইলে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়া সর্বাধিক ৫ হাজার ডলার সঙ্গে নিতে পারেন। একইভাবে একজন বাংলাদেশী বিদেশ থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘোষণা ছাড়া সর্বাধিক ৫ হাজার ডলার নিয়ে আসতে পারেন। যে কোনো উন্নত দেশে মাসাধিককাল বসবাসের জন্য ৫ হাজার ডলার খুব বেশি অর্থ নয়। আর এ অর্থ ভ্রমণ সংশ্লেষেই ব্যয় হয়ে যাওয়ার কথা। আজ বিভিন্ন দেশে ভূসম্পত্তি ও বাড়িঘর ক্রয়ে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রায় এ অর্থ কীভাবে নির্বাহ করা হয়েছে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা সরকারের জন্য খুব একটা কঠিন কাজ নয়। অবৈধ অর্থ পাচার রোধে বিভিন্ন দেশ তৎপর বিধায় সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলে না পাওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। দেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয়েছে, সে অর্থের মালিক এ দেশের সাধারণ মানুষ। যারা অর্থ পাচার করেছেন, তারা দেশের ও জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে অবৈধভাবে সম্পদের মালিক হয়েছেন। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিয়ে আজ যারা দেশের সমৃদ্ধির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন, জনসম্মুখে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়া উচিত এবং অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত এনে তাদের বিচারের সম্মুখীন করে শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
দেশ থেকে যে অর্থ পাচার হচ্ছে, এটি আজ আর গোপন কিছু নয়। পাচার রোধে নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে সরকারের অঙ্গীকার ছিল কী ছিল না, সে প্রশ্ন বাস্তবতার নিরিখে এখন অপ্রাসঙ্গিক। প্রকৃত গণতন্ত্র অনুসৃত হয় এমন সব দেশে সরকারের অবস্থান সব সময় জনগণের পক্ষে থাকে। আমাদের সরকার নিজেকে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত দাবি করে থাকলে তার উচিত হবে অর্থ পাচার রোধ এবং অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়া।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন