অন্তর্বর্তী অবস্থায়ও কি রাষ্ট্রপতির ভূমিকা একই থাকবে?
21 Jun, 2014
বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্রপতি শাসিত, সংসদীয়, সেনা শাসিত, তত্ত্বাবধায়ক ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবলোকনের সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যুদয়-পরবর্তী সংবিধান প্রণয়ন অবধি ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা দেশ শাসিত হতো। সংবিধানের অবর্তমানে মূলত সে ব্যবস্থাটি ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা। সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার আগমন ঘটলেও মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ছেদ পড়ে। অতঃপর ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী প্রণয়ন অবধি দীর্ঘ ২১ বছরের অধিককাল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকলেও এ সম্পূর্ণ সময় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি দ্বারা দেশ শাসিত হয়নি। এ সময়ে দুঃখজনক ঘটনার মাধ্যমে দু’জন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির মৃত্যু ঘটলে দু’বার দেশ সামরিক শাসনের কবলে পড়ে। তাছাড়া গণআন্দোলনের মুখে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি অসাংবিধানিকভাবে পদত্যাগে বাধ্য হলে অসাংবিধানিকভাবেই একজন কর্মরত প্রধান বিচারপতির অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি রূপে আগমন ঘটে। যদিও সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম ও একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দু’দফার সামরিক শাসন এবং একদফার কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক শাসনের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে উচ্চাদালত কর্তৃক পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হলেও একাদশ সংশোধনীর ব্যাপারে কাউকে অদ্যাবধি আদালতের দ্বারস্থ হতে দেখা যায়নি। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা অদ্যাবধি অব্যাহত থাকলেও এ সময়ের মধ্যে তিনবার সাংবিধানিকভাবে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং একবার অসাংবিধানিকভাবে গঠিত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দ্বারা দেশ শাসিত হয়।
আমাদের রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা এবং পরামর্শ দানের জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ ছিল। কিন্তু পরিষদ বা মন্ত্রী আদৌ কোনো পরামর্শ দান করেছেন কি-না এবং করে থাকলে কী পরামর্শ দান করেছেন, কোনো আদালতকে সে বিষয়ে কোনো প্রশ্নের তদন্তের অধিকার দেয়া ছিল না। রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কিংবা সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যদের মধ্য থেকে একজন প্রধানমন্ত্রী এবং তার কাছে যেরূপ আবশ্যক মনে হতো সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা ভোগ করতেন, যদিও কোনো প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী পরিষদের সদস্য হওয়া থেকে বারিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করতেন অথবা তিনি সেসব সভায় উপ-রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতিত্ব করতে নির্দেশ দিতে পারতেন। মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির সন্তোষানুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকতেন। রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে কোনো মন্ত্রী স্বীয় পদ ত্যাগ করতে পারতেন।
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত ছিল এবং সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রত্যক্ষভাবে অথবা তার অধীনস্থ কর্মচারীর মাধ্যমে প্রযুক্ত হতো।
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার বিধান ছিল। কিন্তু আমাদের বর্তমান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হন। বর্তমান সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সবার ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করলেও প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রযুক্ত হয়। সংসদীয় পদ্ধতির বর্তমান সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকে। এ ব্যবস্থায় সরকারের সব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নামে গৃহীত বলা হলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে কোনো নির্বাহী ক্ষমতা ভোগ করেন না। যদিও অনুচ্ছেদ নং ৪৮(৩)-এর বিধান অনুযায়ী বলা আছে, সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ছাড়া রাষ্ট্রপতি তার অন্যসব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে উভয় বিষয়ে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ একেবারে সীমিত। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে যে সংসদ সদস্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন, তাকে ছাড়া অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং এখানে রাষ্ট্রপতি তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নন এমন কাউকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন না।
অনুরূপভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ তাকেই দু-একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হয়ে আসছিল। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হলে এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু জ্যেষ্ঠকে অতিক্রম করে কনিষ্ঠ কাউকে যদি প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হয় সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগে নাকি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তা করা হয়েছে সে প্রশ্নটি এসে যায়।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সংসদ আগে ভেঙে না দিয়ে থাকলে প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে পাঁচ বছর অতিবাহিত হলে সংসদ আপনাআপনি ভেঙে যাবে। কিন্তু প্রজাতন্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কারণে সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি আবশ্যক বিবেচিত হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া তা কার্যকর করার সুযোগ নেই।
সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর এবং সংসদের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে যুদ্ধাবস্থা বিদ্যমানতার জন্য ভেঙে দেয়া সংসদ পুনরাহ্বানের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেয়া আছে। কিন্তু এ ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর রাষ্ট্রপতি কিভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেবেন? এ বিষয়ে সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদে দেখা যায়, একজন সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়া পরবর্তী পদত্যাগ অথবা সংসদ সদস্য পদে বহাল না-থাকা অথবা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন হারানোর কারণে তার পদ শূন্য হলেও তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল থাকেন। সুতরাং এক্ষেত্রেও সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের ব্যত্যয়ে রাষ্ট্রপতির কোনো ধরনের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ নেই।
মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়োগ, মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টন, সাংবিধানিক পদসহ প্রজাতন্ত্রের উচ্চতর সামরিক-বেসামরিক পদগুলোয় নিয়োগ, সংসদ অধিবেশন আহ্বান ও সমাপ্তি প্রভৃতি রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সম্পাদন করে থাকেন। এর কোনোটির ক্ষেত্রেই কখনও কোনোরূপ স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার অধীনে রাষ্ট্রপতিকে সাংবিধানিকভাবে দেয়া হয়নি।
একজন প্রধানমন্ত্রী সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন থাকাবস্থায় অপর কোনো সংসদ সদস্যকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের সুযোগ যেমন নেই, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংসদ ভেঙে দেয়ারও সুযোগ নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সংসদ সদস্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন না হলে সংসদ ভেঙে দেয়ার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতির প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের প্রয়োজন হবে। তাই এক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপতি যে কোনো অবস্থায়ই কোনো ধরনের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে সাংবিধানিকভাবে বারিত ।
সংবিধানে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। অনুরূপভাবে স্পিকারের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে একজন সংসদ সদস্যের স্পিকারের দায়িত্ব পালনের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে কে তার দায়িত্ব পালন করবেন সে বিষয়ে সংবিধান নিশ্চুপ থাকায় প্রধানমন্ত্রীর নিরংকুশ ক্ষমতা তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, একদিকে তার কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই, আর যে দুটি বিষয়ে তাকে একক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাও প্রকৃতপক্ষে স্বেচ্ছাধীন না হওয়ায় সব বিষয়ে কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব বিবেক ও বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতা যেন কোনোভাবে ক্ষুণ্ন না হয় সে বিষয়টিকে মাথায় রেখে যেমন তার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালনের জন্য কাউকে যোগ্য করা হয়নি, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে যোগ্য করায় তার ক্ষমতা সীমিত, সর্বোপরি তিনি সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সংবিধানে বর্তমানে যে বিধান রয়েছে তা হলো- মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিন আগে এবং মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য যে কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিন পর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী এ দুটি সময়ের যে কোনো একটি সময় হল অন্তর্বর্তী সময় এবং এ অন্তর্বর্তী সময়ে সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র অনুসৃত হওয়ায় প্রায় সব দেশেই মন্ত্রিসভা স্বল্পসংখ্যক সদস্য নিয়ে শুধু সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে এবং কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
জনগণের পরোক্ষ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় নিজ বিবেক ও বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগে এককভাবে কোনো ধরনের নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হওয়ায় তার পদটি যে ঠুঁটো জগন্নাথ এ বিষয়ে কি কোনো বিতর্কের অবকাশ আছে? আর নেই বলেই তো দেখা গেছে, সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত একজন ব্যক্তি সংবিধান লংঘন করা সত্ত্বেও তাকে উচ্চতর সাংবিধানিক পদে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের বিপরীতে রাষ্ট্রপতির পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, একজন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ২০০১ সালে বিজিত দলের নেত্রীর দাবি অনুযায়ী নির্বাচনের ফলাফল বাতিল না করায় তার দল থেকে প্রাপ্য সম্মান প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হচ্ছেন। ২০০২ সালে একজন রাষ্ট্রপতিকে কিছুটা স্বাধীনভাবে দলীয় আবরণের বাইরে চলতে গিয়ে অপরিপক্ব বিদায়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সর্বশেষ ২০০৯ সালে দলীয় বিবেচনায় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকালীন কর্মকাণ্ড দলের প্রতিকূলে বিবেচিত হওয়ায় ক্ষোভ, হতাশা ও অসম্মান নিয়ে তাকে ইহলোক ত্যাগ করতে হয়েছিল।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৪৮(৫)-এর বিধানে যে কোনো বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উপস্থাপনের কথা বলা হলেও তা প্রতিপালনের জন্য প্রধানমন্ত্রী বাধ্য নন। তাছাড়া যে কোনো অন্তর্বর্তী সময় ছাড়া অন্য কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা যদি প্রধানমন্ত্রীর মনঃপুত না হয় সেক্ষেত্রে তার অভিশংসনসহ বিভিন্ন হয়রানির আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই দেশের অন্তর্বর্তী অবস্থায় যে কোনো সংকটের সময় রাষ্ট্রপতি বিধানটির প্রয়োগে উদ্যোগী হলে তার মাধ্যমে দেশবাসীর প্রত্যাশা প্রতিফলনের অবকাশ সৃষ্টি হয়। স্বভাবতই অন্তত দেশের অন্তর্বর্তী সময় রাষ্ট্রপতির পদটি যে ঠুঁটো জগন্নাথ নয়, তার প্রমাণ তিনি রাখতে পারেন। আর এর মাধ্যমে তিনি যে কোনো বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারেন।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
(যুগান্তর)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন