প্রথমে বলে নিই, প্রবঞ্চিত শব্দের মানে কী? আমার বিশ্বাস, বেশির ভাগ পাঠকই জানেন। কেউ কেউ নাও জানতে পারেন। ছোট একটি শব্দের মানে না বোঝার কারণে অনেককে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। আমি নিজেও একবার মহা ঝামেলায় পড়েছিলাম এক সুন্দরী ললনার সাথে শব্দ বিভ্রাটসংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে। সেই কাহিনী বলব লেখার শেষ অংশে। এখন বলছি আমার এক বন্ধুর কাহিনী। বন্ধুটি ইংরেজি সাহিত্যে মহাপণ্ডিত। সারাক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলেন এবং কারণে অকারণে শেক্সপিয়ার, কীটস, মিল্টন, বায়রন কিংবা শেলীর বিভিন্ন উক্তি তুলে ধরেন। আমরা সময় পেলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক মাঠে গোল হয়ে বসতাম এবং চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র থেকে শুরু করে জোঁক, কেঁচো, বিড়াল নিয়ে আলোচনা করে নিজেদের পাণ্ডিত্য জাহির করতাম। সেদিনও কথা হচ্ছিল। বিষয় ছিল নারী কিংবা পুরুষ দেহের সৌন্দর্যের একক কোনটি। আমি বললাম, হিপ (HIP)। সবাই সমর্থন করল এবং আমার পণ্ডিত বন্ধুটি হিপ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করল না। কেবল বলল, নারী পুরুষের হিপ যদি সুন্দর, শক্ত ও মজবুত না হয় তবে তার জীবনই ব্যর্থ। কথাটি বলেই সে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
আড্ডা শেষে আমরা দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে হলে ফিরছিলাম আর মনের সুখে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছিলাম। হঠাৎ সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। জিজ্ঞাসা করলাম, কী হলো? সে বলল, যা হয়েছে তা যদি বলি তবে তুমি রাগ করবে। আশ্বস্ত করলাম যে রাগ করব না। সে বলল, আমি আসলে ‘হিপ’-এর অর্থ জানি না। আমি বললাম, হিপ অর্থ কোমর-ঊরু এবং ঊরুসন্ধির সংযোগ স্থলের জায়গা, যাকে আমরা এক কথায় বলতে পারি, কটি বা কটিদেশ। বন্ধুটি আরেক দফা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল এবং মহসীন হলের মাঠের দূর্বাঘাসের বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। বেশ কয়েকবার সেই উলুবনে নিজের কটিদেশ নিয়ে গড়াগড়ি খেল।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। প্রবঞ্চিত শব্দের অর্থ প্রতারিত। এটি একটি বিশেষণ। আপনি দু’ভাবে প্রবঞ্চিত হতে পারেন। প্রথমত, নিজের দ্বারা এবং দ্বিতীয়ত, অন্যের দ্বারা। নিজের দ্বারা প্রবঞ্চিত হওয়া হলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, মারাত্মক ও লজ্জাকর। আপনাকে যদি কেউ প্রবঞ্চিত করে তবে প্রবঞ্চনাকারী দুনিয়া ও আখেরাতে গুনাহের ভাগিদার হবে। কিন্তু আপনি যদি নিজেকে নিজেই প্রবঞ্চিত করেন, তবে গুনাহগার হওয়ার পাশাপাশি দুনিয়াতে আপনার দুর্ভোগের শেষ থাকবে না। মানুষ কিভাবে আত্মপ্রবঞ্চিত বা নিজের দ্বারা নিজেই প্রতারিত হয়? এর খুবই সহজ উত্তর এবং কমবেশি সবাই জানে। কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা হলো, প্রায় সবাই জেনেশুনে এবং খুশি মনে আত্মপ্রবঞ্চিত হতে থাকে। একবার নয়, বারবার। আরো অবাক করার বিষয় হলো, প্রতি ১০ লাখে মাত্র একজন মানুষ নিজেকে আত্মপ্রবঞ্চনা থেকে রক্ষা করতে পারে। আর এ ধরনের মানুষকে বলা হয় মহামানবÑ তারাই হন ওলি আল্লাহ, গাউস, কুতুব, পীর-মাশায়েখ বা ইতিহাস বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক, কবি, দার্শনিক কিংবা সাহিত্যিক অথবা বিজ্ঞানী।
অনাদিকাল থেকেই মানুষ নিজের দ্বারা প্রতারিত হয়ে আসছে, আবার অন্যের দ্বারাও কম হচ্ছে না। সাধারণত নির্বুদ্ধিতা বা বোকামির কারণে মানুষ আত্মপ্রবঞ্চিত হয়। কখনো কখনো আবার অতি উৎসাহ, অতি মাত্রার আবেগ কিংবা আত্মবিশ্বাস মানুষকে প্রবঞ্চিত করে। অন্যের দ্বারা প্রবঞ্চিত হওয়ার কারণ দু’টি। এক. অহঙ্কার এবং দুই. চাটুকারিতা। আপনি যদি রূপবান বা রূপবতী হন অথবা ধনবান-ধনবতী হন তাহলে নিজের অজান্তে শত শত চাটুকার সকাল-সন্ধ্যায় আপনার মধুকুঞ্জে ভিড় করবে। তাদের হাজারো প্রশংসাবাক্য আপনার মাথা খারাপ করে দেবে। ফলে আপনি উঠতে বসতে ভুল করতে থাকবেন।
আপনার জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে তখন, যখন আপনি কোনো রাজপদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। আর যদি আপনি কোনো রাজাধিরাজ কিংবা মহারানী হন তাহলে তো কথাই নেই। প্রবঞ্চনার পঙ্গপালেরা সব দলবেঁধে আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, ঠিক দঙ্গল মাছিরা যেভাবে কাঁঠালের ওপর আক্রমণ চালায়। এসব পঙ্গপাল নানা বর্ণ, গোত্র ও আত্মীয়তার পরিচয়ে আপনার সামনে আসবে। কেউ বলবে, আমি আপনার পিতার বন্ধু, ভাইয়ের সতীর্থ, বোনের দেবর, মেয়ের শ্বশুর, মায়ের ভাই, শ্বশুরকুলের বান্ধব কিংবা আপনার সহপাঠী। অন্যরা বলবে, আমরা আপনার ক্রীতদাস, আমরা বড়ই কাঙ্গাল, আপনার উচ্ছিষ্ট খেয়েই বেঁচে আছি যুগ যুগ ধরে এবং আপনি আমাদের ভগবান বা ভগবতী।
আপনার প্রথম দিকে বেশ লজ্জা লাগবে এসব কথা শুনতে। তারপর ধীরে ধীরে গা-সওয়া হয়ে যাবে। একসময় আপনার অবচেতন মন আপনাকে জানান দেবে যে, ওসব স্তুতিবাক্য আপনার প্রাপ্য এবং ওরা যা বলছে, তা পুরোপুরি সত্য। এভাবে চলতে চলতে পরিস্থিতি একদিন এমন হবে যে, সাতসকালে উঠে ওদের বদনখানি না দেখলে এবং ওদের কথাবার্তা না শুনলে আপনার দিনটিই মাটি হয়ে যাবে, আবার ঘুমানোর আগে ওসব না দেখলে বা না শুনলে আপনার ঘুমই আসবে না।
বিশ্বাস করুন, আমি যা বলছি তার একবিন্দুও আমার বানানো কথা নয়। জ্ঞানী-গুণী-ঋষীরা এসব কথা বলে গেছেন, অসংখ্যবার। আমি শুধু পুনরায় উচ্চারণ করলাম। যদি আরো জানতে চান তাহলে বলছি, চাটুকারিতা শুনতে শুনতে একসময় আপনি যখন অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন, তখন চাটুকারেরা নিজেদের রাজা-বাদশাহ বা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বলে ভাবতে শুরু করবে, আর আপনাকে তারা মনে করবে তাদের হুকুম তামিলকারী প্রজা-দাস বা দাসী। কি, অবাক হচ্ছেন! এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ এটিই সত্য। একটি সময় আপনার দেহ-মনেও চাটুকারিতার কুফল ধরা পড়বে। আপনি অলস হয়ে পড়বেন। বিনা কারণে আপনি রেগে যাবেন আবার তেমনি বিনা কারণে খুশিতে গদগদ হয়ে খিলখিলিয়ে হাসতে থাকবেন। আপনি অকারণে অনেককে শাস্তি দেবেন আবার বিনা কারণে অনেককে পুরস্কৃত করবেন। আপনার কাছ থেকে যারা পুরস্কার পাবে তারা কেবল আপনার খেয়াল খুশির কারণেই পাবে, কোনো কর্মের জন্য নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো পুরস্কারপ্রাপ্তরা কেউ আপনার প্রথম শ্রেণীর চাটুকারও হবে না কিংবা আত্মীয় পরিজন-শুভানুধ্যায়ীও হবে না। তারা প্রায়ই হবে অজ্ঞাত, অপরিচিত ও অখ্যাত। ফলে এসব লোকের পুরস্কারপ্রাপ্তিতে আপনার চাটুকারেরা মহা বিরক্ত হবে এবং তলে তলে আপনার বারোটা বাজানোর জন্য ষড়যন্ত্র করবে।
আপনার আশপাশের লোকগুলো কি চাটুকার? কিংবা আপনি কি আত্মপ্রবঞ্চিত, নাকি প্রবঞ্চিত। এসব আপনি বুঝবেন কী করে? আপনার সহজ উপলব্ধির জন্য জ্ঞানী-গুণীরা কিছু উপায় বের করেছেন। এখন তারই কয়েকটি উপায় আপনার জন্য পেশ করছিÑ
১. আপনি প্রথমে নিজের দিকে তাকান। তারপর স্মরণ করুন নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, শিক্ষার মান, সময়কাল। এরপর নিজের পারিবারিক জীবনের সফলতার কথা চিন্তা করুন। আপনার বাবা-মা-ভাইবোন, স্বামী কিংবা স্ত্রী এবং অতঃপর পুত্রকন্যারা আপনাকে কতটা জ্ঞানী, চরিত্রবান, মেধাবী আর প্রজ্ঞাবান মনে করে, এসব ভাবুন।
এবার উল্টোরথে আপনি আপনার চাটুকারদের কথাগুলো স্মরণ করুন। তারা যদি উপরিউক্ত বিষয়ের কোনো একটিকে অতিক্রম করে সে ক্ষেত্রে আপনি ধরে নিতে পারেন ওরা আপনাকে প্রবঞ্চিত করছে।
২. আপনার বাল্যকালের প্রথম ১০ বছরের স্মৃতি স্মরণ করার চেষ্টা করুন। জন্ম থেকে ১০ বছর অবধি যে পরিবেশ আপনি পেয়েছেন তা আমৃত্যু আপনাকে বহন করে যেতে হবে। ওই সময় যদি আপনি সুষম খাদ্য গ্রহণ করে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হনÑ ধরে নিতে পারেন পরবর্তী জীবনে আপনি মোটামুটি রোগমুক্ত থাকতে পারবেন। ওই সময় যদি আপনি রোগাক্রান্ত, দারিদ্র্যপীড়িত এবং আশপাশের লোকজন কর্তৃক নিগৃহীত, অবহেলা বা তাচ্ছিল্যের শিকার হন তবে পরবর্তী জীবনে আপনি যত বড় মানুষই হন না কেনÑ নিজের অজান্তে আপনি লোকজনকে নিগৃহীত, অপমানিত ও অবহেলা করতে থাকবেন। ফলে ধরে নিতে পারেন, আপনার আশপাশের কোনো লোকই আপনার প্রতি খুশি থাকতে পারবে না। তারা সময় ও সুযোগ পেলেই আপনার শত্রুদের সাথে হাত মেলাবে বা ইতোমধ্যেই মিলিয়ে ফেলেছে।
নিজের অভ্যাস ও পরিণতির কথা খেয়াল করতে করতে আপনি আশপাশের লোকজনের দিকে তাকান। তারা যদি আপনার ব্যবহারে বিরক্ত হওয়ার পরও হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে কিংবা আপনার ব্যবহারে প্রীত থাকার পরিবর্তে মুখ ভার করে থাকে, তবে ধরে নিন আপনি প্রবঞ্চিত হচ্ছেন।
৩. আপনার জন্মের সময় যাদের বংশমর্যাদা, আর্থিক সঙ্গতি এবং সামাজিক প্রভাব আপনার তুলনায় বেশি ছিল, সেসব লোকজন মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও মন থেকে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব, আভিজাত্য, পদ-পদবি এবং সুকর্মগুলোকে মেনে নেবে না। তারা সর্বদা এমন কথাই বলবে, আরে রাখো, ওরে চিনি, ছোটকালে পেটভরা কৃমি ছিল, নাক দিয়ে সারা দিন সর্দি ঝরত, চোখে ময়লা ভরা থাকত, মাঝে মধ্যে কান দিয়ে পুঁজও পড়ত। হাফপ্যান্ট পরত, আর প্যান্টের পেছনটা থাকত ছেঁড়া। কাসে লেখাপড়া পারত না; তাই পণ্ডিত মশায়ের রোজ কানমলা খেত। এখন বড় হয়ে ভাব দেখাচ্ছে, ওমুকের বেটি বা ওমুকের নাতিÑ চিনি না! একবেলা ভাত পেত কি না সন্দেহ কিন্তু রোজ দু’বেলা ফ্যান (ভাতের মাড়) খেতো।
যেসব লোকের কথা বললাম তারা যদি কোনোক্রমে আপনার অধীনস্থ হয়ে যায় এবং কথায় কথায় আপনার আনুগত্য দেখায় তবে নিশ্চিত ধরে নিতে পারেন, লোকগুলো চাটুকার এবং তারা আপনার সাথে প্রবঞ্চনা করছে।
৪. আপনার আশপাশের লোকজনের আচার-আচরণ, ব্যবহার, কথাবার্তা এবং অঙ্গভঙ্গির একটি সাধারণ নমুনা তৈরি করুন। তারপর লক্ষ করুন, কোন লোকটি বেশি শুদ্ধ করে কথা বলার চেষ্টা করছে। কোন লোকটি কথা বলার সময় হাত কচলাচ্ছে কিংবা মাথা চুলকাচ্ছে। কে অতিরিক্ত বিনয় দেখাতে গিয়ে আপনার সামনে বসতে চাচ্ছে না। বসলেও বেড়ালের মতো কাঁচুমাচু করছে। আবার কোন লোকটি আপনার চোখের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে আনুগত্য প্রকাশের কসরৎ করছে। কাউকে হয়তো দেখবেন, পায়ের ওপর পা তুলে (Cross Leg) অতিরিক্ত আধুনিকতার ভান করছে এবং হাত নেড়ে, ঘাড় বাঁকিয়ে, মাথা ঝুলিয়ে আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। আপনি ধরে নিতে পারেন, এরা সবাই ভণ্ড ও প্রতারক।
৫. আপনি লক্ষ করবেন, কিছু লোক সবসময় অদ্ভুত পোশাক পরে থাকে। আবার কিছু গরিব বড় লোকের পোশাক পরে এবং ধনীরা গরিবের পোশাক পরে। হাতের বিভিন্ন আঙ্গুলে হরেকরকম পাথুরে আংটি লাগায়। হাত-পায়ের বাড়তি নখ নিয়মিত কাটে না এবং সেগুলোকে অপরিচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করে। দাড়ি-মোচের কোনো আগামাথা থাকে না এবং চুলও থাকে অবিন্যস্ত। অপরিচ্ছন্ন দাঁত, মুখের গন্ধ, ঘামের গন্ধ এবং জুতার গন্ধে আশপাশের পরিবেশ নষ্ট করে ফেলে। টাকমাথাওয়ালা লোকজনের কাউকে কাউকে দেখবেন নিয়মিত টাকে তেল মাখতে আবার কাউকে কাউকে দেখবেন পরচুলা পরতে। কারো নাকের পশম বা কানের পশম গোখরা সাপের মতো কখন যে ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তা লক্ষ করার প্রয়োজনই নাক কানের মালিকেরা অনুভব করেন না।
এই লোকজন কোনোমতেই নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হতে পারে না। জেনে হোক কিংবা না জেনে হোক, ওই ধরনের লোকদের দিয়ে যদি কাজকর্ম করান তবে আপনার আত্মপ্রবঞ্চনার জন্য কাউকেই দায়ী করতে পারবেন না।
৬. যেসব লোক আপনার চেয়ে বেশি শিক্ষিত তারা যদি নিজেদের মতামত আপনার কাছে গোপন রাখে এবং সব সময় আপনার বক্তব্য অন্ধের মতো সমর্থন ও অনুসরণ করে, তবে ধরে নেবেন আপনি মহা সঙ্কটে আছেন। কথা বলার সময় যদি লোকজন ঘনঘন চোখের পলক ফেলে, হালকা কাশি দেয়ার চেষ্টা করে, অতিরিক্ত ঢোক গিলতে চেষ্টা করে এবং নিজের অজান্তে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয় বা আশপাশের জিনিসপত্র নিয়ে নাড়ানাড়া করে, সে ক্ষেত্রে আপনার অবিশ্বাস করার কোনো কারণই নেই যে, লোকটি কোনো কিছু আড়াল করছে বা প্রতারণার চেষ্টা করছে।
৭. আপনাকে দেখিয়ে দেখিয়ে যারা আপনার অনেক কিছু অনুসরণ বা অনুকরণ করার ভাব দেখায়, তারা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ প্রকৃতির মানুষ। অন্য দিকে, যারা মদ্যপ বা নেশাগ্রস্ত, ঘুষখোর, চরিত্রহীন কিংবা বহুগামী বা বহুগামিনী এবং মিথ্যাবাদীÑ তারা জমিনে আল্লাহ পাকের অভিশাপ বহনকারী এবং ইবলিসের প্রতিনিধি। এসব লোকজনকে নিয়ে যদি আপনি জীবনসমুদ্র পাড়ি দেয়ার আয়োজন করে থাকেন, তবে আপনার পতন ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।
আত্মপ্রবঞ্চনা, প্রবঞ্চনা ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আপনাকে রপ্ত করতে হবে মানুষের অঙ্গভঙ্গির ভালোমন্দ দিক। জানতে হবে কিছু দৈহিক ভাষা এবং বিশেষ করে অর্থ জানতে হবে অনেক শব্দের। একটিমাত্র শব্দের ভুল প্রয়োগ কিংবা একটিমাত্র শব্দের গুরুত্ব না বোঝার কারণে আপনার সারা জীবনের অর্জন বৃথা যেতে পারে কিংবা সারা জীবন যে সম্পর্কটি ধরে রেখেছেন তা ভেঙে যেতে পারে মুহূর্তের মধ্যেই। আমার ব্যক্তিগত জীবনে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল একটি মাত্র শব্দের অর্থ না বুঝে মন্তব্য করার জন্য।
ঘটনাটি প্রায় বছর বিশেক আগের। সম্ভ্রান্ত এবং অতিশয় সুন্দরী এক মেয়ের সাথে আমার ভারি বন্ধুত্ব। টেলিফোনে অনেক কথাকথিÑ নিষ্পাপ আলোচনা, বেশির ভাগই সমসাময়িক ব্যাপার-স্যাপার। মেয়েটি একদিন টেলিফোন করে বলল, তার বড় ভাইয়ের সাথে আজ তার বেশ ঝগড়াঝাটি, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে পারিবারিক বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে। একপর্যায়ে ভাইটি তাকে লাথি মারে এবং তার একটি অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ফেটে যায়। ফলে তাকে প্রায় এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। মেয়েটি তার অঙ্গটির নাম বলেছিল; কিন্তু আমি সঠিক উচ্চারণ বুঝতে পারিনি। আমি শুনেছিলামÑ উটাস। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললাম। বলেন কী! আপনার ভাই আপনার উটাসে লাথি মেরেছে! আপনি কেন লাথি মেরে তার উটাস ফাটিয়ে দিলেন না।
ফোনের ওপাশের মেয়েটি আমার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু বলল, ছেলেদের উটাস হয় নাকি? রনি ভাই, আপনিও আমার কষ্ট নিয়ে ঠাট্টা করলেন! বলেই সে ফোনটা রেখে দিলো। সেই যে দিলো, আজ অবধি তার সন্ধান পেলাম না। এদিকে মেয়েটির ফোন রেখে দেয়ার পর আমার হুঁশ হলো। খুব জানতে ইচ্ছে হলোÑ আচ্ছা উটাস কী? কেন মেয়েদের শরীরে উটাস থাকে এবং কেনইবা ছেলেদের শরীরে থাকে না? নিজের অজ্ঞতার জন্য ভারি লজ্জা হলো। আশপাশের অনেক নারী-পুরুষ বন্ধুবান্ধবকে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, উটাস কী? কেউ জবাব দিতে পারল না। এদিকে উটাসের চিন্তায় রাতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত হতে থাকল। আমার কয়েকজন ডাক্তার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম ধাঁধার আকারে। বলো তো এমন কী অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ রয়েছে নারী দেহে, যা পুরুষের নেই। তারা অনেক ভাবল এবং দু-একটা অঙ্গের নাম বলল। কিন্তু উটাস সম্পর্কে কিছুই বলল না। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বললাম, আচ্ছা নারীদের উটাস কী? তারা বলল, এই নামে কিছুই নেই। আমি আরো হতাশ হয়ে পড়লাম।
আমার ডাক্তার বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিল খুবই মেধাবী এবং চৌকস। সে এতক্ষণ চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিল। সবার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর সে বলল, শব্দটা ভুল। এটি হবে ইউটেরাসÑ মানে জরায়ু। তারপর সে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করল। আমি বুঝলাম বটে কিন্তু লজ্জা আর অপমানে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। বন্ধুরা হয়তো সেদিন আসল ঘটনা জানতে পারেনি। কিন্তু আজ আমার ভুলটি সবাইকে জানিয়ে দিলাম, যাতে কেউ ভুল শব্দের খপ্পরে পড়ে আত্মপ্রবঞ্চিত না হয়।
(নয়া দিগন্ত)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন