মোটা বুদ্ধির মানুষদের মাথায় ম্যাক্রো-মাইক্রোর মারপ্যাঁচ সহজে ঢোকার কথা না। বিড়ালকে কোনো এলাকায় মেকুর বলার চল এখনো আছে। বিড়াল বাঘের মাইক্রো সংস্করণ; সে কারণে কি না তা আলেফ মিয়া মাঝেমধ্যে ভাবে। শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় নিয়ে মাথা ঘামায় এমন অধ্যাপকের সঙ্গে মোটামুটি ঘণ্টাতিনেকের মতো সময় কাটালেই আলেফ মিয়া মনে করে, তাবত শব্দ তাদের জাত-কুল, মান-সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য হয়তো তার বিরুদ্ধেই রিট মামলা জুড়ে দিতে তেড়ে আসতে চাইবে। গবেষণা শব্দটি তো সেদিন খুব মাইন্ড করে বসল, যখন সে শুনল, গবেষণার সন্ধিবিচ্ছেদ হলো গো+এষণা। গো মানে গরু, এষণা মানে খোঁজা। এভাবেই গবেষণা শব্দটি ধরাধামে এসেছে। অর্থাৎ ভদ্র ভাষায় বলতে গেলে গরু খোঁজার কাজই হলো গবেষণা, তাহলে এত সব সম্মানীয় গবেষক যাঁদের দেশের তো বটেই, নোবেল কমিটির লোকরা পর্যন্ত সম্মান ও সমীহ করে তাহলে তাঁদের মানসম্মান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? সারণি সারসংক্ষেপ হাইপোথিসিস-হাইথট পর্যালোচনা-পর্যবেক্ষণ নিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ল্যাবে যাঁদের দিন কাটে, তাঁদের কিনা গুরুর গরু খোঁজার কাজে হতভম্ব গরুর রাখালের পর্যায়ে নিচে নামানো? গবেষণার ইংরেজি প্রতিশব্দ রিসার্চ, এখানে বারবার সার্চ বা খোঁজাখুঁজি করার মধ্যে মানসম্মান মোটামুটি চলার মতো থাকে বলে মনে হয়।
আলেফ মিয়ার এক প্রশিক্ষক গুরু সুদূর জার্মানি থেকে তার কাছে একবার জানতে চেয়েছিলেন, 'মাঠে মারা যাওয়া' কথাটির ব্যুৎপত্তি কী? বেশ বিব্রতকর প্রশ্ন। মানুষ মাঠে মারা যাবে কেন এবং দৈবাৎ দু-একজন ঘটনাচক্রে মারা গেলেই বা কী? তাকে বাক্যবিন্যাস বিধিমালার আওতায় এনে, অনেকটা ৫৪ ধারার মতো, ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করার প্রয়াস কেন? অনেক পরে নওগাঁর জেলা প্রশাসকের কাছে জানা গেল, এই শব্দ তিনটির পয়লা ব্যবহারকারী হলেন নোবেলবিজয়ী বিশ্বকবি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পতিসরে রবিবাবু কৃষিকাজে নোবেল থেকে পাওয়া বেশ কিছু টাকাকড়ি বিনিয়োগ করেছিলেন, ছেলে রথীনকে মার্কিন মুলুক থেকে কৃষিপাঠ দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, কৃষকদের কৃষিঋণ বা পুঁজির জোগান দিতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তখনো জন্মগ্রহণ করেননি, এমনকি কৃষি ব্যাংকের খোদ চেয়ারম্যান মহোদয়ের পিতাও মনে হয় তখন...! যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ মাঠে কৃষকের কাজে টাকা-পয়সা বিনিয়োগের যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তাতে 'পরি' ও 'কল্পনা' দুটোরই মনে হয় পুষ্টিহীনতা ছিল, যদিও তিনি নিজে কবি ছিলেন, ছিলেন কল্পনার রাজাধিরাজ। কবির মাঠের কৃষিকাজে বিনিয়োগ ব্যবসা সফল হয়নি। কাকে যেন লিখলেন, 'সমুদয় অর্থ মাঠে মারা গেল হে।' সেই থেকে ব্যর্থ প্রয়াসের প্রতিভূ শব্দাবলি হিসেবে মাঠে মারা যাওয়ার প্রচলন। নওগাঁর ডিসি সাহেবকে রবীন্দ্রনাথের সেসব কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর করার জন্য বিশেষ বাহবা দিতে হয়।
ম্যাক্রো-মাইক্রো
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শব্দের সম্মান-অসম্মান সমান তালে বাড়া-কমার মধ্যে আছে। রোড শো সাম্প্রতিককালে কোত্থেকে যেন আমদানি হয়েছে। মিডিয়া রোড শোকে রীতিমতো শো পিসে পরিণত করে ফেলেছে। আগে এত রোডও ছিল না আর সিনেমা হলের মর্নিং-ম্যাটিনি আর নাইট শোর ওপর তেমন কোনো শো-ই ছিল না। কুড়ি দুই বছর আগে গাঁও-গেরাম থেকে শহরে আসা আলেফ মিয়ার তাই মনে হয়। সেদিন এক রোড শো হলো নামকরা হোটেলের উইনটার গার্ডেনে। সেখানে সত্যিই কোনো রোড নেই, নেই কোনো গার্ডেন আর উইন্টার। কোথায় তা? রীতিমতো গরম জুলাই মাসের। কেউ আশা করে রাস্তা নির্মাণের ওপর কোনো সিনেমা সেখানে দেখতে গিয়েছিল কি না জানা যায়নি। আসলে সেসব কিছু নয়। একটা প্রপাগান্ডা জাতীয় কিছু দেখে আলেফ মিয়া ভাবল, এটা কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখার মতো অবস্থা আর কি! একই অবস্থা রোডম্যাপের বেলাতেও। রোডও নাই, ম্যাপও নাই; আছে কিছু হাবিজাবি তালিকা আর কর্মপরিকল্পনা। এর নাম রোডম্যাপ। যেমন-
'রাজা নেই শাহী নেই রাজশাহী নাম
হাতি ঘোড়া কিছু নেই আছে শুধু আম।'
যাক ম্যাক্রো-মাইক্রো দেখতে দুই ভাইয়ের মতো হলেও তাদের বাড়ি কিন্তু এ দেশে নয় এবং তাদের নাড়িনক্ষত্র ঘাঁটলে ভালো কিছু বের হবে বলে মনে হয় না। এখনো পর্যন্ত এই দুই বিদেশির উপযুক্ত প্রতিস্থাপনীয় বাংলায় পয়দা হয়েছে বলে শুনিনি। মাইক্রো প্রায়ই চুপচাপ থাকে। কেননা তার বেড় খুব কম, কন্ট্রোল কম, তবে সূক্ষ্মতার সুনাম তার আছে। আর ম্যাক্রো বেঢপ সাইজের, ইয়াবড় তার সব কিছু। সেদিন অর্থশাস্ত্রের এক অধ্যাপকের বাসায় গিয়ে আলেফ মিয়া দেখে তার গৃহপালিত বিড়াল আর কুকুরের নাম ম্যাক্রো-মাইক্রো। বেশ মজাদার ব্যাপার বটে। অধ্যাপকপত্নী আবার বাংলাসাহিত্যের; তিনি নাম দুটো পছন্দ না করলেও খারাপ লাগে না তাঁর বলে জানালেন। গাওয়া ঘি দিয়ে রান্না করা পোলাওয়ের স্বাদ যেমন মুখে সারাক্ষণ লেগেই থাকে, অর্থনীতির অধ্যাপকের মুখে ম্যাক্রো-মাইক্রো, তেমনি তাঁকে সারা দিন ব্যতিব্যস্ত রাখে। যিনি সামষ্টিক অর্থনীতি পড়ান, ম্যাক্রো-মাইক্রো তাঁর পিছু ছাড়বে কেন? তবে চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে ম্যাক্রো-মাইক্রো দুই ভাই একসঙ্গে এক জায়গায় বসতে পারে না, বসে চা খাওয়া তো দূরের কথা। মাইক্রো স্বভাবতই শান্ত প্রকৃতির, ম্যাক্রোর মেজাজমর্জির সঙ্গে তারটা ঠিকমতো যায় না। বঙ্গের এক সুশীল সেবক সুশীল শব্দচয়নে ম্যাক্রো-মাইক্রোকে বাংলার ঘরে ঘরে ঠাঁই দেওয়ার জন্য পিসিপি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এক অদৃশ্য কারণে তাদের দুজনের এক যাত্রায় অভিসারে যাওয়ার ফুরসত তৈরি করা যায়নি। ভাবখানা যেন এমন যে এতে সংবিধান লঙ্ঘনের রিস্ক থেকে যায়। আবার ভাবখানা এমন যে বঙ্গীয় সহ-অবস্থান আইনের পাঁচ ধারা লঙ্ঘন করে এই সহোদর শব্দদ্বয়কে এক পিঁড়িতে বসানো সংগত হবে না।
ম্যাক্রোর দৃষ্টি প্রসারিত, প্রলম্বিত ও প্রবহমান। সে তার বাহুতে, কাঁধে, মাথায় অনেক কিছু নিতে পারে। একসঙ্গে পাঁচটি ইঁদুর যেমন ধরা যায় না, ম্যাক্রোর কাছে তেমনি পরিশীলিত-পরিমার্জিত-পারিজাত কোনো কিছু চটজলদি আশা করা যায় না। তার সব ফলাফলই সময়সাপেক্ষ ও অনেক ফ্যাক্টর যাচাইযোগ্য। সামষ্টিক বলে ম্যাক্রোর একটা প্রতিশব্দ অনেক বলেকয়ে জোগাড় করা গেছে, তাও এপার বাংলায়, ওপার বাংলায় এখনো এককভাবে শব্দটির অন্নপ্রাসন হয়নি বলে মনে হয়। 'ম্যাক্রো ইকনোমিকস'কে সেখানকার সাহিত্য সংসদ তাদের ঢাউস ডিকশনারিতে 'বৃহত্তর একক বিদ্যাসংক্রান্ত অর্থবিদ্যা বা ধনবিজ্ঞান' বলে কোনো রকমে পার পেয়েছে। পক্ষান্তরে মাইক্রো ক্ষুদ্র বা অণু পর্যায়ের বলে তাকে একা একা রাস্তায় ছেড়ে দিতে কেউ রাজি না। মাইক্রোস্কোপ, মাইক্রোফিল্ম, মাইক্রোবায়োলজি, মাইক্রোফোন- এসব ডাকসাইটে শব্দমালার সঙ্গে মাইক্রোকে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সামষ্টিকের বিপরীতে ব্যষ্টিককে মানাবে ভালো, এই বিবেচনায় এপার বাংলায় মাইক্রোকে ব্যষ্টিক বলার চল শুরু হলো বলে ওপার বাংলায় মাইক্রোকে ক্ষুদ্র বা অতিক্ষুদ্র- এ রকম একটা তকমা (প্রত্যয়) দিয়ে অন্যের পরিচয় দেওয়ার জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন মাইক্রোবায়োলজি জীবাণুবিজ্ঞান, মাইক্রোস্কোপ অণুবীক্ষণ। আগেই বলেছি, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে মাইক্রোর কাজকারবার, যা কিছু করার তা ধীরস্থিরভাবে গভীর অভিনিবেশসহকারে করা তার ধর্ম। মনে হয় মাইক্রোর দিকে বিধাতার ঝোঁক বেশি। সে জন্য মাইক্রোর শব্দভাণ্ডার বেশি। ক্ষুুদ্র-অতিক্ষুদ্রকে নিয়ে যেহেতু মাইক্রোর কারবার, সেহেতু সে বেশ খানিকটা অন্তর্যামী, অন্তর্গামীও বটে। অনেকের সঙ্গে তাই তার আত্মীয়তা ও জানাশোনা বেশি। মাইক্রোওভেনে চটজলদি অনেক কিছু গরম করা যায়, মাইক্রোওয়েভে শব্দতরঙ্গ নিয়ে ভেলকিবাজি চলে, মাইক্রোচিপস মুঠোফোনে-কম্পিউটারে বিপ্লব ঘটিয়ে চলছে। গোটা দুনিয়াটা মাইক্রোচিপসের মধ্যে মোড়ানোর মওকা চলছে। মাইক্রোর জয়জয়কার সবখানে।
আলেফ মিয়ার কেন জানি তার নিজেরও মাইক্রোর প্রতি প্রেম-মহব্বত বেশি। হতে পারে তার দেশ বাংলাদেশ মাইক্রোক্রেডিটের দেশ বলে। সবাই জানে নোবেল বিজয় লাভ এই মাইক্রোর জন্যই ঘটেছে। বলা যায়, আজকের বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক বিশ্ব চিনেছে এই মাইক্রোর কারণে। মানুষ কেন, সব কিছুই তো ছোট থেকে বড় হয়। ম্যাক্রোলেভেলে কথা বলে কূলকিনারা মেলে না সহজে, আব্বাস উদ্দীনের গানের মতো 'আমি কোন কূল হতে কোন কূলে যাব...।' ঢাউস বাসে চেপে হট্টগোলে নয়, মাইক্রোবাসে চড়ে প্রেমের মধুপুরে যাওয়ার চেষ্টাই যেন শ্রেয়।
আলেফ মিয়ার চার পাশে এখন ম্যাক্রো-মাইক্রো উভয় খাতেই বিপত্তির বহর। আলেফ মিয়ারা যারা দিন এনে দিন গুজরান করে, আমজনতা যারা, চুনোপুঁটি যারা, তারা সাম্প্রতিক সময়ে বড় বড় রাঘব-বোয়ালের প্যাঁচানো প্যাঁচালে পড়ে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থায়। আলেফ মিয়া শুনেছে, এ সবই নাকি তাদের ভালোর জন্য। কিভাবে? মোটাবুদ্ধির আলেফ মিয়াদের তা বুঝে আসে না। তারা দেখেছে, গত ৪২ বছরে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের নামে কত কথার ফুলঝুরি ঝরিয়ে, মাইক্রোদের মাথায় হাত বুলিয়ে ম্যাক্রোরা মোটা হয়েছে। যদিও মাইক্রোরা শুনেছে, সব ক্ষমতার উৎস নাকি আমজনতা এবং ক্ষমতায় থাকলে নাকি সম্পদ বৃদ্ধি পায়। কিন্ত কই? মাইক্রোর ভাগ্য ও সম্পদ ম্যাক্রোতে পাচার হয়েছে। ম্যাক্রো সেবক সেজেছেন মাইক্রো ভক্ষণে। সবার ভাগ্য কতিপয়ের ভাগ্যে পাচার হয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে ভাগ্যাহতদের আরো ভাগ্যহীন হওয়া। আর ম্যাক্রোর এই মাইক্রোভাগ্য হরণ ও আত্মসাতের সর্বনাশা প্রয়াস প্রচেষ্টায় প্রাণ যাচ্ছে প্রান্তিকের।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন