|
জসিম উদ্দিন
|
|
গুমের দেশে ভেঙে পড়েছে নাগরিক নিরাপত্তা
24 May, 2014
গুমের দেশে ভেঙে পড়েছে নাগরিক নিরাপত্তা
জসিম উদ্দিন
২৪ মে ২০১৪, শনিবার, ৯:০৫
গুমের নগরী নারায়ণগঞ্জের একজন সিটি কাউন্সিলর লিখেছেন, ‘শুভাকাক্সী সবাই দীর্ঘ দিন ধরে প্রতিদিনই রুটিনমাফিক বলেন, সাবধানে থাকবেন। একা বের হবেন না, সাথে লোকজন রাখবেন। সন্ধ্যার পরে কোথাও যাবেন না। দেশের আইনশৃঙ্খলা ও সরকারের কাণ্ডজ্ঞানের বেহাল অবস্থা দেখে আমিও যথারীতি নগর ভবন থেকে শুরু করে কোথাও একা যাই না, সাথে কয়েকজন থাকেন। সন্ধ্যার পর বাইরে কম থাকার চেষ্টা করি। আমার এই নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে পরিবার ও শুভাকাক্সীদের সাথে আমি নিজেও নিজেকে কিছুটা নিরাপদ মনে করি। গুম হয়ে গেলে সরকার যেহেতু কোনো দায় নেয় না, কিংবা গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে উদ্ধার অথবা অপহরণকারী, খুনিকে গ্রেফতারে তৎপর হয় না, যখন একটি পরিবার বছরের পর বছর জানতেও পারে না তার বাবা, সন্তান, ভাই কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি না; কিংবা তার শেষে পরিণতিই বা কী হয়েছিল? এভাবে দেশে গুম থেকে বাঁচার কৌশল আয়ত্ত করার চেষ্টা করছিলাম।
২৭ এপ্রিল আমার নিরাপত্তা দেয়ালে চিড় ধরে আর ৩০ এপ্রিল সে দেয়াল ভেঙে পড়ে শীতল্যার বুকে। গুম হওয়া থেকে বাঁচার জন্য আমি যে দু’টি পদ্ধতি অবলম্বন করে নিজেকে নিরাপদ মনে করতাম, সেই টিপস দু’টি কাউন্সিলর নজরুলও ব্যবহার করেছিলেন। নজরুল একা বের হননি, তার সাথে চারজন সঙ্গী ছিলেন। এরা অপহরণের শিকার হয়েছিলেন, বেলা ২টা ৪০ মিনিটে, দিনের আলোতে। ফলে নিরাপত্তা টিপস দু’টি অসার প্রমাণিত হয়। আমি রহস্যের কিনারা করতে পারি না। দিনদুপুরে একজন সিটি কাউন্সিলরসহ সাতজন (সম্ভবত অপহরণকারীদের দেখে ফেলায় আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক জাহাঙ্গীরসহ) মানুষ মহাসড়ক থেকে অপহরণ হয় কিভাবে? আমি ভাবি সৈয়দা রেজোয়ানার স্বামী এ বি সিদ্দিক একা ছিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় গাড়ি থেকে নেমেছিলেন, তাকে হয়তো ছয়-সাতজন হাত-পা ধরে টেনে গাড়িতে তুলে নিয়েছিল অপহরণকারীরা। কিন্তু সাতজন মানুষকে দু’টি গাড়ি থেকে নামিয়ে অন্য গাড়িতে তুলে অপহরণ করাটা কিভাবে সম্ভব? ঘটনার সাী থাকার কথা। কিন্তু চাুস সাীও নেই। তাজ্জব ঘটনা। গুমকারী টিমের সদস্যদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নারায়ণগঞ্জের এই কাউন্সিলরের রক্ত হিম করে দিয়েছে। এত প্রস্তুতির পরও যদি কেউ নিজেকে নিরাপদ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে আর কী ব্যবস্থা একজন মানুষের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
ফুলগাজীর উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকের হত্যা নাগরিক নিরাপত্তার অবস্থা কত দূর ভঙ্গুর তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলো। উপজেলা চেয়ারম্যানের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিও তিনি। ফেনীর গডফাদার জয়নাল হাজারীর পতনের পর মুষ্টিমেয় যে ক’জনের কাছে জেলাটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার অন্যতম ছিলেন একরাম। বর্তমান সদর আসনের এমপি নিজাম হাজারীর পরই জেলার দ্বিতীয় প্রধান প্রভাবশালী ব্যক্তি তিনি। নিজ উপজেলার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ফেনী সদরেও তিনি প্রভাবশালী ছিলেন। নিজাম হাজারীর চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে সেখানে তার বেশি প্রভাব ছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডার ও সরকারি কাজের একচেটিয়া প্রভাব খাটাতেন তিনি।
ক্ষমতাধর এ ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যটি অভাবনীয়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে জনাকীর্ণ রাজপথে তার ওপর আক্রমণ করা হয়। দুর্বৃত্তরা কয়েকটি স্তরে বিভক্ত হয়ে তার ওপর হামলা চালায়। একদল গাড়ির গতি রোধ করে, অন্য একটি দল গুলি ছোড়ে। কমপক্ষে আরো দু’টি দল ছিল। যাদের একদল পেট্টলবোমা ছুড়ে মেরেছে অন্য দল কিরিচসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে একরাম ও তার সঙ্গীদের ওপর হামলা করেছে। এ ধরনের একটি সন্ত্রাসী অভিযান করতে যেমন বেশি জনবল দরকার তেমনি অনেক সময় নিতে হয়েছে তাদের। এ সময় স্থানীয় লোকেরা আক্রমণকারীদের দেখেছে। ছোট এই শহরে একজন অন্যজনের পরিচিত। চিনে ফেলার যে একটা ঝুঁকি রয়েছে সন্ত্রাসীরা তা-ও আমলে নেয়নি। ওই উপজেলার আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হককে ১৯৯৬ সালে দল ক্ষমতায় আসার পরপরই নৃশংসভাবে খুন করা হয়। তিনি এলাকায় জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। সেই হত্যাকাণ্ডে একই দলীয় একজন ব্যবসায়ী গডফাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। সরকার তখন হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। একরামের হত্যার বিচার নিয়ে তার ভাই ইতোমধ্যে মন্তব্য করেছেন, ‘একটি মামলা করার তাই করেছি।’
ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী একজন নেতা তার জীবনের নিরাপত্তা পাননি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ হচ্ছে সারা দেশে তাদের অসংখ্য নেতাকর্মী হত্যা, গুম, খুনের শিকার হচ্ছেন। মিডিয়ায় প্রতিদিন এ ধরনের বীভৎস পৈশাচিকতার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের বিগ ট্র্যাজেডির পর এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল এবার ক্ষমতাসীনেরাও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য দলীয় কোন্দলে যারা দুর্বল, তারা প্রথম বলি হচ্ছেন। ফেনীর ঘটনাটি প্রমাণ করছে হত্যকারীরা শক্তিশালী। তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না। ঘটনার পরপর বিরোধী নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়ে গেছে। বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিনকে আসামি করে মামলা হয়ে গেছে। হত্যাকারীদের ধরার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই পুলিশের। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চড়িয়ে দিয়ে সবাই দায়িত্বমুক্ত। রাষ্ট্র এখন দায়িত্বজ্ঞানহীন অন্যায়ের প্রশ্রয়দাতা। খুন-গুমের উৎসবে অপরাধীরা যেন উল্লাসে রয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারের প্রতি মানুষের বিশ্বাস তাই শূন্যে ঠেকেছে।
সুখরঞ্জন বালি অপহরণ ও নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডি
অভিযোগ আছে, পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রবেশের মুখে অপহরণ করা হয়। মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা আদালতে অভিযোগ করেন সরকারি বাহিনী সাদা পোশাকে তাকে তুলে নিয়ে গেছে। আদালতকে এরা মোবাইলে ধারণ করা অপহরণদৃশ্যও উপস্থাপন করেন। আদালত বিষয়টি তদন্ত করে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন। দীর্ঘ দিন পর ২০১৩ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সূত্রে প্রথম প্রকাশ পায় সুখরঞ্জন বালি কলকাতার দমদম কারাগারে রয়েছেন। সেখান থেকে তিনি তাকে অপহরণের দীর্ঘ বিবরণ প্রকাশ করে দেন। বিগ ট্র্যাজেডি নারায়ণগঞ্জের সাত গুম, অপহরণের সাথে বালি অপহরণের মিল রয়েছে। কলকাতা কারাগার থেকে দেয়া সুখরঞ্জনের তথ্য মতে, তাকে অপহরণ করেছিল কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে। সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। নারায়াণগঞ্জের সাতজন কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে রাজপথে উঠেছেন, তখন তাদের তুলে নিয়ে যায় সরকারি বাহিনী। পার্থক্য হলো, সুখরঞ্জন এখনো বেঁচে আছেন। আর নারায়ণগঞ্জ ট্র্যাজেডির শিকার নজরুলসহ সাতজনের অধিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। বালিকে জোরপূর্বক সীমান্তে বাইরে ভারতে পুশ করে দেয়া হয়। ভারতীয় পুলিশ তাকে আটক করে বিচারের মুখোমুখি করে। কলকাতা কোর্টে তিনি আবেদন করেন তাকে যেন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো না হয়। তিনি জীবন হারানোর আশঙ্কা করছেন। তার ভাইকে হত্যার জন্য মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বালিকে রাষ্ট্রপক্ষ ওই মামলার সাক্ষী করে। কিন্তু তিনি সরকারপক্ষকে জানিয়ে দেন, এ সাক্ষ্য তিনি দিতে পারবেন না। কারণ তিনি জানেন, ওই হত্যাকাণ্ডের সাথে সাঈদীর কোনো সম্পর্ক নেই।
শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যা বিচার কোন সুদূরে
শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যা নিয়ে একটি বিরাট প্রশ্ন থেকে গেছে। অপহরণের পরদিন টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে তার লাশ পাওয়া যায়। তার আগে কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার ওপর চরম নির্যাতন চালানো হয় সেই সময়। অপহরণের দিন ভোরে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে তিনি দেখতে পান পুলিশের একটি ভ্যান। তার চার ঘণ্টা পর তিনি নিখোঁজ হন। বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির পক্ষে তিনি শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে তার হত্যার পর উদ্বেগ জানানো হয়। তাদের পক্ষ থেকে বিচার অনুষ্ঠানের জন্য জোর চাপ দেয়া হয়। ঘটনার চার বছর চলে গেছে অপরাধীদের শনাক্ত করা যায়নি। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে।
আর ফিরলেন না ওয়ালী ও মুকাদ্দাস
আল মুকাদ্দাস ও ওয়ালী উল্লাহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। এরা হানিফ পরিবহনের একটি গাড়ি করে ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন। সাভারের নবীনগরে র্যাব-৪-এর পরিচয় দিয়ে তাদের গাড়িটি থামান হয়। সাদা পোশাকের সাথে র্যাবের পোশাক পরা আট-দশজনের একটি গ্রুপ তাদের দু’জনকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নেয়। ২৭ মাস পেরিয়ে গেছে এখনো ফিরে আসেনি দুই মেধাবী ছাত্র। তাদের সন্ধান দাবি করে সহপাঠীরা অনেক মিছিল সমাবেশ করেছে। শিক্ষকেরা তাদের সাথে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আদালতের পক্ষ থেকেও তাদের সন্ধান দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। কিছুতেই কিছু হয়নি। ফিকাহ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আল মুকাদ্দাস ও দাওয়া অ্যান্ড ইসলামি স্টাডিজের মাস্টার্সের ছাত্র মো: ওয়ালীউল্লাহ। মুকাদ্দাস তার বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। অন্যজনও ছিলেন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে গত পাঁচ বছরে হারিয়ে গেছেন এমন অনেক তাজা প্রাণ।
ওয়ান হানড্রেড ক্রুসেডার
এক শ’ সশস্ত্র ক্যাডারকে কমান্ডো প্রশিক্ষণ দিয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড উইং। মিলিটারি প্রশিণ কেন্দ্র দেরাদুনে ভারতীয় আর্মির সেরা কমান্ডোরা ছয় মাসব্যাপী তাদের নিবিড় প্রশিক্ষণ দেয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূলে গঠিত এ বাহিনীকে নাম দেয়া হয় ‘ক্রুসেডার - ১০০’। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত চলা কার্যক্রম ‘ট্রেনিং ফর ফিউ ইয়াং কমান্ডোস অব বাংলাদেশ আর্মি’ নামে পরিচালিত হয়। শ্রীলঙ্কার গার্ডিয়ান পত্রিকা দি বেঙ্গল টাইগারস ইন দ্য ‘র’ কেইজ’ শিরোনাম ২৩ এপ্রিল ২০১২ সালে প্রথম এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। শ্রীলঙ্কান পত্রিকা খবরটি গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করলেও বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যমে এ ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধান চালায়নি। ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়া গুম-খুনের মধ্যে এ খবরটি অনেকের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। জেসিকা ফক্সের এ সংবাদের বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য এ বাহিনী গঠন করা হয়েছে। এ বাহিনীর জন্য উচ্চ সুযোগ-সুবিধা ও নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে।
হাই প্রোফাইল রাজনৈতিক গুম
নারয়াণগঞ্জ ট্র্যাজেডির মতোই বড় একটি গুমের ঘটনা ছিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী অপহরণ। চালকসহ ইলিয়াস ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে গুম হয়ে যান। সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য দলের মধ্যে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সিলেট বিএনপিকে গোছানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি বলিষ্ঠ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। রেজওয়ানা হাসান স্বামী এ বি সিদ্দিকের বেলায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে; যা সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় বিরোধী দল সরকারের ওপর ততটা চাপ দিতে পারেনি। স্ত্রী ও সন্তানেরা ইলিয়াসকে জীবিত উদ্ধারের আকুতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন। দুই বছর পার হয়ে গেলেও ইলিয়াসের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
প্রথম রাজনৈতিক গুম বিএনপি নেতা ও ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম। ২০১০ সালের ২৫ জুন তিনি নিখোঁজ হন। তাকে বহনকারী গাড়িটি কারওয়ান বাজারে পরিত্যক্ত পাওয়া যায়। গাড়িচালক অসীম চন্দ্র ভৌমিক জানান, ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে তারা ধানমন্ডির উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। ফার্মগেটে পৌঁছার আগে একটি মাইক্রোবাস তাদের গাড়িটির গতি রোধ করে। আলমকে মারধর করে সেই মাইক্রোয় তোলে তারা। ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিএনপি চৌধুরী আলমের ওপর নির্ভর করত। সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম কঠোর কর্মসূচির ঘোষণার পরই চৌধুরী আলম নিখোঁজ হন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, পুলিশ অথবা র্যাব এ ঘটনা ঘটিয়েছে। একই দাবি করা হয় বিএনপির পক্ষ থেকেও।
নারায়ণগঞ্জ সাহস জোগাচ্ছে গুমের শিকার পরিবারকে
গুমের নগরী নারায়ণগঞ্জই সাহস জোগাচ্ছে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের। অনেকে সাহস করে অভিযোগ জানাতে শুরু করেছেন। কুমিল্লা লাকসাম উপজেলার বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজকে অপহরণ করে গুম করার জন্য র্যাব-১১-এর সাবেক কমান্ডার চাকরিচ্যুত লে. কর্নেল তারেক সাঈদকে দায়ী করেছেন অপহৃতদের আত্মীয়রা। বেনাপোল পৌরসভার প্যানেল মেয়র তরিকুল ইসলাম তুহিনকে র্যাব অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী ছালমা।
লাকসামের দুই বিএনপির নেতার গুমের মামলায় উল্লেখ করা হয় ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর হিরুর আটার মিল থেকে র্যাব সদস্যরা ১৪ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনার পর হিরু পারভেজসহ মামলার ১ নম্বর সাক্ষী বিএনপি নেতা জসিম উদ্দিন কুমিল্লা যাওয়ার পথে র্যাব তাদের আটক করে। জসিম উদ্দিনকে ফেরত দিলেও বাকি দুই বিএনপি নেতার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
প্যানেল মেয়র তরিকুল ইসলামের স্ত্রী ছালমা অভিযোগ করেন তরিকুলকে র্যাবই অপহরণ করেছে। তরিকুল শার্শা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তিনি ১৪ মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। ছালমা জানান, গত বছরের ৭ মার্চ ঢাকার ফার্মগেট থেকে তিনি নিখোঁজ হন। শার্শা আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের ন্যাম ফ্যাটের বাসা থেকে তিনি ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছিলেন।
টার্গেট যারা
গুম খুনের টার্গেট কারা সেই বিষটি স্পষ্ট হওয়ার জন্য ২৫ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিচারবহির্ভূত হত্যার চিত্রটি দেখে নিতে পারি। এই ১২০ দিন সময়ে ১৫২ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। এদের মধ্যে ২৬ জন বিএনপির, যুবদলের ১৭ জন, ছাত্রদলের ১২ জন ও স্বেচ্ছাসেবক দলের তিনজন। জামায়াতের ৩৭ জন ও শিবিরের ২৫ জন। জাগপার একজন। গুম বা অপহরণের শিকার মানুষদের তালিকার বাইরে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায়। নারায়ণগঞ্জে সাত খুন ও ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে পুড়িয়ে হত্যার পর এটাও স্পষ্ট হলো ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী গ্রুপ এখন খুন-গুমের টার্গেট হচ্ছেন।
মুজিবুরকে রক্ষা করতে পারছে না ব্রিটিশ সরকারও
মুজিবুর রহমান হারিয়ে গেলেন ৪ মে রোববার। ঘটনার দিন থেকে তার ড্রাইভারসহ তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। রাত সাড়ে ৮টায় তিনি সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটের পথে রওনা হয়ে হারিয়ে যান। এর পর থেকে তিনি ও তার ড্রাইভার উভয়ের ফোন বন্ধ রয়েছে। যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে মুজিবকে উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। নিখোঁজ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর সেই আহ্বানের ফলোআপ জানতে ব্রিটিশ হাইকমিশনার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হাজির হন। হাইকমিশনার নিক লো মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেন। সুনামগঞ্জের সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তৎপরতা, দূতাবাসকে তাদের সরবরাহ করা তথ্য-উপাত্ত এবং ব্রিটিশ সরকারের অব্যাহত তাগিদের বিষয় পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তাদের অবহিত করে উদ্ধারকাজের কোনো অগ্রগতি আছে কি না জানতে চান। পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা কোনো সুখবর দিতে পারেননি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে তৈরি হচ্ছে বিরোধ
গুম-খুনের সাথে জড়িয়ে সরকারি বাহিনীগুলোর মধ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। র্যাব ও পুলিশের মধ্যে বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নেতিবাচক মন্তব্য করছেন। র্যাবের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায় র্যাবের বিরুদ্ধে অপহরণ ও গুমের অভিযোগ এনে যেসব সংবাদ সম্মেলন হচ্ছে, তা আয়োজনের পেছনে রয়েছে পুলিশ। নারায়ণগঞ্জে গণশুনানিতে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য পুলিশ অনেককে ভাড়া করেছে বলেও তারা অভিযোগ করেন। আসামির কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ১৮ র্যাব সদস্যকে সম্প্রতি প্রত্যাহার করে র্যাব সদর সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। র্যাব-৩ কোম্পানি কমান্ডার মেজর আলী আহসানও এ তালিকায় রয়েছেন। ১৯ মে এ তথ্য ফলাও করে প্রচার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়েবসাইট ‘ডিএমপি নিউজ পোর্টাল’। তদের বরাত দিয়ে সব জাতীয় গণমাধ্যম এ খবর প্রচার করে। এ দিকে ডিএমপির এ খবরকে উদ্দেশ্যমূলক ও নির্লজ্জ মিথ্যাচার বলে উল্লেখ করেছে র্যাব। অবশ্য এক দিন পর তাদের আবার র্যাবে ফেরত নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার টঙ্গীতে সেনা সদস্যদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে পুলিশ। পুলিশের একটি ভ্যানে সামান্য আঘাত লাগায় সেনাবাহিনীর কাছে তারা ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। সিভিল ড্রেসের সেনা সদস্যদের তারা আটক করে। পরে পোশাক পরা সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে পুলিশ সদস্যদের মারধর করে। সামান্য ঘটনা নিয়ে তুলকালাম মহাসড়কে এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। একটি দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের চরম বিরোধ রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুরবস্থার ইঙ্গিত করে। শাসকেরা এ পরিণাম নিয়ে সম্ভবত ভাবছে না।
রিকশাচালক বাবা বাঁচাতে পারলেন না শিশুসন্তানকে
মা-বাবার একমাত্র সন্তান সিয়াম। প্রতিদিনের মতো ১৭ মে খেলতে বের হয়। সন্ধ্যায় বাসা ফিরে না আসায় সবাই যখন উদ্বিগ্ন, তখন অচেনা নম্বর থেকে আসে একটি ফোন। জানানো হয় সিয়ামকে অপহরণ করা হয়েছে। তিন লাখ টাকা না দিলে তাকে হত্যা করা হবে। মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অটোরিকশাটি বিক্রি করে দেন বাবা। তাতে কাজ হয়নি, দুই দিন পর শিশুসন্তানের লাশ উপহার পান তিনি। বগুড়া শহরতলির বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিল সিয়াম। খবর শুনে মা অচেতন হয়ে পড়েন আর বাবার বুকফটা আর্তনাদে এলাকায় নামে শোকের ছায়া। মুক্তিপণের জন্য আমরা অনেক শিশুর করুণ হত্যা দেখেছি।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান গুমের চেষ্টা ভণ্ডুল
মানবাধিকার রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা আক্রমণের মুখে পড়ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক (তদন্ত) নূর খানকে অপহরণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ১৫ মে বিকেলে তিনি এক সহকর্মীসহ রিকশা করে অফিস থেকে বের হন। অফিস থেকে কয়েক গজ দূরে গেছেন এ সময় তাদের গতি রোধ করে দাঁড়ায় একটি মাইক্রো বাস। নূর খান দ্রুত অফিসে ফিরে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। মাইক্রোতে ছিল পাঁচ-ছয় যুবক। নূর খান একজন প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সব সময় তিনি উচ্চকণ্ঠ। সম্প্রতি তিনি লক্ষ করছিলেন মোটরবাইকে করে সবসময় তাকে কেউ অনুসরণ করছে। মতিঝিলে হেফাজতের সমাবেশে চালানো হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান বিকৃত করার অভিযোগ নিয়ে অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান ও পরিচালক এ কে এম নাসিরউদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে মামলা করে সরকার। তাদের আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। খুন-গুম নিয়ে কথা বলায় তারা হয়রানির শিকার হন সরকারের তরফ থেকে।
ডেঞ্জার জোন সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর ও সীতাকুণ্ড
গত কয়েক মাসে লক্ষ্মীপুরে গণহারে নাগরিকদের হত্যা করা হয়। একবার বিুব্ধ মানুষ র্যাবকে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলে। তাদের গোলাবারুদও শেষ হয়ে যায়। ঢাকা থেকে অতিরিক্ত বাহিনী গিয়ে তাদের হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করতে হয়েছে। নায়ায়ণগঞ্জের ঘটনায় অভিযুক্ত র্যাবের তারেক এ ঘটনায় নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে একজন ডাক্তারকে পরিবারের সদস্যদের সামনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ছাদের ওপর থেকে নিচে ছুড়ে ফেলা হয়। তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরায় ছয় মাস ধরে কী হচ্ছে তা সঠিকভাবে জানা যাচ্ছে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নিখোঁজ হওয়া এবং লাশ উদ্ধারের খবর প্রতিদিনই থাকছে। বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের গুম করা হয়েছে নির্বিচারে। সীতাকুণ্ডের খুন গুম দীর্ঘ দিন ধরে চলেছে।
জীবনের আইনগত নিরাপত্তা
বাংলাদেশের সংবিধান মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেয়। ৩২ ধারায় বলা হয়েছেÑ ‘আইন অনুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস ১৯৬৬ যা বাংলাদেশ ২০০০ সালে অনুমোদন করেছে তাতে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক মানুষের জন্মসূত্রে জীবনের অধিকার রয়েছে।’ তাতে আরো বলা হয়েছে, ‘এই অধিকার আইনের দ্বারা সুরক্ষিত হবে। জোরপূর্বক কারো জীবন হরণ করা যাবে না।’ এসব লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ও গানফাইটের নামে মানুষ হত্যা চলছে, আর তাতে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে সরাসরি মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন